ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভের তৃতীয় হচ্ছে সিয়াম সাধনা বা রোজা, তথা নির্ধারিত সময়ের জন্য খাওয়া-দাওয়া থেকে বিরত থেকে উপবাস যাপন। মানবজাতি এ রোজার মাধ্যমে মানসিকভাবে আত্মসংযমে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, যা দেহকে পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন করে তোলে। রোজার দ্বারা মানুষের মানসিক ও শারীরিক সুস্থতা হাসিল হয় এবং সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ সাধিত হয়। রোজা একই সঙ্গে মানবদেহে রোগ প্রতিষেধক হিসাবে কাজ করে। তাই নবী করিম (স.) বলেছেন, ‘সুস্বাস্থ্যের জন্য রোজা রাখো।’
রমজান শব্দটি রামদ ধাতু থেকে উৎপন্ন। এর অর্থ হচ্ছে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দেওয়া। এভাবে ধ্বংস না-হলে কিন্তু এইসব বিষাক্ত পদার্থ শরীরে রক্তচাপ, একজিমা, অন্ত্র ও পেটের পীড়াসহ বিভিন্ন রোগব্যাধির জন্ম দিতে থাকত, যা জনস্বাস্থ্যের জন্যে হুমকিস্বরূপ। এছাড়া, উপবাস কিডনি ও লিভারের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি করে এবং শরীরে নতুন জীবনীশক্তি বৃদ্ধি করে রোজাদারের মনে সজীব অনুভূতি এনে দেয়। সিয়াম সাধনায় দেহের পরিপাক যন্ত্র এক প্রকার পরিশুদ্ধি লাভের অবকাশ পায়। ফলে দেহের অপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের সারাংশ ও সঞ্চিত বিষাক্ত রস নিঃশেষ হয়ে যায়। দেহের বাড়তি ওজন রস, চর্বি ইত্যাদি হ্রাস পায়। পাকস্থলী সংক্রান্ত রোগসমূহ যেমন-ক্ষুধামান্দা, পেট ফাঁপা, চোঁয়া ঢেকুর, লিভারের দুর্বলতা, বমিবমি ভাব প্রভৃতি সিয়াম সাধনার ফলে স্বাভাবিকভাবেই উপশম হওয়ার সুযোগ পায়।
রোজা মানব স্বাস্থ্যের বিরাট উপকার সাধন করে। সারা বছর অনিয়মিত বা অতিরিক্ত পানাহার ও অধিক চর্বিযুক্ত খাদ্য খেয়ে রক্তে যখন প্রচুর কোলেস্টেরেল জমে প্রেশার বা অন্য যে-কোনো পীড়া হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয় তখন রোজার উপবাস রক্তের কোলেস্টেরল ও হৃদরোগের আশঙ্কা মুক্ত করে। অতি ভোজনের অত্যাচারে পাকস্থলী যখন হতোদ্যম ও দুর্বল হয়ে পড়ে তখন একমাসের রোজা পাকস্থলীকে সবল করে নতুন জীবন দান করে, ফলে রক্ত ও রক্তনালীগুলো পরিস্কার হয়ে যায়। রোজা শুরুর কিছু দিনের মধ্যে রোজাদার নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে নিতে পারেন। কারণ ক্ষুধার চিরাচরিত অভ্যাস রোজা শুরুর প্রথম কয়েকদিনই একটু যন্ত্রণা দেয় মাত্র, পরে এটাও অভ্যাসের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। এরপর সিয়াম সাধনা বা রোজা অনুশীলনকারী ব্যক্তি প্রতিদিনই মানসিকভাবে নিজেকে প্রাণময়, চঞ্চল ও উৎফুল্ল মনে করেন। জীবন চাঞ্চল্যের নবতর প্রবাহ শরীরে জীবনতরঙ্গের সৃষ্টি করে। রমজান মাসে দিনের বেলায় স্ত্রী-সহবাস নিষিদ্ধ থাকায় উভয়ের স্বাস্থ্য ভালো থাকে। আহার গ্রহণের রুটিন ঠিক থাকায় মহিলাদের মাসিক ঋতুজনিত কোনো ধরনের অসুবিধা থাকলে তাও ঠিক হয়ে যায়।
খাবারের উপাদান থেকে সারা বছর ধরে মানুষের শরীরের জমে থাকা কতিপয় বিষাক্ত পদার্থ, চর্বি ও আবর্জনা থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র সহজ ও স্বাভাবিক উপায় হচ্ছে উপবাস। রোজা রাখার ফলে দেহের অভ্যন্তরে দহনের সৃষ্টি হয় এবং শরীরের ভিতরে জমে থাকা বিষাক্ত পদার্থগুলো দগ্ধ হয়ে যায়। উপবাসকালে শরীরের মধ্যস্থিত প্রোটিন, ফ্যাট ও শর্করাজাতীয় পদার্থসমূহ স্বয়ং পাচিত হয়। ফলে গুরুত্বপূর্ণ কোষগুলোতে পুষ্টি বিধান হয়। ফলে শরীরে উৎপন্ন উৎসেচকগুলো বিভিন্ন কোষে ছড়িয়ে যায়। এটি হচ্ছে শারীরিক বিক্রিয়ার এক স্বাভাবিক পদ্ধতি। রোজা এই পদ্ধতিকে সহজ, সাবলীল ও গতিময় করে। রোজার উপবাসের মাধ্যমে লিভারে রক্তসঞ্চালন দ্রুত হয় ফলে ত্বকের নিচে সঞ্চিত চর্বি, পেশির প্রোটিন, গ্রন্থিসমূহ এবং লিভারের কোষসমূহ আন্দোলিত হয়। অভ্যন্তরীণ দেহযন্ত্রগুলোর সংরক্ষণ এবং হৃৎপিন্ডের নিরাপত্তার জন্য অন্য দেহযন্ত্রগুলোর বিক্রিয়া বন্ধ রাখে। খাদ্যাভাবে বা আরাম-আয়েশের জন্য মানুষের শরীরে যে ক্ষতি হয় রোজা তা পূরণ করে দেয়। এছাড়া, মানুষের শরীরে রোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রেও রোজা অনেক উপকার সাধন করে। তাই বর্তমানে অনেক দূরারোগ্য রোগ, যেমন-হৃদরোগ, চর্মরোগ, বাত, কোষ্ঠকাঠিন্য, স্থ’লকায় রোগী, জ্বর, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি রোগ নিরাময়ে রোজা রাখার উপদেশ দেওয়া হচ্ছে। রোজা এসব রোগের কষ্ট দূর করে। রোজা রাখার ফলে শরীরের মধ্যস্থিত অনেক ক্ষতিকারক টক্সিনের বিষক্রিয়া থেকে শরীর রক্ষা পায়। এটি অতি স্বাভাবিক ও অত্যন্ত কার্যকরী পন্থায় অভ্যন্তরে বিধৌত ও পরিচ্ছন্ন হয়। তাই আধ্যাত্মিক সুফি সাধকদের মতে, হৃদয়ের ক্ষমতা হাসিলে স্বল্প খাদ্য গ্রহণের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। রোজার সময়ে মানুষের শরীরের বিপাক ক্রিয়া বছরের অন্যান্য সময়ের চেয়ে কিছুটা পরিবর্তিত হয় বলে সহজপাচ্য অর্থাৎ সহজে হজম হয় এ জাতীয় খাবার গ্রহণ করা উচিত। সুতরাং, স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে ও পরিমিত পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করে রমজান মাসে রোজাদারদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা করা মোটেই কঠিন ব্যাপার নয়।
আফতাব চৌধুরী
সাংবাদিক-কলামিস্ট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন