ইসলাম আল্লাহ মনোনীত একমাত্র পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। এতে যেমন রয়েছে মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক সমস্যার সমাধান তেমনি রয়েছে দৈনন্দিন জীবনের সব কার্যাবলির দিকনির্দেশনা। মানুষ যদি তার সব কাজে এমনকি প্রাকৃতিক কর্ম সম্পাদনেও ইসলামী রীতি মেনে চলে তাহলে প্রত্যেকটি কাজের জন্য ইহকালে শান্তি ও পরকালে পুণ্যের অধিকারী হবে। আর ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁর উম্মতকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়েও শিক্ষা দিতে বিস্মৃত হননি- এমনকি শৌচকর্ম সম্পাদনের ক্ষেত্রেও।
বিশিষ্ট সাহাবি সালমান (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রয়েছে, মক্কার কাফের-মুশরিকরা ঠাট্টা করে তাকে জিজ্ঞেস করল, তোমাদের নবী কি তোমাদের সব কিছুই শিক্ষা দিয়েছেন- এমনকি প্রাকৃতিক কর্ম সম্পাদনও! উত্তরে তিনি বললেন, হ্যাঁ। তিনি আমাদের মলমূত্র ত্যাগের সময়ে কিবলামুখী হতে নিষেধ করেছেন এবং ডান হাতে শৌচকর্ম সম্পাদন করতে নিষেধ করেছেন। (মুসলিম : ৬২৯)। শৌচকর্ম সম্পাদনের জন্য এমন নির্জন স্থান বেছে নিতে হবে যেখানে গোপনীয়তা রক্ষা পায় এবং স্বকীয়তা বজায় থাকে। মহানবী (সা.) এর সময়ে সুরক্ষিত টয়লেট না থাকায় তিনি মলমূত্র ত্যাগের আগে দূরে নির্জন স্থানে চলে যেতেন। মুগিরা ইবনে শুবা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) শৌচকর্ম সম্পাদনের ইচ্ছা পোষণ করলে দূরে চলে যেতেন। (নাসায়ি : ১৭; তিরমিজি : ২০)।
টয়লেট বা শৌচাগারে প্রবেশের সময় প্রথমে ডান পা ও পরে বাম পা দিয়ে প্রবেশ করা এবং বের হওয়ার সময় আগে বাম পা এবং পরে ডান পা দিয়ে বের হওয়া সুন্নত। টয়লেটে প্রবেশ এবং সেখান থেকে বের হওয়ার সময় বিশেষ দোআ পাঠ করার বিধান রয়েছে। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) টয়লেটে প্রবেশের সময় বলতেন, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজু বিকা মিনাল খুবুসি ওয়াল খাবায়িস’। অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমি নর ও নারী শয়তান থেকে তোমার আশ্রয় প্রার্থনা করছি। (নাসায়ি : ১৯)। এবং টয়লেট থেকে বের হয়ে বলতেন- ‘গুফরানাকা’ অর্থাৎ তোমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। (আল আদাবুল মুফরাদ : ৬৯৩)।
টয়লেট ব্যবহারের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে কিবলামুখী হয়ে বা কিবলাকে পেছনে রেখে মলমূত্র ত্যাগ করা না হয়। আবু আইয়ুব আনসারী (রা.) কর্তৃক বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, তোমরা শৌচাগারে প্রবেশ করলে কিবলামুখী হয়ে বা কিবলাকে পেছনে রেখে মলমূত্র ত্যাগ করবে না। (বোখারি : ৩৯৪)। বসা অবস্থায় মলমূত্র ত্যাগ করাটাই সুন্নত; তবে বিশেষ প্রয়োজনে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করার অনুমতি রয়েছে। নবী (সা.) একদা কোনো এক সম্প্রদায়ের ময়লার স্তূপের কাছে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করেছেন মর্মে হাদিসে উল্লেখ রয়েছে। (নাসায়ি : ১৯)। পানি অপবিত্র হওয়ার আশঙ্কায় বদ্ধ পানিতে; শয়তানের কুমন্ত্রণার শিকার হওয়ার আশঙ্কায় গোসলের স্থানে এবং জিনদের আবাসস্থল হওয়ায় গর্তের ভেতরে মূত্র ত্যাগ করতে নবী (সা.) নিষেধ করেছেন। (নাসায়ি : ৩৪-৩৬)। অনুরূপভাবে জনদুর্ভোগ এড়াতে মানুষের চলাচলের রাস্তায় এবং জনমানুষের চক্ষু থেকে আড়ালে না গিয়ে মলমূত্র ত্যাগ করতে হাদিসে নিষেধ করা হয়েছে। এছাড়া মলমূত্র ত্যাগের সময় চুপিসারে কারও সঙ্গে কথা বলা এবং একে অন্যের লজ্জাস্থান দর্শন করা অনুচিত। নবী (সা.) এ জাতীয় কাজ থেকে বিরত থাকতে বলেছেন। কেননা এতে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন। (মাজা : ৩৬৬)।
শৌচকর্ম সম্পাদনের সময় বাম হাতের ব্যবহার সুন্নত। আবু কাতাদা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমাদের কেউ শৌচাগারে প্রবেশ করলে ডান হাত দিয়ে ময়লা পরিষ্কার করবে না। (নাসায়ি : ৪৭)। নবী (সা.) এর জামানায় পানি স্বল্পতার কারণে অধিকাংশ সময়ই মলমূত্র থেকে পবিত্র হওয়ার জন্য পাথর জাতীয় বস্তু ব্যবহার করা হতো। এক্ষেত্রে তিনটি পাথরের কম ব্যবহার করতে নিষেধ করা হয়েছে এবং হাঁড় ও গোবরের ব্যবহার থেকে বারণ করা হয়েছে। (মুসলিম : ৬২৯)। বর্তমানে টয়লেট পেপারের সহজলভ্যতার কারণে পাথর বা মাটি জাতীয় বস্তু তেমন একটি ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে না। শৌচকর্ম সম্পাদনের পর হাতকে জীবাণুমুক্ত করার জন্য নবী (সা.) মাটিতে হাত ঘষে নিতেন। (নাসায়ি : ৫০)। আধুনিক স্বাস্থ্য বিজ্ঞানেও টয়লেট ব্যবহারের পর সাবান বা জীবাণুনাশক বস্তু দ্বারা হাত পরিষ্কার করার তাগিদ দেয়া হয়েছে। টয়লেট ব্যবহারের পর অজু করে পবিত্র হওয়া সুন্নাত। নবী (সা.) এর টয়লেটে গমন সংক্রান্ত অধিকাংশ হাদিসেই শৌচকর্ম সম্পাদনের পর তার অজু করার কথা উল্লেখ রয়েছে।
রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, ‘আল্লাহ সুন্দর এবং সৌন্দর্যকে পছন্দ করেন।’ (মুসলিম)। ইসলাম পরিচ্ছন্নতার প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। সুন্দর পরিবেশের জন্য ইসলামের অনুশাসন মেনে চলার বিকল্প নেই। দুর্গন্ধ নয়, সুঘ্রাণ ও সজীবতা ইসলামের দাবি। আল্লাহর রাসূল (সা.) সুগন্ধ, সৌন্দর্য ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ পছন্দ করতেন। এ কথা সত্য যে, দৈহিক রোগ-ব্যাধি থেকে মুক্ত থাকতে হলে দেহকে পরিচ্ছন্ন রাখতে হয়। কাপড়-চোপড় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হয়। পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন পাত্র থেকে পানীয় ও খাবার খেতে হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ পবিত্র এবং তিনি পবিত্রতাকে পছন্দ করেন। তিনি পরিচ্ছন্ন এবং পরিচ্ছন্নতাকে পছন্দ করেন, নিজে সুমহান এবং মহত্ত্বকে পছন্দ করেন এবং তিনি দানশীল, দানশীলতাকে পছন্দ করেন। কাজেই তোমরা (তোমাদের বাড়ির চত্বর) পরিচ্ছন্ন রাখবে।’ (তিরমিজি)।
আজ সাধারণ মানুষ ইসলামের অনুশাসন থেকে যেন ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে। ইসলামের নিষিদ্ধ কাজগুলোর প্রতি বেশি ঝুঁকে পড়ছে। প্রস্রাব-পায়খানার ক্ষেত্রে ইসলামে যেসব বিধি-নিষেধ রয়েছে তার প্রত্যেকটি পালনে মানুষের মাঝে যথেষ্ট অনীহা ও উদাসীনতা লক্ষণীয়। তারা স্থান, কাল ও পাত্র না দেখে যত্রতত্র প্রাকৃতিক প্রয়োজন সেরে ফেলছে। প্রকাশ্যে জনসমক্ষে নির্লজ্জের মতো প্রস্রাব-পায়খানা করছে। সতর ও ফরজ তরকের প্রতিও ভ্রƒক্ষেপ করছে না। এটা যে খুব দায়ে পড়ে করছে এমনও নয়, তবুও করছে। ফসলি ক্ষেতে, ছায়াযুক্ত গাছের নিচে, নদীর ঘাটে, চলাচলের রাস্তায় ও পানিতে প্রস্রাব-পায়খানা করে রাখছে। গ্রামের হাটে, বাজারে ও মহাসড়কের পাশে মলমূত্র ত্যাগ করছে। শহরের স্টেশন, ফুটপাত, ফুটওভার ব্রিজের পাশে এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন গলি-পাড়ায় স্থান সঙ্কুলানে ও অযত্নে রাখা টয়লেটে বেশ নির্লজ্জের মতো সারছে প্রাকৃতিক ওই কাজটি। অথচ নির্লজ্জতার জন্য বলা হয়েছে, ‘লজ্জাশীলতা না থাকলে তুমি যা ইচ্ছা করতে পারবে।’ অবশ্য এ নির্জলজ্জতার খেসারত তাকে দিতে হবে। এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালাও শাস্তি বিধান করতে দ্বিধা ও লজ্জাবোধ করেন না। এরশাদ হচ্ছে, ‘আল্লাহ সত্য কথা বলতে লজ্জাবোধ করেন না।’ (সূরা আহজাব : ৫৩)।
বর্তমানে পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধের মোক্ষম সময়েও মানুষ অবাধে রাস্তার পাশে প্রস্রাব করছে। ক্ষেত্র বিশেষে পায়খানা করতেও তাদের বাধছে না। যার দুর্গন্ধে মানুষের যাতায়াত কষ্টকর হয়ে যায়। অনেক সময় দেখা যায়, ওই প্রস্রাব দেয়ালের কিনারা থেকে মূল রাস্তায় চলে আসছে। বিকল্প পথ না থাকায় মানুষ দেখে বা না দেখে তা পাড়াতে বাধ্য হচ্ছে। ব্যাহত হচ্ছে মানুষের চলাচল। দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। রোগ-জীবাণু ও দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র। রোগাক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। এ জন্যই মানবতার নবী (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘পানির ঘাটে, রাস্তার মাঝে এবং বৃক্ষের ছায়ায় মলত্যাগ থেকে বিরত থাকবে।’ (আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ)।
স্থির পানি বা বদ্ধ জলাশয়ে পায়খানা-প্রস্রাব করা একেবারেই অনুচিত। বদ্ধ জলাশয়ে প্রস্রাব-পায়খানা করলে তাতে রোগজীবাণু জন্ম নেয়। ফলে গোসলের সময় ওই পানি মুখে, নাকে, চোখে প্রবেশ করে নাক, মুখ, চোখ, খাদ্যনালি ও শ্বাসনালিতে বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি করতে পারে। চর্মে বিভিন্ন ধরনের অ্যালার্জির সৃষ্টি হতে পারে। এ প্রসঙ্গে নবী করিম (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের কেউ যেন স্থির পানিতে প্রস্রাব না করে এবং এরপর ওখানে গোসল না করে।’ (বুখারি ও মুসলিম)।
ভোরবেলায় শহরের বাসস্ট্যান্ডগুলোতে, মহাসড়কের পাশে, দেয়াল ঘেঁষে অনাকাক্সিক্ষতভাবে এসব নোংরা কাজের আলামত চোখে পড়ে। রেলস্টেশনের আশপাশে, প্লাটফর্মে এসব কষ্টকর দৃশ্য মানুষকে দেখতে হয়। এসব কার্যকলাপ নিঃসন্দেহে গর্হিত এবং শিষ্টাচার বিবর্জিত। মুসলিম শরিফে এসেছে, মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘আমার কাছে আমার উম্মতের ভালোমন্দ সব আমলের ফিরিস্তি পেশ করা হয়েছিল। আমি ভালো কাজসমূহের তালিকার মধ্যে রাস্তা থেকে অপসারিত কষ্টকর বস্তুকেও দেখতে পেয়েছি এবং মন্দ কাজসমূহের তালিকার মধ্যে দেখতে পেয়েছি মসজিদে নাকের ময়লা নিক্ষেপ করা, যা সেখান থেকে মুছে ফেলা না হয়।’ এই হাদিস দ্বারা সুস্পষ্ট হয়েছে, সামান্য নাকের ময়লা ঝাড়া এবং রাস্তা থেকে কষ্টকর যে কোনো বস্তু অপসারিত করার ব্যাপারেই ইসলাম কত সতর্ক। অথচ আমরা আজ কত নিচে নেমেছি যে, মানুষ চলাচলের পথে অবাধে প্রস্রাব-পায়খানা করতে দ্বিধা করছি না। রাস্তা থেকে কষ্টকর বস্তু অপসারণ তো দূরে থাক, প্রতিযোগিতার মাধ্যমে যেন পরিবেশ বিপন্ন করছি। অথচ একজন সুস্থ মস্তিষ্কের ব্যক্তি যত্রতত্র মলত্যাগ করতে পারে না। এ ব্যাপারে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে মহানবী (সা.) এরশাদ করেন, “ঈমানের সত্তরের চেয়েও অধিক শাখা রয়েছে। এর মধ্যে উত্তম শাখা হচ্ছে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ কালেমা পাঠ করা এবং ক্ষুদ্রতম শাখা হচ্ছে রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু অপসারণ করা।” (বোখারি ও মুসলিম)।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন