নিয়ন্ত্রণহীন মোটরসাইকেল। বেপরোয়া এদের চালকরা। নিয়মকানুন ও ট্রাফিক আইন মানতে অনীহা তাদের অধিকাংশের। ফলে যত্র তত্র দুর্ঘটনা ঘটছে। এসব দুর্ঘটনায় অনেকে মারা যাচ্ছে। অনেকে চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে। এমনিতেই আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনা অন্য অনেক দেশের তুলনায় বেশি। বেপরোয়া মোটরসাইকেল তাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তরফে জানানো হয়েছে, চলতি বছরের এপ্রিলে ৪২৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৪৩ জন নিহত ও ৬১২ জন আহত হয়েছে। এর মধ্যে ১৮৯টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ২০৬ জন। এ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে, মোট দুর্ঘটনার ৪৪ দশমিক ২৬ শতাংশ এবং নিহতের ৩৭ দশমিক ৯৩ শতাংশের কারণ মোটরসাইকেল। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ও তাতে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকায় জনমনে ব্যাপক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। সঙ্গতকারণেই এ দুর্ঘটনা ও মৃত্যু রোখার কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছে ব্যাপকভাবে। কী কারণে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বাড়ছে সেটা খতিয়ে দেখা অত্যন্ত জরুরি। দেখা যায়, মোটরসাইকেল চালকদের একটা বড় অংশ টিনএজার। এরা নিয়ম-নীতি ও ট্রাফিক আইনের ধার ধারে না। এক মোটরসাইকেলে দু’জন-তিনজন পর্যন্ত চলাচল করে। হেলমেট পর্যন্ত ব্যবহার করে না। এদের পরিচয় সম্পর্কে যতদূর জানা যায়, এরা ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের সঙ্গে জড়িত অথবা নব্য বিত্তবানদের সন্তান। আর্থ-রাজনৈতিক কারণেই এরা ধরাকে সরা জ্ঞান করে। এদের বিধিবিধান না মানা কিংবা পুলিশকে পরোয়া না করার কারণ মূলত এটাই। এ ছাড়া অনেক দিন ধরেই মোটরসাইকেল রাজনৈতিক ক্ষমতা ও পেশীশক্তি প্রদর্শনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এটা বেড়েছে। উদ্ধত, বেপরোয়া ও উচ্ছৃংখল টিনএজারদের মোটরসাইকেল নিয়ে দুর্ঘটনায় পতিত হওয়া তাই এখন সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। উপরন্তু কয়েক বছর হলো মোটরসাইকেলের অ্যাপভিত্তিক সার্ভিস চালু হয়েছে। এক্ষেত্রে কোনো নিয়মকানুক ও নিয়ন্ত্রণ নেই। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বৃদ্ধির পেছনে এই অনিয়ন্ত্রিত অ্যাপভিত্তিক সার্ভিসেরও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে।
দেশে মোট কত মোটরসাইকেল চলাচল করে তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। ইনকিলাবে প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়েছে, সারাদেশে নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা ৩৫ লাখ ৮০ হাজার ৪৮৮। এর বাইরে অনিবন্ধিত মোটরসাইকেলও রয়েছে। এ সংখ্যা আরো কয়েক লাখ হতে পারে। ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া মোটরসাইকেল কেনা যাবে না, এমন বিধি থাকলেও এখন তা কার্যকর নেই। ফলে যে কেউ লাইসেন্স থাক বা না থাক মোটরসাইকেল কিনতে পারছে। এতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মোটরসাইকেল ড্রাইভিং জানে না, এরূপ লোকদের হাতে গিয়ে পড়ছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষীয় সূত্রের দাবি, ড্রাইভিং না জানা ও ট্রাফিক আইন না মানা টিনএজাররা দুর্ঘটনার জন্য বিশেষভাবে দায়ী। অন্যদিকে অ্যাপভিত্তিক রাইড সার্ভিসের চালকরাও দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে যখন তখন। অ্যাপভিত্তিক রাইড সার্ভিসের অনুমোদন আছে কেবল ঢাকা শহরের জন্য। অথচ, সারাদেশেই এ সার্ভিস চলছে। ব্যক্তি পর্যায়েও অনেকে ভাড়ায় রাইড শেয়ার করছে। রাইড সার্ভিস ঢাকা শহরে সীমাবদ্ধ থাকায় গ্রামাঞ্চলের বহু তরুণ মোটরসাইকেল কিনে ঢাকা শহরে চলে এসেছে বেকারত্ব ঘোচাতে। তারা মোটরসাইকেল চালনায় তেমন দক্ষ নয়। বিশেষত ঢাকার মতো জনবহুল শহরে মোটরসাইকেল চালানোর জন্য যেরূপ দক্ষতা প্রয়োজন তা তাদের নেই। ফলে যে কোনো সময় তাদের দুর্ঘটনায় পড়তে হচ্ছে। এক হিসাবে দেখা গেছে, লাইসেন্স করা ৯ লাখ ১৪ হাজার ৮১৭টি মোটরসাইকেল ঢাকা শহরে চলাচল করছে। লাইসেন্স ছাড়া কত মোটরসাইকেল চলাচল করছে, সেটা কেউ বলতে পারে না। রিকশার দৌরাত্ম্য ঢাকা শহরে যাতায়াত করা যায় না। এর সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে মোটরসাইকেল। এই দ্বিচক্র যন্ত্রযান যানজটের এই শহরে যাতায়াতের ক্ষেত্রে কিছুটা সুবিধা দিলেও দুর্ঘটনার ব্যাপক ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে। ঈদের ছুটিকালীন সময়ে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে ভর্তি হয়েছে ১০৪৭ জন। এদের প্রায় অর্ধেক মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার হয়ে ভর্তি হয়েছে। মোটরসাইকেল অনেক সময় যানজটেরও কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
ঢাকাসহ সড়ক-মহাসড়ক, এমনকি গ্রামে-গঞ্জে পর্যন্ত মোটরসাইকেলের আধিক্য লক্ষ করা যাচ্ছে। মোটরসাইকেল আমদানি বাড়ছে। দেশেও এর কারখানা বিকশিত হচ্ছে। এসব নেতিবাচকভাবে দেখার সুযোগ নেই। কিন্তু দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে এক্ষেত্রে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা আবশ্যক হয়ে পড়েছে। মোটরসাইকেল একটি যন্ত্রবিশেষ। এর কোনো দোষ নেই। দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির জন্য দায়ী এর চালকরা এবং ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি-বিচ্যুতি। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অপ্রাপ্ত বয়স্কদের মোটরসাইকেল চালনার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করা উচিত। মোটরসাইকেল যেই চালাবে তার ক্ষেত্রে লাইসেন্স বাধ্যতামূলক করতে হবে। ট্রাফিক আইন ও বিধি যথাযথভাবে কার্যকর করতে হবে। এ ব্যাপারে কোনো ছাড় দেয়া যাবে না। অ্যাপভিত্তিক মোটরসাইকেল সার্ভিসকে নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলার আওতায় আনতে হবে। এদের চালকদের উপযুক্ত দক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে। ঢাকা বা অন্যান্য বড় শহরে কত সংখ্যক মোটরসাইকেল চলাচল করতে পারে, সেটা নির্ধারণ করে দিতে হবে। এক এলাকার মোটরসাইকেল যাতে অন্য এলাকায় যেতে না পারে তাও দেখতে হবে। মোটকথা, যথাযথ নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ছাড়া মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা এবং প্রাণহানি রোধ করা যাবে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন