বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ঈদ সংখ্যা

গল্পের মতো শোনায় যে সত্য

উবায়দুর রহমান খান নদভী | প্রকাশের সময় : ১ মে, ২০২২, ১২:০১ এএম

গুলশান দুইয়ের একটি দামি রেস্তোরাঁয় খানা খেতে বসেছি আব্বা আর আমি। সম্ভবত ১৯৯২ সালের কথা। জরুরি কাজে সেদিকে গিয়েছিলাম। খাওয়ার সময় পার হয়ে যাচ্ছিল তাই রেঁস্তোরায় বসি। আব্বা তখন জাতীয় সংসদ সদস্য। দেশের খ্যাতিমান আলেম ও ইসলামী মনীষী। খ্যাতির বিড়ম্বনা সারা জীবনই তার সাথ দিয়েছে। যেখানেই গেছেন কেউ না কেউ চিনে ফেলেছেন। পরিচিত, সঙ্গী, ছাত্র, ভক্ত, কর্মী, সমর্থক, ভোটারদের সাথে দেখা হয়ে গেছে। আমাদের পারিবারিক কাজকর্ম বাদ দিয়ে দর্শনার্থীদের সময় দিতে হয়েছে। কখনো খুশি হয়েছেন, ভালো লেগেছে, কোনো কোনো সময় ভারও বোধ হয়েছে।

খানার অর্ডার দিয়েছি। কম করে হলেও আধ ঘণ্টা লেগে যায় এদের খানা প্রস্তুত করে পরিবেশন করতে। সবার আগে স্যুপ দিয়ে গেল ওয়েটার। আমরা স্যুপ খাচ্ছিলাম। আব্বা লক্ষ করলেন, ঝকঝকে তকতকে দামি রেস্তোরাঁটির সামনে কাঁচের বাইরে একটি ছোট্ট শিশুর হাত ধরে একজন বৃদ্ধ লোক দাঁড়িয়ে। দেখে মনে হলো তারা সাহায্যপ্রার্থী। শিশু ও বৃদ্ধ মানুষটি হাতের ইশারায় রেস্তোঁরার ভেতর আব্বাকে দেখিয়ে কী যেন বলছিল। আমি কিছু বোঝার আগেই আব্বা দরজা ঠেলে বাইরে চলে গেলেন। আমি ওয়েটারকে স্যুপ খাওয়া শেষ হয়নি বলে, হন্তদন্ত হয়ে পিছু ছুটলাম। আমি পৌঁছার আগেই আব্বা ওই বুড়ো মানুষটির কাছে গিয়ে তার কথা শুনে ভেতরের দিকে আসতে শুরু করেছেন। টেবিলে বসে আমাকে বললেন, আমাদের জন্য প্রস্তুত খাবারগুলো প্যাক করে দিতে বলো। আমি কিছু না বুঝেই ওয়েটারকে তা বললাম। রাইস, চিকেন ফ্রাই, মাটন, ভেজিটেবল ইত্যাদি প্রস্তুত করে আনা হলো। আব্বা আমাকে বললেন, ‘এ ব্যাগটি বাইরের ওই বাচ্চাটির হাতে দিয়ে আয়।’ আমি আব্বার কথামতো তাই করলাম। সাথে সাথে আবার নতুন করে অর্ডার দিতে চাইলে আব্বা বললেন, শুধু স্যুপটুকু খেলে যদি তোর চলে, তাহলে আর খানার দরকার নেই। চল আমরা ঘরে ফিরেই খাব।

আমি বিল মিটিয়ে আব্বাকে নিয়ে বের হলাম। তিনি একটি পান মুখে দিয়ে আমাকে নিয়ে রিকশায় বসলেন। কথা বলতে বলতে আমরা চলছি। জানতে পারলাম, বুড়ো লোকটি নাকি আব্বাকে বলেছিল, এ রেস্টুরেন্টের সামনে তারা প্রায় দিনই ভিক্ষা করে। এ শিশুটি তার নাতি। সে সব সময়ই এসব খাবার বাইরে থেকে দেখে, কিন্তু খেতে পায় না। আজ নাকি সে তার দাদাকে বলেছে, এই মানুষটিকে খুব ভালো মনে হয়। দাদা, তুমি যদি তাকে বলতে, তাহলে তিনি হয়তো আমাকে এসব খাবার কিনে দিতেন। তারা এসব কথা বলার সময়ই সম্ভবত আব্বার চোখ সেদিকে গিয়েছিল। শিশুটি তার দিকে ইশারা করায় তিনি ব্যাপারটি বোঝার জন্য স্যুপ রেখে বাইরে ছুটে গিয়েছিলেন।

আমি এসব শুনে খুব সহজভাবে নিলাম। কারণ, এমন দৃশ্য আমার চোখে নতুন নয়। এর বহু বছর আগে একবার কিশোরগঞ্জ জামিয়া মার্কেটে বেশ কয়েকজন আলেম, ছাত্র, ভক্ত ও সমর্থক পরিবেষ্টিত হয়ে বসা ছিলেন আব্বা। আমিও বাড়ি গিয়েছিলাম বলে সে মজলিসে শরিক ছিলাম। একজন বলল, হুজুর কিছু আনাব?

বললেন, কী আনবে? কী আছে এখানে খাওয়ার মতো?
অন্য একজন বললেন, নতুন কিছু আইটেম এসেছে অমুক দোকানে।

শুনে আমি গেলাম সেখানে। অনেকগুলো স্যান্ডুইচ, পিজা, বার্গার ইত্যাদি আনলাম সবার জন্য। সমপরিমাণ জিনিস ও স্পেশাল কিছু আইটেম বাক্স ভরে এনে আব্বার পাশে রাখলাম। আব্বা বললেন, সবার জন্য যা এনেছিস এতেই তো হতো। আলাদা এত বড় বাক্স ভরে কী আনলি আবার?
বললাম, এখানে আপনি আর কতটুকু খেতে পারবেন। আম্মা আর আপনার জন্য আলাদা করে আনলাম। বাসায় নিয়ে যাব।

একটু পর একজন গরিব মহিলা দুটি ছেলে-মেয়েসহ এসে কিছু চাইল। এ সময় সবেমাত্র আমরা সবাই মিলে খাবারগুলো খেতে শুরু করেছি। কেউ একজন মহিলাটিকে চলে যেতে বললেন। আরেকজন সামান্য টাকাও দিলেন। আব্বা খেয়াল করলেন, শিশু দুটি তাদের মায়ের কাছে কিছু খেতে চাইছে। মা তাদের দিকে চোখ রাঙিয়ে একটা ধমক দিয়ে বাচ্চা দুটিকে জোর করে দূরে সরিয়ে নিতে লাগল। বাচ্চারা যেতে চায় না। আব্বা আমাকে কানে কানে বললেন, ‘এই বাক্সটি ওই বাচ্চা দুটিকে দিয়ে দে।’ বাক্সটি আমি ওই মায়ের হাতে তুলে দিলাম। বললাম, নীরবে এক জায়গায় বসে আপনি বাচ্চাদের নিয়ে এগুলো খেয়ে নিন।
আব্বা-আম্মার জন্য আমার পছন্দ করে কেনা সেরাটুকুই এদের হাতে তুলে দিতে আমার একটুও অস্বস্তি লাগেনি।

কারণ, আব্বার মনোভাবটি আমি জানতাম। তাকে আমি খুব চিনতাম। এতে বরং আমি অন্যরকম এক আনন্দ ও তৃপ্তি অনুভব করেছি। আব্বা নিজের বড় পুত্রের দেওয়া সযত্ন উপহার খুব পছন্দ করতেন। নিজের পছন্দের বস্তুই সেরা, সফল ও বুদ্ধিমান লোকেরা আল্লাহর রাস্তায় বিলিয়ে দিতে পছন্দ করেন। এমন অসংখ্য ঘটনা আমাদের পিতাপুত্রের জীবনে রয়েছে। এখনো আব্বার কথা মনে পড়লে এসব চিত্র ও দৃশ্য চোখে ভাসে আর একা একা থাকলে এসব পুণ্যস্মৃতি রোমন্থন করে আমিও নয়ন জলে ভাসি। ভাবি, আব্বা এমন হবেন না কেন। তিনি তো আমার দাদা-দাদুরই সন্তান। তারাও তো যতদিন দেখেছি, এভাবেই জিন্দেগি গোজরান করেছেন। দাদুর কথা মনে পড়লে এখনো কেঁদে বুক ভাসাই। এ মানুষটি কত যে ভালো মানুষ ছিলেন, তা বলে বোঝাতে পারব না।

তখনও আমি রাজধানীতে ফ্ল্যাটবাসী হইনি। খোলামেলা বাসায় থাকতাম। কিশোরগঞ্জে আমাদের বাসাটি ছিল আগের যুগের। দরজা-জানালা মানুষের নাগালের ভেতরে ছিল। কোনো প্রয়োজনে মানুষ আসতে, ডাকতে ও পৌঁছতে পারত। দেশেও তখন অভাবী মানুষ অধিক সংখ্যায় ছিল। প্রতিদিনই দরজায় কোনো-না-কোনো মানুষ হাঁক দিত। কিছু চাইত। বিশেষ করে স্বাধীনতা-উত্তর ৫/৭ বছর খাবারের জন্য মানুষ ঘরে ঘরে যেত। আমাদের বাড়িতে আসা কোনো ভিখারিকে পারতপক্ষে ফিরিয়ে দেওয়া হতো না। টাকা, চাল, কিংবা রান্না করা খাবার যতটুকুই সম্ভব দেওয়ার চেষ্টা করা হতো।

অনেক সময় এমন হতো, কেউ চারটে ভাত খেতে চেয়েছে। আর ঘরে রান্না খাবার নেই। হয় তৈরি শেষ হয়নি অথবা সবার খাওয়া-দাওয়ার পর শেষ হয়ে গিয়েছে। তখন গ্যাসের চুলা ছিল না, ছিল লাকড়ির চুলা। ফ্রিজও তখন ঘরে ঘরে ছিল না। যাদের ছিল সেটিও ছোট-খাটো এবং জিনিসে ঠাসা। তো আমরা শত শতবার এমন দেখেছি যে, আমার দাদু নিজে খেতে বসার সময় কোনো ভিক্ষুক দু-মুঠো খাবারের জন্য হাঁক মারল, তিনি সাথে সাথে হাত গুটিয়ে নিলেন। পাতের মাখানো ভাতগুলোই শেষ। ডিশের ফ্রেশ ভাত, তরকারি, ডাল দিয়ে দিচ্ছেন ওই মানুষটিকে। নানা যুক্তিতে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেও আমরা তার এ কর্মপন্থা বদলাতে পারিনি। ‘টাকা দিয়ে দাও কিংবা চাল দিয়ে দাও’ বললেও দাদুর মন মানত না। বলতেন, ক্ষুধার্ত মানুষ, টাকা আর চাল দিলে কখন সে খানা পাবে আর খাবে। খানা পানি খেয়ে তৃপ্ত হোক। সাথে কিছু টাকা ও চালও দিয়ে দাও। বাড়ি গিয়ে আবার খেতে পারবে।

দুর্ভিক্ষের সময় আমার দাদু এভাবে ছেঁড়া কাপড় পরা কোনো নারীকে দেখলেও শাড়ি-কাপড় দিয়ে দিতেন। বহুবার নিজের জন্য তুলে রাখা সব শাড়ি অভাবি মানুষকে দিয়ে ফেলেছেন। দু-চারটি শাড়ির বেশি হলেই তিনি তা দান করে দিতেন। কেউ চাওয়ামাত্রই বিনা হিসাবে নিজের সব টাকা-পয়সা তাদের দিয়ে দিতেন। জমির আয় ও বাড়ি ভাড়ার টাকা, আব্বার টাকা সবই দাদু বাতাসের গতিতে অভাবী মানুষের মাঝে বিলিয়ে দিতেন। আমি এজন্য দাদুকে হৃদয় থেকে শ্রদ্ধা ও পছন্দ করতাম। অন্তর দিয়ে ভালোবাসতাম। অবশ্য তার মতো উদারহস্ত আমিও হতে পারিনি। নিজে না খেয়ে মানুষকে খাওয়ানো, নিজের জন্য না রেখে সব টাকা-পয়সা মানুষকে দিয়ে দেওয়ার কথা কিতাবে পড়েছি আর আমার মুরুব্বীদের জীবনে দেখেছি। এমন কাজ নিজে করা সহজ নয়।

খাওয়া-দাওয়া বা পানাহারের ব্যাপারে পবিত্র ইসলামের যে নির্দেশনা তা অনেক ক্ষেত্রেই মানুষ পালন করে না। মুসলিম সমাজে এ ব্যাপারে উদাসীনতা ব্যাপক। দুনিয়ার উন্নত দেশসমূহে সাধারণত মানুষ খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে যে নিয়ম-নীতি অনুসরণ করে তা অনেকটাই ইসলামের সাথে মিলে যায়। সচেতন মুসলমান এবং আল্লাহর নেক বান্দারা পানাহারের ব্যাপারে সুন্নতের নির্দেশনা পালন করে থাকেন। এ বিষয়ে আমাদের আলাদা লেখা রয়েছে। এ লেখাটি ইসলাহী দৃষ্টিকোণ থেকে কিছু বাস্তব ইতিহাস, ঘটনা ও অভিজ্ঞতা থেকে তৈরি। গল্পের ভেতর থেকে আনন্দ বা অনুভূতি নেওয়া পর্যন্তই সীমাবদ্ধ না থেকে আমরা যেন এর ভেতরকার বার্তাটি গ্রহণ করতে পারি।

অনেকেই জানেন, আমার জন্মস্থান কিশোরগঞ্জ। জীবনে প্রথম ১৫/১৬ বছর আমার সেখানেই কাটে। খুব ছোট বেলা আমাদের শহরেই এক মুরুব্বী পর্যায়ের ব্যক্তি ইন্তেকাল করেন। তিনি ও তার পরিবার আমাদের খুব পরিচিত ছিলেন। তার মৃত্যু উপলক্ষ্যে কোনো একদিন তার পরিবারের লোকেরা আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও চেনা-জানা লোকজনের জন্য বাসায় একটি খানার আয়োজন করে। তাদের দাওয়াতে যাওয়ার বিশিষ্ট লোকদের মধ্যে শহরের শীর্ষ ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন আমার দাদাজান ও আব্বা। দাদা যে-কোনো বিষয়ে খুব স্পষ্টবাদী ছিলেন। শরীয়তবিরোধী কাজে তার প্রতিবাদ তার ব্যক্তিগত নম্র চিত্ততার সাথে মিলত না। সুন্নতের খেলাফ কোনো কাজ দেখলে দাদা এভাবেই রেগে যেতেন যে, কোনো ব্যক্তি তার স্বাভাবিক মমতাপূর্ণ আচরণ আগে না দেখে থাকলে সে ধারণাই করতে পারবে না যে, মানুষটি ইচ্ছে করলে এভাবে রাগও করতে পারেন।

রাগ বা ক্রোধ মানুষের মধ্যে থাকেই। এটি সম্পূর্ণ নাই হয়ে যাওয়া ইসলাম সমর্থন করে না। আবার অতিরিক্ত ক্রোধ বা রাগও ইসলামে কাম্য নয়। নিয়ন্ত্রণহীন রাগ শয়তানের পক্ষ থেকে হয়ে থাকে। সেজন্য রাগ দমনের নির্দেশ ও পরামর্শ শরীয়ত দিয়েছে। ব্যক্তিগত কারণে রাগ না হওয়া উত্তম। আল্লাহর জন্য রাগ হওয়া উত্তম। শরীয়ত নির্দেশিত স্থানে ক্রোধ ও রাগ থাকা অপরিহার্য। আমার দাদাজানের চরিত্রে এসব গুণ ভারসাম্যের সাথে পাওয়া যেত। এজন্যই তিনি সর্বজনমান্য বড় আলেম ও দরবেশ হিসেবে স্বীকৃত ছিলেন।

সমাজের কুসংস্কার ও রসম-রেওয়াজ দূর করা ছিল তাঁর সারা জীবনের মিশন। দাদা স্পষ্ট ভাষায় এ দাওয়াত কেবল ফিরিয়েই দেননি, আয়োজকদের পরিষ্কার মানা করেছেন এমন অনুষ্ঠান করতে। আব্বা কোনো কারণ দেখিয়ে অন্য সব অপছন্দনীয় দাওয়াতের মতোই এটিও এড়িয়ে গেছেন। আমি এ বিষয়টি না বুঝে বন্ধু-বান্ধবের সাথে এই দাওয়াতে চলে যাই। তখন আমার বয়স ৭/৮ বছরের বেশি হবে না। যখন বাসায় ফিরি তখন আম্মা বিষয়টি জানতে পেরে মোটামুটি ঘটনাটি চেপে যান। শেষ পর্যন্ত ঘটনা চাপা থাকেনি। অন্য কারও মাধ্যমে এটি দাদার কানে চলে যায়। তখন দাদা আমাকে ডেকে সংক্ষেপে বলে দেন যে, নাসিম, তুমি কেন বুঝলে না। যে দাওয়াতে আমি এবং তোমার আব্বা গেলাম না, সেটা যে যাওয়ার মতো নয় এ বিষয়টি তোমার বোঝে আসল না কেন?

আমি দাদার সামনে এ নিয়ে আর কথা বললাম না। লজ্জায় মাথা নিচু করে রইলাম। দাদু এসে আমাকে উদ্ধার করলেন। আর বললেন, ছোট মানুষ, বন্ধুদের সাথে চলে গিয়েছে। তা ছাড়া ওরাও তার পরিচিত। ভবিষ্যতে আর এমন হবে না।

কথাটি রাত পর্যন্ত আব্বার কানেও পৌঁছল। ধারণা করি, দাদার বিরক্ত হওয়ার ঘটনাটি কেউ আব্বার কান পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে থাকবে। এমনও হতে পারে, গল্পচ্ছলে আম্মাই আব্বাকে বলে দিয়েছেন। রাতের খানার সময় আব্বার সাথে দেখা। তিনি শুধু বললেন, মৃত ব্যক্তির জন্য আয়োজিত অনুষ্ঠানের খানা খাওয়া ভালো না। বড় হলে সব বুঝবে। একটি কথা আছে, তআমুল মাইয়্যিতি ইউমিতুল ক্বলবা। মানে, মৃত ব্যক্তির উপলক্ষ্যে আয়োজিত খানা খেলে মানুষের অন্তর মরে যায়।

আব্বা ও দাদার এটুকু উপদেশই আমার জন্য সারা জীবনের আচরিত নীতিতে পরিণত হয়। আর এমন শত শত ঘটনা জীবনে আছে, যা শুধু আমাকে বলে দেওয়া হয়েছে। বাকি চার ভাই চোখ বুজে এটাকেই অনুসরণ করেছে। আর বর্তমানে ছেলে ভাতিজারাও এ নীতির ওপরই বেড়ে উঠছে। এ কথাগুলো লিখে রেখে যাচ্ছি, যাতে পরবর্তী বংশধর এবং অন্য ভাই-বন্ধুরাও এ থেকে শিক্ষা নিতে পারে। একবার এর ২/৪ বছর পর আমি কারও সাথে এক গ্রামে বেড়াতে যাই। সেখানে থাকাবস্থায় কোনো এক বিশিষ্ট ব্যক্তির মৃত্যু উপলক্ষ্যে বিশাল মেলার আয়োজন হয়। আমি যাদের বাড়ি গিয়েছিলাম তারা-সহ গ্রামের প্রায় সব মানুষ মেলায় যোগ দিতে যায়। দাদা ও আব্বার উপদেশের কথা মনে করে আমি সেই মেলায় যাওয়া থেকে বিরত থাকি। এরপর বাকি লোকজন ফিরে এসে বিশাল এই মচ্ছবের কথা বর্ণনা করে শোনায়। অনেকগুলো গরু জবেহ করে কয়েক গ্রামের মানুষকে খানা খাওয়ানো হয়েছে। এটি গরিবের জন্য সদকা বা মৃতের রুহে সওয়াব পৌঁছানোর উসিলাস্বরূপ করা হয়নি। সমাজের রীতি ও নিজেদের খুব ধনী মানুষ প্রমাণ করতে করা হয়েছে।

ছাত্রজীবনে একবার এক শিক্ষক ও কয়েকজন সহপাঠীর সাথে আমিও এক জায়গায় দাওয়াত খেতে যাই। এ সময় আমি দশ কি বারো বছরের। বয়সে ছোট হলেও মাসআলার কিতাব পড়া শুরু করেছি। যে বাড়িতে সবার সাথে গিয়েছি তাদের আমি চিনতাম। বাড়ির মূল ব্যক্তিটি কিছুদিন আগে মারা গিয়েছেন। তার অনেকগুলো ছেলে-মেয়ে। দেখে যা বুঝলাম, এক-দু জন হয়তো প্রাপ্তবয়স্ক। বাকি সবাই শিশুবয়সি। আমি কোনো একটি কারণ দেখিয়ে বাসায় ফিরে এলাম। পরদিন অন্যদের বললাম, ইসলাম জ্ঞানভিত্তিক জীবনবিধান। শরীয়তের হুকুম ছাড়া এখানে রীতি-রেওয়াজের দোহাই দিয়ে যা ইচ্ছা করা যায় না। যে বাড়িতে অপ্রাপ্তবয়স্ক ওয়ারিশ থাকে সেখানে সবকিছু স্পষ্টভাবে না জেনে কোনো পানাহার করা যায় না। মৃত ব্যক্তির খানা এমনিতেও পরিত্যাগ করা ভালো। আর নাবালক শিশুদের সম্পদ থেকে কেউ দাওয়াতে ব্যয় করা যেমন নিষেধ, কারও পক্ষে এমন দাওয়াত খাওয়াও জায়েযের পর্যায়ে থাকে না। বিষয়টি নিয়ে সেই শিক্ষক ও সহপাঠীরা খুব ভাবনায় পড়লেন। একসময় কৌশলে ওই বাড়িতে ভালো অংকের কিছু বিনিময় উপহার হিসেবে পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম।

এর কিছুদিন পর দাদার সাথে ময়মনসিংহ বেড়াতে যাই। একটি দ্বীনি সফরে তিনি সেখানে যান। বড় বড় মাদরাসায় প্রোগ্রাম হয়। কোনো কোনো স্থানে ওলামায়ে কেরামের ঘরোয়া মজলিস হয়। সে সময় আমাদের এক আত্মীয় সাম্প্রতিককালে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। দাদা সে বাসায় অল্প সময়ের জন্য যান। এমন সময়টি বেছেই তিনি গিয়েছিলেন যখন কোনো খাওয়া-দাওয়ার সময়ও না এবং দ্রুত আয়োজন করাও সম্ভব নয়। সে আত্মীয়ের অনেকগুলো শিশুসন্তান আছে, তা আমরা জানতাম। দাদা সাথের লোকজনকে পাঠিয়ে অনেকগুলো খাদ্রসামগ্রী কিনে নেন। সে বাসায় সৌজন্যবশত আমরা চা, বিস্কুট, কলা ও কেক দিয়ে নাশতা করতে বাধ্য হই। ফেরার সময় দাদা অপ্রাপ্তবয়স্ক সব শিশুকে ভালো পরিমাণ টাকা হাদিয়া দিয়ে আসেন। পথে তিনি আমাকে বলেন, ‘এ ধরনের সামাজিকতায় জায়েয-নাজায়েযের প্রতি খুব খেয়াল করে চলতে হয়। তাদের মনে কষ্টও দেওয়া যাবে না। সামনে চা-নাশতা নিয়ে এলে না খাওয়াও কঠিন আর এমন পরিবারে কিছু খাওয়াও সম্পূর্ণ নিষেধ। কারণ, ছোট শিশুরা এ বাড়ির সম্পত্তির ভাগিদার। তবে তাদের এ সম্পত্তি তারা প্রাপ্তবয়স্ক ও বুঝদার না হওয়া পর্যন্ত কাউকে দিতে সক্ষম নয়। আর আমাদের সমাজে সচেতন আলেম ও শিক্ষিত দ্বীনদার লোক ছাড়া এমন পরিবারে সামাজিক ব্যয় কোন পদ্ধতিতে করা যায় বা করতে হয়, তা প্রায় লোকই জানে না। এ বিষয় খেয়াল করো। পড়ালেখা করে ভালো আলেম হও। পাশাপাশি মানুষকে সচেতন করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাও। নিজে কঠোরভাবে এ বিধানের ওপর আমল করবে।’

একবার আমি দাদার সাথে এক বিয়ের দাওয়াতে গিয়েছি। সে সময় চেয়ার-টেবিলে সহজে আলেম-ওলামারা বসতেন না। তারা নিজেদের পরিবেশে যেভাবে সুন্নতের নিকটবর্তী অবস্থায় পানাহার করতে সচেষ্ট থাকেন, দাওয়াতে গেলেও সেটাই চাইতেন। সব মানুষকে চেয়ার-টেবিলে খানা দিলেও দাদার জন্য এক রুমে বিছানায় দস্তরখান বিছিয়ে খানার ব্যবস্থা করা হলো। সম্ভবত দুয়েকজন আরও ছিলেন। প্রথমে আগেকার সময়ের নিয়মে শরবত, পিঠা, সেমাই, পায়েস ইত্যাদি দেওয়া হলো। কিছুক্ষণ পরই আনা হলো মূল খানা। আমি খুব ধীরে ধীরে পিঠা, সেমাই খেয়ে পরে আর খানা খেতে পারলাম না। খুব ছোট ছিলাম। তাই বাসায় এসে দাদুকে বললাম, খাওয়ার আগে পিঠা, সেমাই, পায়েস কেন দিল? এসব না খেলে তো আমি খানা খেতে পারতাম।

তখন দাদু আমার খাওয়ার ব্যাপারে খেয়াল না রাখার অভিযোগ তুলে দাদাকে চাপে ফেলে দেন। বলেন, আপনি ওকে বলে দিলেন না কেন যে, পিঠা, পায়েস তুমি খেয়ো না। আর খেলেও খুব সামান্য খাও। কারণ পরে সাথে সাথে খানা খেতে হবে। দাদা এমনিতেই খুব আফসোস করছিলেন। দাদুর চাপে আরও নরম হয়ে গেলেন। আমি মূল দাওয়াতটি খেতে পারিনি এটা দাদা-দাদু কেউই মেনে নিতে পারছিলেন না। তখন দাদা একটি হাসির গল্প বলেছিলেন।

বলেছিলেন, এক দাদা আর তার নাতি গিয়েছে দাওয়াত খেতে। নাতিটি খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে বার বার পানি খাচ্ছিল। খাওয়ার পর বাড়ি এসে দাদা নাতিকে একটি থাপ্পড় দিয়ে বললেন, বোকার মতো বার বার পানি খাচ্ছিলে কেন? পানিতেই তো পেট ভরে গেছে। খাবার খেলে কোথায়?

নাতি জবাব দিল, আমি আপনার চেয়ে আরও বেশি খেয়েছি। বেশি খাব বলেই তো পানি দিয়ে আমি গলা পরিষ্কার করছিলাম। আর ভালো করে খানা খেয়ে পেট ভরছিলাম।
জবাব শুনে দাদা আরও জোরে একটি থাপ্পড় দিলেন নাতিকে। বললেন, এ বুদ্ধিটি তুই আমাকে দিলি না কেন? স্বার্থপর কোথাকার।

গল্পটি শুনে দাদু অনেক্ষণ হাসলেন। দাদা-দাদুর উভয়েরই মনটা অনেকটা হালকা হয়ে গেল। এ কথাটি আমি ভুলে গিয়েছিলাম। কিন্তু দাদা ভোলেননি। এর কিছুদিন পর শহর থেকে একটু দূরে আমাদের এক আত্মীয়ের বিয়েতে দাদার সাথে আমিও যাই। দাদা তখন জিপ চালিয়ে নেওয়া দাদার এক খাদেমকে বললেন, তুই নাসিমকে সাথে নিয়ে বস। তাকে তার সুবিধামতো ধীরে ধীরে সময় নিয়ে সব আইটেম খাওয়াবি।

আমি এই ড্রাইভার কাম খাদেমকে কাকা ডাকতাম। বলতাম কাক্কু। খুব মিশুক ও ভালো লোক ছিলেন। দাদার ছাত্র ছিলেন। লেখাপড়া শেষ করেননি। দাদাই তাকে গাড়ি চালনাসহ কিছু কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা করে দেন। কাক্কু সেদিন আমাকে দাওয়াত খাওয়ার নিয়ম অনুশীলনের মতো করে শিখিয়ে দেন। এখনো কোথাও খানা খেলে সেদিনটির কথা মনে পড়ে।

মফস্বল শহরের প্রভাবশালী ব্যক্তির বিয়ের খানা। শত শত লোক খাওয়া-দাওয়া করছে। আমরা দাদার সাথে তার খাস কামরায় খেতে বসেছি। দাদা সারা জীবনই মিতাহারী ছিলেন। নিজের মতো করে পানাহার করতেন। সামনে সব রাখা হলে নিজে পছন্দমতো দুয়েক লোকমা খেয়ে উঠে পড়তেন। কেউ কিছু দেওয়ার বা বলার সুযোগ ছিল না। আমাদের খানার ব্যাপারে কোনো হস্তক্ষেপ না করেই নীরবে তিনি আমাদের সব ভাইকে খানার নীতি, নিয়ম ও আদব শিখিয়েছেন। বিসমিল্লাহ বলে খাওয়া। ডান হাতে খাওয়া। একসাথে খেলে নিজের পাশ থেকে নেওয়া। ভিন্ন আইটেম হলে অন্য দিকে হাত বাড়ানো। নিজে কম এবং অপেক্ষাকৃত সাধারণ খানা নেওয়া। অপর শরিককে বেশি এবং উত্তম খানা খাওয়ার সুযোগ দেওয়া। খাওয়ার সময় মুখে কোনো শব্দ তৈরি না করা। ঢেঁকুর কখনো না তোলা। সম্ভব হলে হাঁচি চেপে যাওয়া। অগত্যা দিতে হলে মুখ ঘুরিয়ে রুমাল বা হাত মুখে রেখে সতর্কভাবে দেওয়া। হাঁচির পর সম্ভব হলে ভালো করে কুলি করে আবার খাওয়া শুরু করা। খাওয়ার শুরুতে বা শেষে দস্তরখানের ওপর পাত্র রেখে হাত না ধোয়া। সবকিছু ডান হাতে ধরা। যদি গ্লাস, চামচ ইত্যাদিতে খানা লেগে অন্যদের কষ্টের সম্ভাবনা থাকে, সে পরিবেশে বাম হাতে ধরে ডান হাতে সাপোর্ট নেওয়া ইত্যাদি তিনি এমনভাবে আমাদের সবাইকে শিখিয়েছেন যে, আমরা টেরই পাইনি।

দাদা সারা জীবন খানার সময় তিন আঙুল ব্যবহার করতেন। শুধু তরকারি দিয়ে ভাত খাওয়ার সময় পাঁচ আঙুল এমনভাবে ব্যবহার করতেন যে, আঙুলের অর্ধেকের বেশি খানায় লাগত না। খাওয়ার পর তিনি হাত ধুতেন বটে তবে তার খুব বেশি পানির প্রয়োজন হতো না। সাবান ব্যবহারের বলতে গেলে প্রয়োজনই হতো না। সেদিন পোলাও থেকে শুরু করে আলু ভাজি, কোরমা, মুরগি, গরু ও খাসির তরকারি, মাছ, মুড়িঘণ্ট, লাউ দিয়ে মাছ, ডাল, ফিরনি, দই ইত্যাদি সব একটু একটু করে কাক্কু আমাকে খাওয়ান। সব মিলিয়ে আমার পরিমাণমতো খানাই হয়। তবে কোনো আইটেম বাদ পড়েনি। এর পর থেকে আমি দাওয়াতে গেলে এক চিমটি হলেও সব আইটেম নেওয়ার চেষ্টা করেছি। কেন জানি মনে এ খেয়ালটি আসে, যতগুলো আইটেম তৈরি করা হয়েছে, সবগুলোই খেয়ে না হলেও অন্তত চেখে দেখার একটি দায়িত্ব মেহমানের ওপর এসে যায়। আল্লাহর বান্দা হিসেবে তাঁর প্রেরিত ও দস্তরখানে সমবেত রিযিক কোনোটাই একটুও ছুঁয়ে না দেখাটা ভালো লাগে না। সামান্য একটু খানা নষ্ট করাও আমাদের বাড়ির সংস্কৃতিতে ছিল না। পরবর্তী জীবনে দুনিয়ার বহু দেশে অসংখ্য সমাজ ও সংস্কৃতিতে হাজার রকম দাওয়াতে অংশগ্রহণের সুযোগ আল্লাহ তাআলা দিয়েছেন। খানা নষ্ট কিংবা অপচয় করার বহু পরিবেশও সামনা করতে হয়েছে। কিন্তু বাড়ির এ সুন্দর সংস্কৃতিটি আলহামদুলিল্লাহ কোথাও হাতছাড়া করিনি।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
Syeda Bilqis ১ মে, ২০২২, ৫:১৭ এএম says : 0
প্রত্যেকের উচিৎ সামগ্রিকভাবে নবীর সুন্নতকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করা। এতেই প্রকৃত কল্যাণ নিহিত।
Total Reply(0)
Mohammed Rezaur Rahman ১ মে, ২০২২, ৫:১৭ এএম says : 0
নবী-রাসুল জগতের শ্রেষ্ঠ মানুষ। তাঁদের জীবনাদর্শও শ্রেষ্ঠ। রহমাতুল লিল আলামিন, বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত, মানবজাতির সর্বোত্তম আদর্শ, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানবের জীবনের প্রতিটি কাজই সবার অনুকরণীয়। তাঁর অনুপম আদর্শ এবং তাঁর জীবনের ব্যবহারিক ও প্রায়োগিক দিকগুলো সমাজ ও সভ্যতার জন্য পরম উপকারী এবং মানুষের ইহকালে ও পরকালে মুক্তির দিশারি।
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন