শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

ভাগ্য রজনীতে সবার জন্য চাই কল্যাণ

মুহাম্মদ আবুল হোসাইন | প্রকাশের সময় : ২৮ এপ্রিল, ২০২২, ১২:০৩ এএম

দয়া, ক্ষমা ও দোজখের অগ্নি থেকে মুক্তির মাস শুরু হতে না হতেই চোখের পলকে শেষ হয়ে গেল। এই মাসের মূল উদ্দেশ্য হলো, সিয়াম সাধনার মাধ্যমে তাক্ওয়া বা খোদাভীতি অর্জন করে তদনুযায়ী নিজের জীবনকে পরিচালনা করা। এই মাসের দৈহিক রোজার সাথে সাথে আত্মিক রোজা কতটুকু পালন করতে পেরেছে, তার মাধ্যমে স্বীয় তাক্ওয়ার মাপকাটি করা প্রয়োজন। কারণ, মকবুল রোজার জন্য পানাহার ও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি যাবতীয় পাপকর্ম থেকে বিরত থাকাও অন্যতম শর্ত। এই মাস শুধুমাত্র রোযা রাখার মধ্য সীমাবদ্ধ নয়; বরং এই মাসের প্রতিটি মুহূর্ত ইবাদাতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এই মাসের প্রত্যেকটি দিন ও রাত অন্য মাসসমূহের দিনরাতের চাইতে অনেক উত্তম। আবার এই মাসের শেষ দশকে এমন একটি রাত্রি রয়েছে যে রাত্রির ইবাদাত হাজার মাসের ইবাদাতের চেয়েও উত্তম। পবিত্র কুরআ’নুল কারীমে এই রাত্রিকে ‘লাইলাতুল কদর’ বা ভাগ্য রজনী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এই মাসে সিয়াম সাধনাসহ যতপ্রকারের ইবাদাত করার চেষ্টা করা হয়েছে, তার ভুল-ত্রুটি থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করে মহান আল্লাহর দরবারে কবুল করানোর আরজি দেওয়ার এটিই অন্যতম রজনী।

‘কদর’ শব্দটি আরবি। অর্থ ভাগ্য, মাহাত্ম্য ও সম্মান। এই রাত্রিতে মানুষের পরবর্তী একবছরের ভাগ্য ফেরেশতাগণের নিকট হস্তান্তর করা হয়, যার মধ্য মানুষের বয়স, মৃত্যু ও রিজিকসহ সবকিছু নিহীত রয়েছে।
পবিত্র কুরআ’নুল কারীমের সাতানব্বইতম সূরা ‘আল-কদর’ এই মহিমান্বিত রজনীর মর্যাদা বর্ণনা করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন: ‘(নিশ্চয়ই আমি এটা (আল-কুরআ’ন) ভাগ্য রজনীতে অবতীর্ণ করেছি। আর ভাগ্য রজনী সম্পর্কে তুমি কী জান? ভাগ্য রজনী হাজার মাসের চাইতে উত্তম। এই রাত্রিতে ফেরেশতাগণ ও রূহ (জিবরাঈল) তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে প্রত্যেক কাজের জন্য অবতীর্ণ হন। শান্তিময়, এই রাত ফজর উদয় পর্যন্ত’। [সূরা আল-ক¦াদর]। সূরা দুখানের আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে: ‘(পবিত্র রজনীতে তাকদীর সংক্রান্ত সব ফয়সালা লিপিবদ্ধ করা হয়)’। [সূরা আদ-দুখান: ৪।] এর মর্ম হলো, এ বছর যেসব বিষয় প্রয়োগ করা হবে, সেগুলো লাওহে মাহফুজ থেকে নকল করে ফেরেশতাগণের কাছে সোপর্দ করা হবে।

এই রজনীর শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে বিভিন্ন হাদীসেও বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে। এই মাসের শেষ দশকে যেকোন দিন ‘লাইলাতুল কদর’ হতে পারে, তাই রাসূলুল্লাহ (দ.) শেষ দশককে এত বেশি গুরুত্ব দিতেন যে, তিনি ইবাদাতের জন্য পূর্ব থেকেই প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন এবং পুরো রাত্রি জাগ্রত থেকে নামাজ, কুরআ’ন তেলাওয়াত, দুয়া ও জিকিরের মাধ্যমে অতিবাহিত করতেন। এমনকি তিনি তার পরিবারের সদস্যদেরকেও ইবাদাত করার জন্য ঘুম থেকে জাগিয়ে দিতেন। উম্মুল মু’মেনীন আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: ‘যখন রমজানের শেষ দশক আসত তখন রাসূলুল্লাহ (দ.) তার চাদর কষে নিতেন (অর্থাৎ বেশি বেশি ইবাদাতের জন্য প্রস্তুতি নিতেন) এবং রাতে জেগে থাকতেন ও পরিবার পরিজনকে জাগিয়ে দিতেন’। [সহীহ বুখারী: ২০২৪; সহীহ মুসলিম: ১১৭৪]

ইমাম ইবনে খুযায়মা ও বায়হাকী (রহ.) বিশুদ্ধ সনদে বর্ণনা করেন। শা’বান মাসের শেষ দিনে রাসূলুল্লাহ (দ.) রমজান মাসের মর্যাদা বর্ণনা করে দীর্ঘ এক ভাষণ প্রদান করেন এবং উক্ত ভাষণে তিনি উল্লেখ করেন যে, এই মাসে এমন এক মহিমান্বিত রাত রয়েছে, যে রাতের মাহাত্ম্য হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। অন্য হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (দ.) বলেছেন: ‘রমজান মাসে এমন এক রাত রয়েছে, যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। যে ব্যক্তি এ রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয়েছে, সে যাবতীয় কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হল’। [নাসায়ী ও মুসনাদে আহমাদ]
এই রাতে অগণিত ফেরেশতা আল্লাহর বান্দাদের ইবাদাত পর্যবেক্ষণ করার জন্য পৃথিবীতে বিচরণ করে থাকেন এবং ফজর উদিত হওয়ার পর আসমানে আরোহন করে মহান আল্লাহকে বান্দাদের পক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করেন। হাদীসে এসেছে, ‘কদর রাত্রিতে পৃথিবীতে ফেরেশতারা এত বেশি অবতরণ করেন যে, তাদের সংখ্যা পাথরকুচির চেয়েও বেশি’। [মুসনাদে তায়ালাসী: ২৫৪৫]

রাসূলুল্লাহ (দ.) এই রাতের নির্দিষ্ট কোনো তারিখ উল্লেখ করেননি। শুধুমাত্র রমজানের শেষ দশকের বেজোড় দিনগুলোতে এই রজনী অন্বেষণের নির্দেশনা দিয়েছেন। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (দ.) বলেছেন: ‘তোমরা রমজানের শেষ দশকে লাইলাতুল কদর অন্বেষণ কর’। [সহীহ বুখারী: ২০২০; সহীহ মুসলিম: ১১৬৯।] অন্য হাদীসে বর্ণনা করা হয়েছে: ‘তোমরা রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতে লাইলাতুল কদরের সন্ধান কর।’ [সহীহ বুখারী: ২০১৭।] তবে এই রাতের নির্দিষ্ট তারিখ নিয়ে ইসলামিক স্কলারদের বিভিন্ন উক্তি রয়েছে, যার সংখ্যা প্রায় চল্লিশটি বলে ইমাম ইব্নে হাজার আল্-আসকালানী (রহ.) উল্লেখ করেছেন। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য উক্তিটি হলো, সাহাবীদের মধ্য উমর ইব্নুল খাত্তাব, উবাই ইবনে কা’ব, আব্দুল্লাহ ইব্নে আব্বাস ও হুযাইফা (রা.)-সহ একদল সাহাবী ছাব্বিশ তারিখ দিনগত সাতাশ তারিখের রাতকে সম্ভাব্য ভাগ্য রজনী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এই উক্তিটিকে অধিকাংশ আলেম গ্রহণযোগ্য হিসেবে মত দিয়েছেন এবং তার আলোকে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সম্ভাব্য হিসেবে উক্ত তারিখে ভাগ্য রজনী পালন করা হয়।

এই রাত্রিতে বিভিন্ন প্রকারের ইবাদাত রয়েছে। এরমধ্যে বিখ্যাত আলেমগণ এই রজনীতে ইবাদাতের পূর্বে গোসল করে নতুন পোশাক পরিধান করে সুগন্ধি লাগানোকে মুস্তাহাব বলেছেন। বর্ণিত আছে, প্রসিদ্ধ সাহাবী আনাস বিন মালিক (রা.) রমজানের চব্বিশ তারিখ রাতে গোসল করে নতুন কাপড় পরিধান করে শরীরে সুগন্ধি লাগাতেন। প্রখ্যাত তাবেয়ী ইব্রাহিম নখয়ী (রা.) লাইলাতুল কদর উপলক্ষে রমজানের শেষ দশরাতের সম্ভাব্য রাতগুলোতে গোসল করে সুগন্ধী ব্যবহার করতেন এবং কূফার প্রসিদ্ধ তাবেয়ী আবু মারইয়াম ইবনে হুবাইশকে ছাব্বিশ তারিখ দিনগত সাতাশ তারিখ রাতে গোসল করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তাছাড়া প্রসিদ্ধ তাবেয়ী আইয়ুব সাখতিয়ানী (রা.)-সহ অনেক তাবেয়ীগণ রমজানের শেষ দশরাতের যেকোন একরাত লাইলাতুল কদর হবে মনে করে শেষ দশরাতের অধিকাংশ রাতে গোসল করে নতুন পোশাক পরিধান করতেন এবং সুগন্ধি ব্যবহার করতেন। সুতারাং বুঝা গেল, জুম্আ এবং ঈদের মতো এই রাতে গোসল করে নতুন পোশাক পরিধান করে সুগন্ধি মেখে আল্লাহর ইবাদতের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা উত্তম।

এই রাতের আমলের মধ্য উল্লেখযোগ্য হলো, ফরজের পর যত বেশি সম্ভব নফল নামায পড়া। কেননা, এই রাতের নফল নামাজের উসিলায় করুণাময় ক্ষমাশীল আল্লাহ বান্দার পূর্ববর্তী অপরাধগুলো ক্ষমা করে দেন। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (দ.) বলেছেন: ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াব লাভের আশায় নামাজের মাধ্যমে কদর রজনী কাটাবেন, তার পূর্ববর্তী গুণাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে’। [সহীহ বুখারী: ১৯০১]

কদর রজনীর অন্যতম আমল হলো কুরআ’ন তেলাওয়াত করা। রাসূলুল্লাহ (দ.) রমজানের শেষ দশরাতে এমনভাবে তারতীল সহকারে কুরআ’ন তেলাওয়াত করতেন যে, রহমত বা দয়া সংক্রান্ত কোনো আয়াত এলে তিনি আল্লাহর নিকট চাওয়া ছাড়া পরবর্তী আয়াতে যেতেন না। আর আজাব বা শাস্তি সংক্রান্ত আয়াত আসলে তিনি আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করা ছাড়া পরবর্তী আয়াত তেলাওয়াত করতেন না এবং প্রত্যেক আয়াত তেলাওয়াতের সময় গভীরভাবে চিন্তা করতেন। প্রসিদ্ধ সাহাবী আবু দারদা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (দ.) বলেছেন: ‘তোমাদের মধ্য কেউ একরাতে কুরআ’নুল কারীমের এক তৃত্বীয়াংশ পড়তে কী অক্ষম? প্রতি উত্তরে বলা হলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ (দ.)! কে ঐটাতে সক্ষম হবে? এই উত্তরে রাসূলুল্লাহ (দ.) সূরা ইখলাছ পড়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন’। [মুসনাদ তায়ালাসী: ১০৬৮]

দু’য়া এই রাতের গুরুত্বপূর্ণ আমলসমূহের মধ্য অন্যতম। সুফ্ইয়ান সূরী (রা.) এই রাতে নফল নামাজের চাইতে দু’য়াকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। কারণ, এই রাতে মহান আল্লাহ বান্দার ফরিয়াদ বেশি বেশি কবুল করেন। হাদীসে এসেছে, উম্মুল মু’মেনীন আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) লাইলাতুল কদরের আমল সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (দ.)-এর কাছে জানতে চাইলে তিনি আল্লাহর কাছে বেশি বেশি ক্ষমা প্রার্থনার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। [সুনানুল কুবরা: ৭৬৬৫]

জিকির এই মহিমান্বিত রজনীর অন্যতম একটি আমল। কারণ, জিকির হলো বান্দা কর্তৃক আল্লাহর মহানত্ব ঘোষণার অন্যতম মাধ্যম। মহান আল্লাহর বিশেষ ফেরেশতাগণ পৃথিবীর মধ্য জিকিরের মজলিস তালাশে মগ্ন থাকেন এবং কোথাও জিকিরের মজলিস পেলে সেখানে শেষ না হওয়া পর্যন্ত বেষ্টনী দিয়ে রাখেন; মজলিস শেষান্তে আসমানে আরোহন করে মহান আল্লাহর নিকট জিকিরকারী বান্দাদের পক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করেন। তাই ভাগ্য রজনীতে জিকিরের মাধ্যমে বান্দা এই সুযোগটি গ্রহণ করতে পারেন। সহীহ মুসলিমের হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, আবু হুরায়রা (র.) রাসূলুল্লাহ (দ.) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: ‘আল্লাহর ভ্রাম্যমাণ বিশেষ (রিজার্ভ) কিছু ফেরেশতা রয়েছে। তারা শুধু বান্দার জিকিরের মজলিসসমূহ অনুসন্ধান করে বেড়ায়। তাঁরা যখন জিকিরের কোনো মজলিস পায় তখন সেখানে জিকিরকারী বান্দাদের সাথে বসে যায়। তারা একে অপরকে পাখা দিয়ে বিস্তার করে এমনভাবে বেষ্টন করে রাখে যাতে তাদের ও আসমানের মধ্যবর্তী ফাঁকা স্থানও পূর্ণ হয়ে যায়... ’। [সহীহ মুসলিম: ২৬৮৯]

সুতারাং এই ভাগ্য রজনী প্রত্যেক বান্দার জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এই রাতেই মহান আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদের পরবর্তী একবছরের ভাগ্য ফেরেশতাদের নিকট হস্তান্তর করেন। তাই এই রাত্রিতে জাগ্রত থেকে বিভিন্ন প্রকারের ইবাদাতের মাধ্যমে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা প্রত্যেক বান্দার কর্তব্য। এই রাতে আমরা সবার কল্যাণ ও মঙ্গল কামনা করি।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। পিএইচডি গবেষক, কিং আব্দুলআজীজ বিশ^বিদ্যালয়, জেদ্দা, সৌদি আরব।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন