বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

দারিদ্র্য বিমোচনে জাকাত

এহসান বিন মুজাহির | প্রকাশের সময় : ৩০ এপ্রিল, ২০২২, ১২:০৩ এএম

ইসলামের জাকাত বিধান ধনী-গরিবের মাঝে বৈষম্য দূরীকরণে ন্যায় ও ইনসাফপূর্ণ বণ্টনব্যবস্থা। জাকাত আদায়ের মাধ্যমে ধনী-গরিবের মাঝে ভালোবাসার বন্ধন তৈরি হয়। আর্থিক ভারসাম্য সৃষ্টি হয়। সমাজ থেকে দারিদ্র্য দূর হয়। নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিকের ওপর জাকাত ফরজ। জাকাত আদায়ের সুনির্দিষ্ট সময় না থাকলেও অফুরন্ত পুণ্যেভরা মাহে রমজানুল মোবারকই জাকাত আদায়ের সর্বোত্তম সময়। যেহেতু নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিকদের বছরের যেকোনো দিন নির্দিষ্ট পরিমাণে জাকাত আদায় করতে হবে, সেহেতু জাকাত আদায়ের সে সময়টা রমজান মাসকে বেছে নেয়াটা সর্বোত্তম। কেননা রমজান হলো ইবাদতের বসন্তকাল। আর আল্লাহ এই রমজান মাসে তাঁর যেকোনো ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত, নফল, ইবাদতের সওয়াব বহুগুণে বৃদ্ধি করে দেন। তাই জাকাত আদায়কারী ব্যক্তিদের এ মাসে সুবর্ণ সুযোগটি গ্রহণ করা উচিত। জাকাত কারও প্রতি করুণা প্রদর্শন নয়; বরং গরিব-দুঃখীর ন্যায়সঙ্গত অধিকার।

ইসলামী শরিয়ত নির্ধারিত নিয়মে জাকাত আদায় করা প্রত্যেক সামর্থ্যবান ব্যক্তির ওপর ফরজ। আভিধানিক অর্থে জাকাত হলো বৃদ্ধি করা, পবিত্রতা, বিশুদ্ধতা ইত্যাদি। জাকাত প্রদানের মাধ্যমে সম্পদ পবিত্র ও পরিশুদ্ধ হয় এবং মালের মধ্যে বরকত বৃদ্ধি পায়। ঈমান আনা ও নামাজ আদায়ের পর জাকাত প্রদান করা ঈমানের দাবি। ইসলামি শরিয়তে জীবনযাত্রার অপরিহার্য প্রয়োজন মেটানোর পর সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য বা যে কোন একটির সমমূল্যের সম্পদ কারো নিকট পূর্ণ এক বছর সঞ্চিত থাকলে নির্ধারিত সম্পদের একাংশ (শতকরা আড়াই শতাংশ) আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোরআনে বর্ণিত আট প্রকার খাতে ব্যয় করাকেই জাকাত বলা হয়।

কোরআন ও হাদিসে জাকাতের গুরুত্ব অপরিসীম। পবিত্র কোরআনুল কারীমে সূরা বাকারার ১১০ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন, ‘তোমরা নামাজ কায়েম করো এবং জাকাত দাও’। অন্যত্র এরশাদ হয়েছে, ‘যারা জাকাত দেয় না তারা হলো সেসব লোক, যারা আখেরাতের প্রতিও অবিশ্বাসী’। (সূরা হামিম আস সাজদা: ৭)। আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন, ‘তাদের ধনমালে রয়েছে সুনির্দিষ্ট অধিকার। প্রার্থী ও বঞ্চিত মানুষের জন্য। (সূরা মাআরিজ: ২৪)। আল্লাহ তায়ালা আরও এরশাদ করেন, ‘তোমরা নামাজ কায়েম করো, জাকাত প্রদান করো এবং রাসুলের আনুগত্য করো, যাতে তোমরা অনুগ্রহ প্রাপ্ত হও। (সূরা নুহ: ৫৬)। কোরআন মাজিদে আরও এরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা নামাজ কায়েম করো, জাকাত প্রদান করো এবং নামাজে অবনত হও তাদের সঙ্গে যারা অবনত হয়। (সূরা বাকারা: ৪৩)। আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন, ‘তোমরা নামাজ কায়েম করো, জাকাত প্রদান করো এবং রাসূল (সা.) এর আনুগত্য করো, যাতে তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হও’। (সূরা নূর: ৫৬)। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আরও এরশাদ করেছেন, ‘আর যারা সোনা ও রুপা সঞ্চিত করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ প্রদান করুন। সেদিন ওইসব (সোনা-রুপা) দোজখের আগুনে উত্তপ্ত করা হবে এবং তা দ্বারা তাদের ললাটে, পার্শ্বদেশ ও পৃষ্ঠদেশে দাগ দেয়া হবে। এটা তোমরা নিজেদের জন্য যা সঞ্চয় করেছিলে তার প্রতিফল। সুতরাং যা তোমরা সঞ্চিত করেছিলে তার স্বাদ গ্রহণ করো। (সূরা তওবা : ৩৪-৩৫)।

অনুরূপভাবে আল্লাহপাক আরও এরশাদ করেন, ‘তোমাদের কীসে জাহান্নামে নিয়ে এসেছে? তারা বলবে, আমরা নামাজ পড়তাম না এবং অভাবগ্রস্তকে আহার্য (জাকাত) দিতাম না। (সূরা মুদাসসির: ৪২-৪৪)। আল্লাহতায়ালা কোরআনে সুস্পষ্ট ভাষায় জাকাতের হকদার সর্ম্পকে বলে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘নিশ্চই সদকাহ হচ্ছে, ফকির ও মিসকিনদের জন্য এবং এতে নিয়োজিত কর্মচারিদের জন্য, আর যাদের অন্তর আকৃষ্ট করতে হয় তাদের জন্য, দাস আযাদ করার ক্ষেত্রে, ঋণগ্রস্থদের মধ্যে, আল্লাহর রাস্তায় এবং মুসাফিরদের মধ্যে। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত, আর আল্লাহ মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়। (সূরা তাওবা: ৬০)। পবিত্র কোরআনে আরও এরশাদ হচ্ছে, ধনীদের সম্পদে রয়েছে বঞ্চিতদের অধিকার (সুরা আয যারিয়াত: ১৯)। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) সাহাবি মুআজ (রা.)-কে গভর্নর হিসেবে ইয়েমেনে প্রেরণ করলেন। এ সময় রাসুল (সা.) তাকে বললেন, তুমি এমন এক সম্প্রদায়ের কাছে যাচ্ছ যারা আহলে কিতাব। প্রথমত, তুমি তাদের এ কথার সাক্ষ্য দিতে আহবান করবে যে, আল্লাহ ব্যতিত কোনো ইলাহ তথা উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসুল। অতপর তারা যদি এ কথার আনুগত্য করে, তবে তাদের জানিয়ে দেবে, আল্লাহতায়ালা দিবারাত্রে তাদের ওপর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করে দিয়েছেন। তারা যদি এ কথার আনুগত্য করে তবে তাদের জানিয়ে দেবে, আল্লাহতায়ালা তাদের ওপর জাকাত ফরজ করে দিয়েছেন, যা ধনীদের কাছ থেকে গ্রহণ করা হবে এবং দরিদ্রদের মাঝে বণ্টন করা হবে। (মুসলিম: ১৬৮০)।

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যেসব স্বর্ণ ও রৌপ্যের মালিক তা হতে তার হক (জাকাত) আদায় করে না, যখন কেয়ামতের দিন আসবে নিশ্চয়ই তার জন্য অনেকগুলো আগুনের পাত তৈরি করা হবে এবং সেগুলোকে জাহান্নামের আগুনে গরম করা হবে। আর তা দ্বারা তার পাঁজরে, ললাটে এবং পিঠে দাগ দেয়া হবে। যখনই পৃথক করা হবে তখনই পুনরায় তা শুরু করা হবে। তার এ শাস্তি অব্যাহত থাকবে সেদিন পর্যন্ত যার পরিমাণ হবে ৫০ হাজার বছরের সমান। যতক্ষণ না বান্দাদের সবার বিচার ফয়সালা শেষ করা হবে এবং প্রত্যেকে নিজ নিজ পথ ধরবে, হয় বেহেশতের দিকে না হয় দোজখের দিকে। (মুসলিম: ১৬৮১)।

জাকাতের ফরজ: জাকাতের ফরজ হওয়ার জন্য শত হলো ছয়টি। শর্তগুলো হচ্ছে: ১. মুসলমান হওয়া। ২. জাকাত প্রদানকারী ব্যক্তি সুস্থ মস্তিষ্ক সম্পন্ন হওয়া। ৩. ঋণমুক্ত হওয়া। ৪. নেসাব পরিমাণ (সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা বা সমপরিমাণ) সম্পদের মালিক হওয়া। ৫. নেসাব পরিমাণ সম্পদ পূর্ণ একবছর অতিক্রান্ত হওয়া। ৬. জাকাত প্রদানকারী ব্যক্তি প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া।

জাকাতের ক্ষেত্র ও নিসাব: জাকাতের ক্ষেত্র খুবই ব্যাপক। প্রায় সকল প্রকার ধন সম্পদের ওপরই জাকাত ধার্য করা হয়েছে। নগদ অর্থ, সোনা-রুপা, কৃষিজ উৎপাদন, ব্যবসায়ের পণ্য, গৃহপালিত পশুসহ প্রায় সব কিছুই জাকাতের আওতায় আসে। জাকাতের হার শরিয়তের বিধান দ্বারা নির্দিষ্ট। একে মানুষের ইচ্ছাধীন করে দেয়া হয়নি। জাকাতক্ষেত্র অনুযায়ী জাকাত প্রদানের পদ্ধতিও ভিন্ন ভিন্ন। (জাকাত কোনো ক্ষেত্রে ২.৫ ভাগ। কোনো ক্ষেত্রে ৫ ভাগ, কোনো ক্ষেত্রে ১০ ভাগ)। ফকিহগণের সর্বসম্মতিক্রমে স্বর্ণে জাকাতের নিসাব ২০ মিসকাল বা সাড়ে সাত ভরি, তথা ৮৭.৪৫ গ্রাম। এর কম হলে জাকাত দিতে হবে না। কারো নিকট ২০ মিসকাল পরিমাণ স্বর্ণ যদি একবছর অতিক্রম করে তবে তাতে অর্ধ মিসকাল স্বর্ণ জাকাত ওয়াজিব হবে। (নূরুল আনওয়ার, শরহে বেকায়া)। ৫২ তোলা রুপা অথবা ৭.৫০ তোলা সোনা অথবা সমপরিমাণ অর্থ। শর্ত হলো নেসাব পরিমাণ সম্পদ একবছর অতিক্রান্ত হওয়া। উপরিউক্ত নেসাব পরিমাণ সম্পদ যার আছে তার ওপর জাকাত ফরজ। তবে গরু, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বার ক্ষেত্রে জাকাত আদায় পদ্ধতি ভিন্ন। নগদ অর্থ, সোনা-রুপা, ব্যবসায়িক পণ্যসামগ্রী ছাড়াও মহিলাদের অলঙ্কারের জাকাত আদায় করা ওয়াজিব। নাবালেগের সম্পদের জাকাত অভিভাবক আদায় করবেন। ব্যবসায়িক পণ্যে জাকাত আদায়ের ক্ষেত্রে দোকান বা গুদামে মজুতকৃত সব পণ্যের মূল্যমান হিসাব করে জাকাত আদায় করতে হবে। শিল্প-কারখানায় প্রস্তুতকৃত প্রস্ততকৃত পণ্যসামগ্রীর ওপরও জাকাত আদায় ওয়াজিব। অবশ্য কারখানার ভূমি, বিল্ডিং, মেশিনারি, গাড়ি ইত্যাদির ওপর জাকাত ওয়াজিব নয়। আনুমানিক থেকে বরাদ্দের মতো আন্দাজে একটি পরিমাণ নির্ধারণ করে দান করলে জাকাত আদায় হবে না। সম্পদের হিসাব করে পরিমাণমতো জাকাত আদায় করতে হবে।

জাকাতের খাত: জাকাতের খাত হলো আটটি। খাতগুলো হলো : ১. ফকির। ২. মিসকিন। ৩. জাকাতের কাজে নিযুক্ত ব্যক্তি। ৪. মুআল্লাফাতুল কুলুব। ৫. দাসমুক্তি। ৬. ফি সাবিলিল্লাহ। ৭. ঋণগ্রস্ত। ৮. মুসাফির। উপরিউক্ত ৮টির মধ্যে সবচেয়ে প্রাপ্যের অগ্রাধিকার হচ্ছে ফকির ও মিসকিন, অর্থাৎ সমাজের দরিদ্র শ্রেণি।

জাকাতের টাকা একজনকে অথবা খুচরা করে অনেকজনকে দেওয়া যাবে। তবে ১০০ জনকে খুচরা টাকা, শাড়ি-লুঙ্গি না দিয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার মতো করে ব্যবস্থা করে দিতে পারলে (যেমন একটি দুধের গাভী কিনে দিলেন, দোকান করে দিলেন, অন্য কোনো ব্যবসার পুঁজি করে দিলেন) তা দারিদ্র্য বিমোচনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখতে পারে। জাকাতের অন্যতম উদ্দেশ্য হবে কর্মসংস্থান তৈরির মাধ্যমে দারিদ্র্যবিমোচন। এমন প্রক্রিয়ায় জাকাত দেয়া সমীচীন নয় যাতে গরিব গরিবই থেকে যায় এবং প্রতি বছর সে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে। একজন জাকাতদাতা কোনো গরিব ব্যক্তিকে ১০ কেজি চাল বা একটি শাড়ি বা কিছু টাকা বা এই জাতীয় কিছু দিলো, সে কয়েকদিনে টাকা বা চাল শেষ করে দিলো, কাপড়টি সে পরিধান করে পুরনো করে দিলো। ফলে সে গরিবই থেকে গেল। জাকাতের অর্থ দিয়ে কর্মসংস্থান করা উচিত যাতে সে স্বাবলম্বী হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে সংসার পরিচালনা করতে পারে। দরিদ্রকে কী পরিমাণ জাকাত দিতে হবে এ সম্পর্কে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ‘উমর (রা.) বলেন, ‘যখন তোমরা দেবে তখন ধনী বানিয়ে দাও’। পিতা-মাতা-দাদা-নানা-স্ত্রী-সন্তানদের জাকাত দেওয়া যাবে না। মসজিদ ও মাদরাসা ভবন নির্মাণের জন্য জাকাত দেওয়া যাবে না। তবে মাদরাসার এতিম ও গরিব শিক্ষার্থীদের জাকাত দেওয়া যাবে। জাকাত রমজান মাসেই দিতে হবে এমন কোনো কথা নেই। সুবিধামতো অর্থবছর নির্ধারণ করে নিয়ে প্রতি বছর সেই হিসাব মোতাবেক জাকাত আদায় করা যায়। তবে রমজানে দানের সওয়াব যেহেতু বেশি, তাই বেশিরভাগ মুসলমান রমজানে জাকাত আদায় করে থাকেন। জাকাত প্রদানের আগে প্রত্যেকের নিয়তকে বিশুদ্ধ করে নেওয়া জরুরি। নিয়ত শুদ্ধ না থাকলে জাকাত আদায় কবুল হবে না। মহান আল্লাহতাআলা জাকাতের গুরুত্ব অনুধাবন করে সংশ্লিষ্টদের যথযথভাবে জাকাত আদায়ের তৌফিক দান করুন।
লেখক: প্রিন্সিপাল, শ্রীমঙ্গল আইডিয়াল স্কুল, মৌলভীবাজার।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন