দেশে আগামীতে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য সংবিধানের বিধান অনুযায়ী আইন প্রণয়নের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন রাজনীতিক, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও বিশেষজ্ঞরা। নির্বাচন কমিশন নিয়োগ নিয়ে গত সোমবার সিরডাপ মিলনায়তনে ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপ আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতৃবৃন্দসহ নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও বিশেষজ্ঞরা এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তারা বলেছেন, দেশে নির্বাচন কমিশন নিয়োগে কোন আইন না থাকায় গত ৪৪ বছরে বিভিন্নভাবে তাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে। সংবিধানে আইন প্রণয়নের কথা থাকলেও তা আজো হয়নি। তারা মনে করেন, সংবিধানের নির্দেশনা মোতাবেক প্রণীত আইন মোতাবেক নিরপেক্ষ ও অভিজ্ঞ প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের সুপারিশ করেছেন তারা। এই লক্ষ্যে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ পূর্তি অর্থাৎ আগামী ফেব্রুয়ারির আগেই আইন প্রণয়নের দরকার বলে অভিমত দিয়ে তারা বলেছেন, আগামী ইসি নিয়োগে পূর্ব-প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হলে মার্চেই বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা হবে আদালতে। আইনী প্রক্রিয়ায় ইসি নিয়োগ না হলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে। দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হবে। এদিকে ব্রিটিশ হাইকমিশনার এলিসন ব্লেইক বলেছেন, বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে ব্রিটেন।
সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের পূর্বশর্তই হচ্ছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর থেকে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের যে প্রসঙ্গ জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উঠে এসছে, সে বিবেচনায় ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপের আলোচনা বিশেষ গুরুত্বের দাবিদার। আলোচনায় আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়ামের একজন সদস্য সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের অপরিহার্যতা স্বীকার করে বলেছেন,আওয়ামী লীগ কোন প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন চায় না। সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে যা যা দরকার আওয়ামী লীগ তা করবে। তিনি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোন প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন চান না। বিএনপির প্রতিনিধি বলেছেন, আজকের প্রেক্ষাপটে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন ও সুষ্ঠু নির্বাচনের একমাত্র পথ হচ্ছে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি স্থায়ী পদ্ধতি বের করা। এজন্য প্রয়োজনে আইন করা যেতে পারে। বিশিষ্ট এক আইনজীবী মন্তব্য করেছেন, স্বাধীনতার পর থেকে এতদিন আইন ছাড়াই নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে। কেউ কোন চ্যালেঞ্জ করে রীট করেনি। আইন না করে এবারও সার্চ কমিটি করে সেই প্রক্রিয়ায় ফেব্রুয়ারিতে ইসি নিয়োগ হলে মার্চে অবশ্যই আদালতে তা চ্যালেঞ্জ হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একজন সাবেক উপদেষ্টা বলেছেন, শক্তিশালী ইসি গঠনে আইন প্রণয়ন জরুরী। আইন ছাড়া বিষয়টি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া সম্ভব নয়। একজন সাবেক নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের বৈশিষ্ট্য কী তা আইনে উল্লেখ থাকা দরকার। তিনি মনে করেন, যে দল ক্ষমতায় থাকবে তারা নিরপেক্ষ না হলে কোন নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া সম্ভব নয়। যারা নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেন তাদের প্রতিনিধিরা মনে করছেন, আগের ইসি আইনের একটা খসড়া দিয়েছে। এখন আইন প্রণয়ন করাটা সহজ হবে। প্রকৃত বিবেচনায় এযাবৎকাল আইন না থাকার ফলেই নানা ধরনের বিতর্ক উঠেছে বা উঠতে পেরেছে। নির্বাচনই হচ্ছে গণতন্ত্রে সরকার পরিবর্তনের একমাত্র বৈধ পথ। সুষ্ঠু নির্বাচনের উপরই নির্ভর করে গণতন্ত্রের পথচলা। আলোচনায় কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন পৃথিবীতে এমন অনেক দেশ রয়েছে যেখানে ইসি ছাড়াই সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হচ্ছে। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, এ দেশের রাজনীতিকদের সততার উপর এক ধরনের অনাস্থা রয়েছে। সে ধারণা থেকেই একসময়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের নিমিত্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়েছিল। উচ্চতর আদালতের রায়ে তা বাতিল করার পর একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে কার্যতই মহাসংকট দেখা দিয়েছে। সে বিবেচনায় সংবিধানের আলোকে সংবিধান নির্দেশিত পন্থায় নির্বাচন কমিশন আইন করার যে প্রস্তাব উঠেছে তাকে সংগত বিবেচনায়ই গুরুত্ব সহকারে দেখার অবকাশ রয়েছে। এখানে আরো একটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার যে, আন্তর্জাতিক বিশ্বও বাংলাদেশে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে। বৃটিশ হাইকমিশনারের বক্তব্যেও তার প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে। অন্যদিকে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের অনুপস্থিতির জের পড়ছে ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি ও বিনিয়োগেও। যে ধরনের আস্থার সংকটের কথা বিনিয়োগের অন্তরায় হিসেবে মনে করা হয় তা মূলত গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের অনুপস্থিতি থেকেই উৎসারিত।
একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হলে দেশে যে অস্থিতিশীলতার আশঙ্কা দিন দিনই বাড়বে, সে কথা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। নির্বাচন যখনই হোক তার গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি এড়িয়ে যাবার কোন সুযোগ নেই। এ ব্যাপারে ঐকমত্য জরুর কি জরুর নয়, তা নিয়ে ইতোমধ্যেই বিতর্ক দেখা দিয়েছে। এটা অবশ্যই অনস্বীকার্য যে যারা নির্বাচনে অংশ নিতে চান তারা নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ দেখতে চান। এটি ফলাফলের গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রেও বড় বিবেচ্য বিষয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, চলমান গণতান্ত্রিক সংকটের মূলেও রয়েছে নির্বাচন কমিশনের প্রসঙ্গ। যেহেতু আলোচনায় সরকারি, বিরোধী, নাগরিক কমিটিসহ সমাজের প্রায় সকল শ্রেণী-পেশার প্রতিনিধিত্বশীলরা অংশ নিয়ে একটি সুচিন্তিত অভিমত প্রকাশ করেছেন, তাকে জাতীয় মতের প্রতিফলন মনে না করার কোন কারণ নেই। প্রতিবেশী ভারতসহ বিশ্বের সকল দেশেই নির্বাচনকালীন সময়ে নির্বাচন কমিশনই মুখ্য ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশে আইনত এটা করা হলেও কার্যত তা করা হয় না। এখানেই মূল সংকট। একটি সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা করতে যতটা ক্ষমতা, আয়োজন ও জনবল নির্বাচন কমিশনের দরকার তা তাদের নেই। সুতরাং আইন প্রণীত হলে তার সফল বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় রসদ ও সুবিধাদির দরকার পড়বে। যাই হোক আজকের বাস্তবতা হচ্ছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। প্রধানমন্ত্রীও প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন দেখতে চান না। সে কারণে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্যই সংবিধানের আলোকে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়নের বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের গুরুত্বের সাথে ভেবে দেখা জরুরী। তাতে অনেক জটিল সমস্যার সহজ সমাধান হয়ে যেতে পারে। সংশ্লিষ্ট সকলে এ ব্যাপারে আন্তরিক হবেন- এটাই জনগণ প্রত্যাশা করে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন