রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বাংলাদেশ সচিবালয়। গুলিস্তান জিরো পয়েন্ট থেকে গনি রোড ধরে শিক্ষা ভবন। দু’পাশে সচিবালয়ের মতোই রয়েছে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ সরকারি অফিস। বিভিন্ন প্রয়োজনে এসব অফিসে মানুষের যাতায়াত। দিনের অধিকাংশ সময়ই রাস্তাটিতে থাকে ঠাঁসা যানজট। নিষিদ্ধ হলেও হরদম চলে রিকশা। তবে বেশির ভাগই প্রাইভেট কার। জ্যাম বা সিগন্যালে গাড়ি থামলেই দু’পাশের গ্লাসে ঠক ঠক আওয়াজ। খালারে কয়ডা ট্যাহা দ্যান বাজান ! খালা ভাত খাইয়া দোয়া করবো। খালারে কিছু দ্যান..! সাড়া না দেয়া পর্যন্ত চলতে থাকে তার মায়াভরা মিনতি। এতে কেউ কেউ বিগলিত হন। এ পথের নিত্যযাত্রীদের অনেকে হন বিরক্ত।
তবে এখানকার কোনো ভিক্ষুকের সঙ্গে বিরক্তির প্রকাশ ঘটালে শুনতে হয় ভিক্ষুকদের আশ্রাব্য গালাগাল। অসহায় যাত্রীদের তখন শুনেও না শোনার ভান করে কেটে পড়তে হয় অসহায়নের মতো। সচিবালয়ের সামনের এই টুকুন রাস্তায়ই এরকম দেখা মেলে অন্তত : অর্ধশত ভিক্ষুক। এর মধ্যে কিছু রয়েছে বিকলাঙ্গ, রোগাক্রান্ত, কদাকার মুখাবয়বের। কেউ বয়সের ভারে ন্যূব্জ। কম বয়সী, মাদকাসক্ত এবং শিশু ভিক্ষুকও রয়েছে। আব্দুল গনি রোডের পশ্চিম প্রান্তের সিগন্যাল এবং হাইকোর্ট মাজার গেটে দেখা মেলে বেশ কিছু হিজড়া ভিক্ষুকের।
শুধু আব্দুল গনি রোড নয়। সত্যিকারার্থে ভিক্ষুকদের নির্দিষ্ট কোনো এলাকা নেই। সারা দেশেই রয়েছে ভিক্ষুক। তবে রাজধানীতে ইদানিং আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে ভিক্ষুক-উপদ্রব। বাসা-বাড়ি, আবাসিক এলাকা, মসজিদ গেট, মাজার, গোরস্থান, রাজপথ, দোকান, শপিং সেন্টার, পার্ক, অফিস-আদালত, টার্মিনাল, স্টেশন, হাসপাতাল গেট, ফুটওভার, ফুটপাত, ট্রাফিক সিগন্যাল Ñএমন কোনো জায়গা নেই সেখানে ভিক্ষুকের দেখা মেলে না। গত কয়েক দিন ঢাকার বিভিন্ন স্থান ঘুরে মিলেছে ভিক্ষাবৃত্তির ক্রমঃবিস্তার ও বিড়ম্বনার বহুমাত্রিক চিত্র।
নেকাবে মুখ ঢাকা শাইরুন্নাহার (৫৫)। শাহবাগ মোড়ে ভিক্ষার হাত মেলে ধরেছেন সিগন্যালে পড়া যাত্রীদের কাছে। কথাকথায় জানালেন, ঢাকায় ভিক্ষা করছেন ১৩ দিন ধরে। শরীয়তপুর থেকে এসেছেন তিনি। বাড়তি উপার্জনের আশায় রমজান উপলক্ষে এসেছেন এখানে। দু’ঘণ্টা পর পর স্পট পরিবর্তন করেন। মাগরিবে সময় চলে যান কাটাবন মসজিদের গেটে। ওখানে ইফতারটাও সারা হয়ে যায়। মসজিদে তারাবীহ শুরু হলে হাটতে হাটতে চলে যান নিউ মার্কেট, চাঁদনি চক। রাত কাটিয়ে দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বড় একটি গাছের গোড়ায়। এখন দৈনিক আয় ১২-১৩ শ’ টাকা। ঈদ শেষেই ফিরে যাবেন বাড়ি। ওখানে বিধবা ভাতা পান শাইরুন।
কমলাপুর স্টেশনের ভিক্ষুক বিল্লাল জানালেন (৬৫) অনেক যুদ্ধ করতে হয়েছে এখানে ঠাঁই লাভে। এসেছেন রোজা শুরুর আগেই। যখন কমলাপুর আস্তানা গাড়তে চাইলেন প্রথম তাড়া খান খাঁকী পোশাকের সিকিউরিটি গার্ড। স্থান পরিবর্তন করে অন্যত্র বসতে গিয়েও ঠাঁই হলো না। জায়গাটি আগেই পুরনো ভিক্ষুকদের দখলে। তাদের ১০০ টাকা দিয়ে পজেশন নিতে হয়েছে। আপাত, সুস্থ-সামর্থ বিল্লালের একটি পা ঈষৎ বাঁকা। হাটেন কাৎ হয়ে। ভিক্ষাবৃত্তিতে এটিই তার পুঁজি। বছর দুই হলো ভিক্ষা করছেন। থাকতেন জামালপুর। ওখানে প্রতিবন্ধী ভাতাও পান। নিকটাত্মীয়ের পরামর্শে ঢাকায় ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত হন তিনি।
সত্তরোর্ধ্ব ভিক্ষুক ছমিরন বেওয়ার টার্গেট মার্কেটে আসা ধনী নারী ক্রেতা। রাজধানীর উয়ারি আড়ং সংলগ্ন এলাকাটা তার অধিক্ষেত্র। রমজান মাস ছাড়া শুক্রবারগুলোতে অবস্থান নেন টিপু সুলতান রোড, বনগ্রাম রোডের বিভিন্ন মসজিদের সামনে। ঈদের কেনা-কাটা করতে আড়ংয়ে আসা নারী দেখামাত্র চেহারায় করুণ ভাব নিয়ে হাত পাতেন ছমিরন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার নিশানা ব্যর্থ হয়। যারা তাকে ভিক্ষা দেন তারা ১০/২০ টাকার কমে দেন না। ঈদে তার দৈনিক রোজগার ১৫০০ থেকে ১৮০০ টাকা। ভিক্ষাকেই তিনি পেশা হিসেবে নিয়েছেন।
এভাবে নতুন-পুরাতন মিলিয়ে ভারী হচ্ছে ভিক্ষুকের দল। গত দুই বছর করোনা প্রকোপে সৃষ্টি হয়েছে হাজার হাজার নতুন ভিক্ষুক। দ্রব্য মূল্যের উর্ধ্বগতি নিম্নবিত্তের ক্রয়সীমা অতিক্রান্ত হওয়াও ভিক্ষাবৃত্তির বড় কারণ। ভিক্ষুক নিয়ে হালনাগাদ সরকারি কোনো পরিসংখ্যান নেই। বছর তিন আগে সমাজকল্যাণমন্ত্রী জাতীয় সংসদে জানিয়েছিলেন, দেশে ভিক্ষুকের সংখ্যা আড়াই লাখ। অর্থাৎ জনসংখ্যার শূন্য দশমিক ১৭ শতাংশ মানুষ ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত। কিন্তু বিভিন্ন সংস্থার জরিপ বলছে, এ সংখ্যা ২০ লাখেরও বেশি। এর মধ্যে শুধু রাজধানীতেই ছিল ৫০ হাজারের বেশি। এখন এ সংখ্যা ৩ লাখ ছাড়িযে গেছে। সারা দেশে এখন ভিক্ষুকের সংখ্যা ২০ লাখের বেশি। করোনার প্রভাবে শহরের চেয়ে গ্রামে দরিদ্র সংখ্যা বেড়েছে। দেশের বেকারের সংখ্যা ৪২ শতাংশের বেশি। ভয়াবহ বেকারত্ব থেকেও সৃষ্টি হয়েছে নতুন ভিক্ষুক।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ভিক্ষাবৃত্তিকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছে অপরাধীচক্রও। গ্রামাঞ্চল থেকে বিকলাঙ্গ, শিশু-কিশোরসহ হতদরিদ্র ও বয়োবৃদ্ধ নারী-পুরুষ রাজধানীতে এনে ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োগ করা হচ্ছে। এর পেছনে রয়েছে বিশাল সিন্ডিকেট। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ছত্রছায়ায় চলে এই সিন্ডিকে। সিন্ডিকেটভুক্ত না হয়ে কেউ নির্বিঘ্নে ভিক্ষা করতে পারে না। সিন্ডিকেট অবুঝ শিশুদের কোলে নিয়ে, কখনওবা শারীরিক প্রতিন্ধীদের কাজে লাগিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে বিপুল অর্থ। এমনকি সুস্থ মানুষকেও কৃত্রিম উপায়ে প্রতিবন্ধিত্বের কবলে ফেলে সিন্ডিকেট করছে ভিক্ষাবৃত্তি। সিন্ডিকেটের কর্মীরা বিকলাঙ্গ ভিক্ষুকদের দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট স্থানে বসিয়ে যায়। দিন শেষে ভিক্ষুকদের আবার ডেরায় ফিরিয়ে নেয়।
সিন্ডিকেটের আওতায় ঢাকাতেই দৈনিক গড়ে ২০ কোটি টাকার ভিক্ষা-বৃত্তি হয়। এ হিসেবে মাসে লেনদেন ৬০০ কোটি টাকা। অবাক করা বিষয় হচ্ছে, ভিক্ষুক সিন্ডিকেট পরিচালিত হচ্ছে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায়। সংশ্লিষ্টতা রয়েছে সমাজের প্রভাবশালীদের। যে কারণে ক্রমঃবর্ধমান ভিক্ষাবৃত্তি নিয়ে কারও খুব একটা মাথা ব্যাথা নেই। অথচ দিন দিন এটি বড় এক সামাজিক সঙ্কটে পরিণত হচ্ছে।
ভিক্ষা-বৃত্তি বন্ধ কিংবা নিয়ন্ত্রণে কার্যত : কেউ কাজ করছে না। সামাজিক এই ব্যধি নির্মূলে সরকারি পর্যায়েও নেই দৃশ্যমান উদ্যোগ।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, রাজধানীর ভিক্ষা-বৃত্তি হ্রাসে সরকার নগীরর বেশ কিছু এলাকা ‘ভিক্ষুকমুক্ত’ ঘোষণা করে রেখেছে। বাস্তবতা হচ্ছে, এসব এলাকায় নির্বিঘ্নে চলছে ভিক্ষাবৃত্তি। বিমানবন্দরে প্রবেশপথ, পূর্ব পাশের চৌরাস্তা, বিমানবন্দর পুলিশ ফাঁড়ি ও এর আশপাশ এলাকা, হোটেল রেডিসন সংলগ্ন এলাকা, ভিআইপি রোড, বেইলি রোড, হোটেল সোনারগাঁও ও হোটেল কন্টিনেন্টাল সংলগ্ন এলাকা ও কূটনৈতিক জোনে গাড়ি শ্লো হলেই ঘিরে ধরছে ভিক্ষুক।
২০২০-২১ অর্থ বছরে ঢাকা শহরের ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষিত এলাকাগুলোতে ১৮টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে একবার ১৮০ জন পেশাদার ভিক্ষুককে আটক করা হয়। এর মধ্যে ৭২ জনকে সরকারি আশ্রয় কেন্দ্রে বিভিন্ন মেয়াদে আটক রেখে প্রশিক্ষণ দিয়ে পুর্বাসনের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সেই চেষ্টা পরবর্তীতে ব্যর্থ হয়। ভিক্ষুকদের সেলাই মেশিন, রিক্সা ইত্যাদি কিনে দেয়া হলেও তারা এসব বিক্রি করে ফিরে আসেন পুরনো পেশায়।
মন্ত্রণালয়ের আরেকটি সূত্র জানায়, ভিক্ষা-বৃত্তি রোধ এবং ভিক্ষুকদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে কর্মমুখী করার লক্ষ্যে একাধিকবার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ২০১৩ সালে নেয়া এই উদ্যোগ পরীক্ষা-নিরীক্ষা পর্যায়েই ভেস্তে যায়। ভিক্ষুকদের বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে রাজধানীর অনস্তত ২ হাজার ভিক্ষুককে জরিপের আওতায় আনা হয়। পাইলট কর্মসূচি বাস্তবায়ন পর্যায়ে ১০টি এনজিওকে দায়িত্ব দেয়া হয়।
এনজিওগুলো রাজধানীকে ১০টি জোনে ভাগ করে। ১০ হাজার ভিক্ষুকের ওপর জরিপের মাধ্যমে ডাটাবেজ প্রণয়ন করে। কর্মসূচির পাইলটিং পর্যায়ে ভিক্ষুক পুনর্বাসনে সংখ্যা বিবেচনায় প্রাথমিকভাবে ময়মনসিংহ, ঢাকা, বরিশাল ও জামালপুর জেলাকে নির্বাচন করে জেলাওয়ারি ৫০০ জন করে ২০০০ ভিক্ষুক পুনর্বাসনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এর মধ্যে ময়মনসিংহের ৩৭ জন ভিক্ষুকের মাঝে ১২ জন পুরুষ ভিক্ষুককে একটি করে রিক্সা, ১৭ জনকে ১৭টি ভ্যান ও ক্ষুদ্র ব্যবসার জন্য ৫০০০ করে টাকা করে দেয়া হয়। ৮ জনকে ৫ হাজার করে টাকা দিয়ে কর্মসূচির উদ্বোধন হয়। পরে দেখা যায়, ভিক্ষুকরা রিক্সা এবং ভ্যানগুলো বিক্রি করে ফিরে আসে পুরনো পেশায়। ব্যর্থ হয় সরকারের ‘ভিক্ষুক পুনর্বাসন প্রকল্প’।
আইনের ভাষা : ভিক্ষাবৃত্তি রোধে এখন পর্যন্ত সরাসরি কোনো আইন নেই। এটি নিয়ন্ত্রণ কিংবা পুনর্বাসনের চেষ্টা করা হয় ‘ভবঘুরে নিয়ন্ত্রণ আইন’র আওতায়। যদিও ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধে কাজে আসছে না ভবঘুরে নিয়ন্ত্রণ আইনও। প্রণয়নের ১১ বছর অতিবাহিত হলেও এর কোনো সুফল আসেনি। ২০১১ সালে প্রণীত হয় ‘ভবঘুরে পুনর্বাসন আইন’। অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এ আইনটি এখন পর্যন্ত কার্যকর করা হয়নি। আইনটির পর্যালোচনায় দেখা যায়, ভবঘুরে নিয়ন্ত্রণে আইন থাকলেও পুনর্বাসনের প্রশ্নে রয়েছে অস্পষ্টতা। পেশাদার ভিক্ষুক সংখ্যা বৃদ্ধির এটি বড় একটি কারণ।
‘হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পীস ফর বাংলাদেশ’র চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদের মতে, আইনটি জনগুরুত্বপূর্ণ অথচ অসম্পূর্ণ। খসড়ায় অদূরদর্শিতা রয়েছে। বিধান করা না হলে শুধু আইন কখনো সফলতা আনতে পারে না। নগরবাসী ভিক্ষুকদের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ। অথচ সরকার নাকি কোনো ভিক্ষুকই খুঁজে পাচ্ছে না। সরকারের এ ধরণের দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই অসাধু ব্যক্তিরা ভিক্ষাবৃত্তিতে নিত্যনতুন মাত্রা যুক্ত করছে বলে যোগ করেন এই আইনজীবী।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন