শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

ট্রেনে বিনা টিকিটে ভ্রমণ ও ক্ষমতার দাপট

| প্রকাশের সময় : ৯ মে, ২০২২, ১২:০৬ এএম

রেলমন্ত্রী অ্যাডভোকেট নূরুল ইসলাম সুজনের আত্মীয় পরিচয়ে বিনা টিকিটে তিন যাত্রীর ট্রেনের এসি কামরায় ভ্রমণের দায়ে জরিমানা আদায় করাতে সংশ্লিষ্ট টিটিইকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এই অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছে। ক্ষমতার অপব্যবহারের নিকৃষ্টতম নজির হিসেবে একে উল্লেখ করা হয়েছে। রেলমন্ত্রী ঘটনার সঙ্গে তাঁর জড়িত থাকার বিষয় অস্বীকার করেছেন। তাঁর আত্মীয় পরিচয়দানকারীদের তিনি চেনেন না বলেও দাবি করেছেন। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরে অবশ্য বলা হয়েছে, বিনা টিকিটে ভ্রমণকারী তিন যাত্রীর সঙ্গে রেলমন্ত্রীর আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে। আর টিটিই শফিকুল ইসলামকে বরখাস্ত করা হয়েছে রেলমন্ত্রীর স্ত্রী শাম্মী আখতারের টেলিফোনে। টিআইবি ঘটনাটিকে ন্যাক্কারজনক বলে অভিহিত করেছে। এক বিবৃতিতে বলেছে, ন্যায়নিষ্ঠভাবে দায়িত্ব পালনের কারণে পুরস্কৃত হওয়ার পরিবর্তে টিটিইকে তড়িৎগতিতে বরখাস্তের সিদ্ধান্তে দেশবাসীর কাছে এই বার্তাটিই পরিষ্কার হয়েছে, ক্ষমতাবানরাই শুধু নয়, বরং তাদের প্রভাববলয়ের মধ্যে থাকা তাদের আত্মীয়-পরিজনের জন্যও আইন প্রযোজ্য নয়। টিআইবির মতে, প্রথমত রেলমন্ত্রীর আত্মীয়রা হয়তো ধরেই নিয়েছিলেন, রেলের প্রচলিত আইন তাদের জন্য প্রযোজ্য নয়। দ্বিতীয়ত, টিটিইকে কোনো রকমের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে বরখাস্ত করা প্রমাণ করে, ক্ষমতার দাপট ও অনিয়মই বাস্তবতা। অন্যদিকে প্রশ্ন উঠেছে, রেলমন্ত্রীর স্ত্রী কোন ক্ষমতাবলে টিটিইকে বরখাস্ত করার নির্দেশ দিতে পারেন এবং সেই নির্দেশ পালিত হতে পারে?

রেলে অনিয়ম, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অন্যায্য ইস্তেমাল সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। ইতোপূর্বে এসব বিষয়ে পত্রপত্রিকায় বিস্তর রিপোর্ট ও লেখালেখি হয়েছে। এতে পরিস্থিতির কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেনি। রেলে কেনাকাটা, সংস্কার-মেরামত, বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন সারা বছরই চলে। এসব কাজে অনিয়ম-দুর্নীতি অনেকটাই ওপেন সিক্রেট। নিয়োগের ক্ষেত্রেও ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগ নতুন নয়। এমনকি ট্রেনের টিকিট নিয়েও নানা রকম অনৈতিক কারবার চলে। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত রেলমন্ত্রী থাকাকালে বড় দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও তাঁর সংক্ষিপ্ত সময়কালে রেলে কিছু ভালো কাজ হয়েছিল। বিগত রেলমন্ত্রীর বিরুদ্ধে তেমন একটা অভিযোগ ছিল না। রেলের জন্য বহু প্রকল্প নেয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো প্রকল্পই যথাসময়ে সুচারুরূপে বাস্তবায়িত হয়নি বা হচ্ছে না। গত পরশু একটি ইংরেজি দৈনিকে ‘রেল প্রজেক্টস ডিরেল্ড’ শিরোনামে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে, যাতে বলা হয়েছে, রেলের ২০টি প্রকল্পের ১৪টির চলতি আর্থিক বছরে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও শেষ হচ্ছে না। কর্তৃপক্ষ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের সময়সীমা এক থেকে তিন বছর বাড়ানোর চেষ্টা করছে। বলা বাহুল্য, প্রকল্পের সময় বাড়ানোর ক্ষতি ত্রিবিধ। প্রথমত, প্রকল্পের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়া, দ্বিতীয়ত, ব্যয়বৃদ্ধি পাওয়া এবং তৃতীয়ত সংশ্লিষ্টদের লুটপাটের সুবিধা বর্ধিত হওয়া, যা আসলে জনগণেরই অর্থ। রেলের বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের একটা সুবর্ণ সুযোগ ছিল করোনাকালে, যা কর্তৃপক্ষ নিতে পারেনি। এ জন্য মন্ত্রী-সচিব ও মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দায় এড়িয়ে যেতে পারবেন না। রেলে এ পর্যন্ত বিভিন্ন প্রকল্পে শত শত কোটি টাকা খরচ হয়েছে। অথচ, ব্যয় অনুপাতে সেবা ও সুবিধা পাওয়া যায়নি। ট্রেনের যাত্রীসেবায় গৃহীত ও বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলো থেকে সেবা খুব কমই পাওয়া যায়। যাতায়াতে স্বাচ্ছন্দ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, খাদ্য ও নাস্তা-পানির প্রাপ্যতা, টয়লেটের ভালো কন্ডিশন, আলো-বাতাসের পর্যাপ্ত বন্দোবস্ত ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই কমতি-ঘাটতি বিদ্যমান। রেলের টিকিটের ব্যাপারে যে ব্যবস্থা কার্যকর আছে তা ত্রুটিপূর্ণ ও বৈষম্যমূলক। উপরের শ্রেণিতে টিকিট পাওয়া রীতিমত ভাগ্যের ব্যাপার। কোটা ব্যবস্থার কারণে কোটার বাইরে টিকিট প্রায় মেলেই না। অনেকেই মনে করেন, কোটা সিস্টেম এখন যেভাবে আছে, সেভাবে মোটেই থাকা উচিত নয়। এমন ব্যবস্থা কাম্য যাতে সাধারণ মানুষও উপরের শ্রেণির সুবিধা নিয়ে ভ্রমণ করতে পারে। কোটা সিস্টেমের নামে কায়েমী স্বার্থ ভেঙ্গে দিতে হবে।

সারাবিশ্বেই নিরাপদ ও সাশ্রয়ী যাতায়াত মাধ্যম হিসেবে রেলের গুরুত্ব বাড়ছে। পাহাড়-পর্বতের ওপর দিয়ে রেলপথ নির্মাণ এবং বিমানের সমান দ্রুতগতির ট্রেন উদ্ভাবন হয়েছে। আরো কীভাবে ট্রেনভ্রমণ নিরাপদ, দ্রুত ও স্বচ্ছন্দময় করা যায়, তার প্রতিযোগিতা চলছে। অথচ, আমরা আছি দূর পেছনে। আমরা সেই মান্ধাতা আমলেই পড়ে আছি। সরকার সঙ্গতকারণেই রেলকে প্রাধান্যে আনতে চাইছে। কিন্তু রেল মন্ত্রণালয় সরকারের সদিচ্ছার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে চলতে পারছে না। ব্যর্থতার এই ঘেরা টোপ থেকে রেলকে বাইরে আনতে হবে। রেল ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ঘটাতে হবে। রেলের যাবতীয় কাজকর্মে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। অনিয়ম-দুর্নীতি, ক্ষমতার দাপট নিরোধ করতে হবে। খবর বেরিয়েছে, গত এপ্রিল মাসে দেশে ৪২৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ৫৪৩ জন। আহত হয়েছে ৬১২ জন। রেলে দুর্ঘটনা বলতে গেছে বিরল। রেলের গুরুত্ব ও জনপ্রিয়তা বাড়ার এটাও একটা কারণ। যাত্রী ও মালামাল পরিবহন উভয় ক্ষেত্রে রেলকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। এ জন্য রেল মন্ত্রণালয়কে আরো গতিশীল ও ডায়নামিক করে তুলতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন