প্রতিটি প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্য পর্যাপ্ত অক্সিজেন সমৃদ্ধ নির্মল বায়ু অপরিহার্য। বুক ভরে শ্বাস নেয়ার মতো বাসযোগ্য পরিবেশ সকলেই প্রত্যাশা করে। প্রকৃতপক্ষে বেঁচে থাকার জন্য বায়ু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বায়ু ছাড়া কয়েক মিনিটের বেশি বেঁচে থাকা অসম্ভব। বেঁচে থাকার সেই অত্যাবশ্যকীয় উপাদানটি আমরা প্রতিনিয়ত বিভিন্নভাবে দূষিত করে চলেছি। দূষিত বায়ু গ্রহণ করার ফলে বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে নারী ও শিশুসহ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ।
অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়নের কারণে দেশে বায়ুদূষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঢাকাসহ বড়ো শহরগুলোতে রাস্তা নির্মাণ ও মেরামত, ইউটিলিটি সার্ভিসের কারণে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, অনিয়ন্ত্রিত ভবন নির্মাণ কার্যক্রম থেকে সৃষ্ট ধুলাবালি ও ভাসমান বস্তুকণা, সনাতন পদ্ধতির ইটভাটাসৃষ্ট দূষণ, শিল্পকারখানার বিষাক্ত বর্জ্যরে উন্মুক্ত নিঃসরণ, যানবাহন থেকে সৃষ্ট কালো ধোঁয়া নির্গমন, নানা রকমের কঠিন বর্জ্যের অব্যবস্থাপনা ও পৌর বর্জ্য পোড়ানো ইত্যাদি বায়ুদূষণের মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত। ভূপৃষ্ঠের উন্মুক্ত স্থানে যানবাহন চলাচল বা প্রাকৃতিক এবং মানবসৃষ্ট কারণে অতিসহজেই ধুলি আকারে ছড়িয়ে পড়ে বায়ুদূষণ সৃষ্টি করে। পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক ২০১৩ সালে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকার বায়ুদূষণের জন্য ইটভাটা দায়ী ৫৮ শতাংশ, রাস্তা ও মাটির ধুলা ১৮, যানবাহন ১০, বায়োমাস পোড়ানো ৮ এবং অন্যান্য উৎস্য ৬ শতাংশ দায়ী। বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণামতে, বাংলাদেশের ২ থেকে ৪০ শতাংশ বায়ুদূষণ আন্তঃসীমান্ত দূষণ তথা সেকেন্ডারি দূষণ সৃষ্টির মাধ্যমে বায়ুদূষণের মাত্রাকে বৃদ্ধি করছে।
দেশের বায়ুমান পরিবীক্ষণের জন্য সরকার ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য বিভাগীয় ও শিল্পঘন শহরগুলোতে স্থায়ী ১৬টি কেন্দ্র ও স্থানান্তরযোগ্য ১৫টি কম্প্যাক্ট কেন্দ্র স্থাপন করেছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের আওতায় পরিচালিত এসকল বায়ুমান পরিবীক্ষণ কেন্দ্রে সার্বক্ষণিকভাবে বায়ুতে বিদ্যমান পিএম১০, পিএম২.৫, ওজোন, সালফার ডাই অক্সাইড, নাইট্রোজেনের অক্সাইডস ও কার্বন মনোক্সাইড এই ছয়টি বায়ুদূষক পরিবীক্ষণ করা হয়। বায়ুমান পরিবীক্ষণের প্রাপ্ত তথ্য ও উপাত্ত সংরক্ষণ এবং বৈজ্ঞানিক উপায়ে বিশ্লেষণ করে দৈনিক ভিত্তিতে বায়ুমান সূচক ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় বায়ুদূষণের প্রধান উৎসসমূহ চিহ্নিত পূর্বক দূষণ নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। শিল্প প্রতিষ্ঠান, ইটভাটা, যানবাহন, বর্জ্য পোড়ানো, অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণ কার্যক্রম ও নির্মাণ সামগ্রী পরিবহণে সৃষ্ট বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে পরিবেশ অধিদপ্তরের মনিটরিং ও এনফোর্সমেন্ট এবং ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার কার্যক্রম বৃদ্ধি করা হয়েছে। বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আলোচনা সভা-সেমিনারসহ দৈনিক পত্রিকায় গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
সনাতন পদ্ধতির ইটাভাটাসৃষ্ট ধোয়া বায়ুদূষণের অন্যতম প্রধান কারণ হওয়ায় সরকার এজাতীয় ইটভাটা নিয়ন্ত্রণে বহুবিধ উদ্যোগ বাস্তবায়ন করছে। এর অংশ হিসেবে ‘ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩ (সংশোধিত ২০১৯)’ কার্যকর করা হয়েছে। এর মাধ্যমে অধিকাংশ সনাতন পদ্ধতির ইটভাটাকে কম দূষণকারী আধুনিক ইটভাটাতে রূপান্তর করা হয়েছে। এছাড়া বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা প্রণয়নের কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। সমন্বিতভাবে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণের বিষয়গুলো এখানে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। বিধিমালায় বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি দেখভালের জন্য উচ্চপর্যায়ের একটি নির্বাহী পরিষদ গঠনের কথা বলা আছে। অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণ ও নির্মাণ সামগ্রী পরিবহণের মাধ্যমে সৃষ্ট বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে এবং মোবাইল কোর্ট ও এনফোর্সমেন্ট কার্যক্রমের মাধ্যমে উক্ত প্রজ্ঞাপন বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
ঢাকার আশেপাশের ইটভাটা ও শিল্পকারখানার বায়ুদূষণ মনিটরিংয়ের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের বিভিন্ন পর্যায়ের মোট পাঁচ জন কর্মকর্তা, কর্মচারী সমন্বয়ে বায়ুমান মনিটরিং টিম গঠিত হয়। উক্ত টিম প্রতিদিন ঢাকার আশেপাশের ইটভাটা ও শিল্পকারখানার বায়ুদূষণ মনিটরিংসহ প্রয়োজনে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করবে। পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণের অংশ হিসেবে অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের অংশ হিসেবে গত তিন বছরে এক হাজার চারশ বিয়াল্লিশটি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে দুই হাজার তিনশত ষাটটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এসময় মোট উনষাট কোটি তেইশ লক্ষ একাশি হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে এবং ৭৯ জনকে কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে। মোট ৭ শত ৬১টি ইটভাটা ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। এসকল ইটভাটা যাতে পুনরায় চালু করতে না পারে, সে বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও জেলা অফিস সমূহের মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সারাদেশে এ জাতীয় অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
পোড়ানো পদ্ধতির ইটভাটাসৃষ্ট দূষণ কমানোর লক্ষ্যে সরকার ইটের বিকল্প হিসেবে পরিবেশবান্ধব ব্লক ব্যবহারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এলক্ষ্যে সরকারি নির্মাণ, মেরামত ও সংস্কার কাজে ভবনের দেয়াল ও সীমানা প্রাচীর, হেরিংবোন বন্ড রাস্তা এবং গ্রাম সড়ক টাইপ-‘বি’ এর ক্ষেত্রে ইটের বিকল্প হিসেবে আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে পোড়ানো ইটের পরিবর্তে শতভাগ ব্লক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। গেজেট প্রজ্ঞাপনে উল্লিখিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ব্লক ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য সরকারি নির্মাণ, মেরামত ও সংস্কার কাজ সংশ্লিষ্টদের দরপত্র সিডিউলে বাধ্যতামূলক ব্লক ব্যবহার সংক্রান্ত এবং ব্লক ব্যবহারের হার সুনির্দিষ্টভাবে অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করার উদ্যোগ চলমান আছে। পরবর্তীতে সকল বেসরকারি নির্মাণ কাজেও ব্লক ব্যবহারের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি সরকারের পরিকল্পনায় রয়েছে। পরিবেশবান্ধব ব্লক প্রস্তুতে প্রণোদনা প্রদানেরও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিকল্প ইট প্রস্তুতের লক্ষ্যে ইট প্রস্তুতকারকদের সাথে মতবিনিময় সভা এবং এর ব্যবহারে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। বায়ুদূষণকারী ইটভাটায় তৈরি পোড়ানো ইটের বিকল্প হিসেবে পরিবেশবান্ধব ব্লক ইট প্রস্তুতের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ৫টি বিভাগীয় শহরে ব্লক ইট প্রস্তুতের ডেমনেস্ট্রেশন প্রজেক্ট বাস্তবায়নের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে যেখানে স্বল্প ব্যয়ে ব্লক ইট উৎপাদনের পদ্ধতি দেখানো হবে।
সরকারের বহুবিধ উদ্যোগ বাস্তবায়নের ফলে ইটভাটার নিঃসরণজনিত বায়ুদূষণ হ্রাস পেয়েছে। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ পরিচালিত এক জরিপ বলছে, বায়ুদূষণের জন্য অর্ধেক অর্থাৎ ৫০ শতাংশ দায়ই তরল জ্বালানি পোড়ানোর মাধ্যমে তৈরি হওয়া ধোঁয়ার। ৪০ শতাংশ দূষণের উৎস খড়, কাঠ, তুষের মতো জৈব বস্তুর ধোঁয়া ও সূক্ষ্ণ বস্তুকণা। বাকি ১০ শতাংশ দূষিত বস্তুকণা আসে ইটভাটায় কয়লা পোড়ানোর ধোঁয়া থেকে। সংশ্লিষ্ট এক গবেষকের মতে, ঢাকার বায়ুদূষণের ক্ষেত্রে এক সময় ইটভাটাগুলোকে সবচেয়ে বেশি দায়ী বলে মনে করা হতো। এখন পরিস্থিতির বদল হয়েছে।
পরিবেশ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ সরকারের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং সবুজ বিনিয়োগ নিশ্চিতের লক্ষ্যে নতুন অর্থায়ন পদ্ধতি প্রবর্তনের জন্য ‘বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্ট সাস্টেইনেবিলিটি এন্ড ট্রান্সফরমেশন (বেস্ট)’ নামের ৫ বছর মেয়াদি এক বৃহৎ প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার উন্নয়ন, প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন, পরিবেশ সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো স্থাপন, ল্যাব তৈরি এবং পরিবেশ ফান্ড প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পরিবেশ অধিদপ্তরের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে উদ্যোক্তাকে ‘গ্রিন ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে। যানবাহনের ক্ষতিকর ধোয়া নিয়ন্ত্রণের অংশ হিসেবে প্রয়োজনীয় সুযোগসুবিধাসহ ৬ হাজার বর্গমিটারের ৮তলা বিশিষ্ট ৪টি ‘যানবাহন পরিদর্শন সেন্টার’ প্রতিষ্ঠা করা হবে। এছাড়াও, পাইলট ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য অবকাঠামো স্থাপন করা হবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে দেশের পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণে সরকারের সক্ষমতা অনেকাংশে বৃদ্ধি পাবে।
বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ একটি সমন্বিত প্রক্রিয়া। পরিকল্পিতভাবে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ ও রোধে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মন্ত্রণালয়, বিভাগ, সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা, প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম ও ভূমিকা নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। ঢাকা ও আশেপাশের বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশনার আলোকে সংশ্লিষ্ট সকল মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর ও সংস্থার সমন্বয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিবের সভাপতিত্বে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগসমূহের করণীয় নির্ধারণ করে চূড়ান্ত বায়ুদূষণ রোধ নির্দেশিকা প্রণয়ন করা হয়েছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় প্রণীত বায়ুদূষণ রোধ নির্দেশিকা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সম্প্রতি এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশনা অনুসারে প্রণীত নির্দেশিকা বাস্তবায়ন ও সরকারি নির্মাণ কাজে ২০২৫ সালের মধ্যে শতভাগ ব্লক ব্যবহারের অগ্রগতি প্রতিবেদন প্রতি তিন মাস অন্তর অন্তর পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণের জন্য বলা হয়। এছাড়া, উক্ত সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রত্যেক মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর, সংস্থা হতে একজন ফোকাল পয়েন্ট কর্মকর্তা মনোনয়ন করা হয়েছে। নির্দেশিকায় সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তর, সংস্থার বায়ুদূষণ রোধে করণীয়সমূহ বাস্তবায়ন করলে বায়ুদূষণ বহুলাংশে হ্রাস পাবে।
লেখক: সিনিয়র তথ্য অফিসার, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন