সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

আগামী বাজেট : কর্মসংস্থান বাড়ানোর লক্ষ্য হওয়া উচিত

মো. মাঈন উদ্দীন | প্রকাশের সময় : ১১ মে, ২০২২, ১২:০১ এএম

জাতীয় বাজেটের লক্ষ্য শুধু সরকারের আয় ও ব্যয় নিয়ন্ত্রন করা নয়। এর লক্ষ্য হলো, দেশের জনগণের জন্য গ্রহণযোগ্য একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা। ২০২২-২৩ অর্থ বছরের বাজেট হবে বাংলাদেশের ৫১ তম বাজেট। চলতি ২০২১-২২ অর্থ বছরের মূল বাজেটের আকার ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। এতে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ৭ দশমিক ২ শতাংশ। এর আগে ২০২০-২১ অর্থ বছরের আকার ছিল ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। আগামী ২০২২-২৩ অর্থ বছরের জন্য সরকার ৬ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষনার প্রস্তুতি নিচ্ছে। নতুন বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) লক্ষ্য মাত্রা ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ধরা হচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের এক সূত্রে জানা গেছে, আগামী ৯ জুন বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে নতুন অর্থ বছরের বাজেট পেশ করবেন অর্থমন্ত্রী। চলতি অর্থ বছরে বাজেট ঘাটতি ধরা হয়েছিল ২ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা। সম্প্রতি আর্থিক মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার সংক্রান্ত সমন্বয় কমিটির বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, আগামী বাজেটে ঘাটতি ধরা হবে ২ লাখ ৪৩ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, গত ফেব্রুয়ারিতে দেশে মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ১ শতাংশ। যেখানে চলতি অর্থ বছরে মূল্যস্ফীতি ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। আসন্ন অর্থ বছরের মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৫ শতাংশ ধরা হচ্ছে বলে জানা গেছে। জানা গেছে, আগামী অর্থ বছরের মোট আয় ধরা হবে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। যেখানে চলতি অর্থ বছরে আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। সেই অনুযায়ী আসন্ন বাজেটে প্রাক্কলিত আয়ের পরিমান বাড়ছে ৪৪ হাজার কোটি টাকা। চলতি বাজেটে ২০২০-২১ অর্থ বছরে মূল বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরের জন্য তা ২ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা হতে পারে। এদিকে সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি সম্পর্কে পূর্বাভাস দিয়েছে। সংস্থাটির মতে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশের জিডিপিতে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে এবং ২০২৭ সালে তা বেড়ে ৬ দশমিক ৯ শতাংশ হতে পারে। বিশ^ব্যাংক বলেছে, চলতি ২০২১-২২ অর্থ বছরে বাংলাদেশে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে। আর এডিবি দিয়েছে, ৬ দশমিক ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস। গত ফেব্রুয়ারীতে দেশের মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬ দশমিক ১ শতাংশ। আইএমএফ পূর্বাভাস দিয়েছে, পুরো বছর জুড়ে মূল্যস্ফীতি হতে পারে প্রায় ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। বাজেটের সামাজিক নিরাপত্তা খাত একটি গুরুত্বপূর্ন বিষয়। এই খাতে উপকারভোগীদের সঠিকভাবে সুফল পাওয়ার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার ঘাটতি রয়েছে। জানা গেছে, আসন্ন বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে উপকারভোগীর সংখ্যা ও আওতা বাড়ানো হবে। বর্তমানে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ১২৩ টি কর্মসূচি রয়েছে। সরকারের ৩০টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এ কর্মসূচি বাস্তাবায়ন করছে। চলতি অর্থ বছরে ৫৭ লাখ উপকারভোগী বয়স্ক ভাতা পাচ্ছে। আগামী অর্থ বছরে আরও ১১ লাখ যোগ হয়ে ৬৮ লাখ হতে পারে। বয়স্কভাতা ও স্বামী পরিত্যাক্ত বিধবাভাতার আওতা নতুন করে ১০০ উপজেলাকে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। যা একটি ভালো উদ্যোগ। ফলে ২০২২-২৩ অর্থ বছরে উপকারভোগী উপজেলার সংখ্যা হচ্ছে ৩৬২। চলতি অর্থ বছরে বয়স্কভাতার জন্য বরাদ্ধ রয়েছে ৩ হাজার ৪৪৪ কোটি টাকা, আগামী বাজেটে তা ৩ হাজর ৯৪৪ কোটি টাকা হতে পারে। এখনও বয়স্কদের ৫০০ টাকা করে ভাতা দেওয়া হয়। যা বর্তমান বাজারমূল্যের সাথে বেমানান। তাই ৫০০ টাকা থেকে ভাতার পরিমান বাড়ানো উচিৎ। পাশাপাশি প্রাথমিক চিকিৎসা সুযোগ-সুবিধা ও চিকিৎসাব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণ করা উচিত। বর্তমানে আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সন্তোষজনক হলেও সাধারন মানুষের মাঝে তার সুফল সমানভাবে পৌঁছাছে না। সমাজের বহু মানুষের প্রকৃত আয় বাড়েনি। তাছাড়া মূল্যস্ফীতি মানুষের প্রকৃত আয়কে কমিয়ে দিয়েছে। দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধগতিতে প্রান্তিক মানুষরা হিমশিম খাচ্ছে। মাথাপিছু আয় ধরে আমরা নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছেছি ঠিকই কিন্তু সমাজে আয়বৈষম্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই বাজেটে বৈষম্য দূর করতে কর ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। ধনীদের কর ফাঁকির পথ বন্ধ করতে হবে। প্রত্যক্ষ করের আওতা বাড়াতে হবে। দেশের জন্য প্রবৃদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ ঠিকই, তবে এ প্রবৃদ্ধিকে সমতাভিত্তিক উন্নয়নের মাধ্যমে বিস্তার ঘটাতে হবে। তাই আগামী বাজেটে এর প্রতি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্ধ বাজেটের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক। শিক্ষা ব্যবস্থার সিলেবাস ও কারিকুলাম পরিবর্তন নয় বরং সঠিক মেধাসম্পন্ন জাতি গঠন ও মানসম্পন্ন শিক্ষাব্যবস্থা গঠন করার জন্য বাজেটে প্রয়োজনীয় বরাদ্ধ থাকা উচিৎ। মানসম্পন্ন শিক্ষার জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ করা উচিত। শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকা উচিত। করোনা মহামারিতে আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থার দুর্বলতা আরও স্পষ্ট হয়েছে। এখন দরকার সঠিক পরিবর্তন ও বাস্তবভিত্তিক প্রয়োগ ও যথাযথ বরাদ্ধ। বাজেটের তার প্রতিফলন দেখানো উচিৎ। আমাদের প্রবৃদ্ধি যেটুকু বেড়েছে সে হারে আমাদের কর্মসংস্থান বাড়েনি। বর্তমানে যে প্রবৃদ্ধি নিয়ে আমরা কথা বলি, তা কর্মসংস্থানবান্ধব নয়। লাখ লাখ যুবক বর্তমানে চাকরি হারা, বেকার এবং প্রয়োজনীয় পুঁজির অভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যে সংযুক্ত হতে পারছে না। কর্মসংস্থান সৃষ্টি, কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানোর ক্ষেত্রে আগামী বাজেটসহ পরবর্তী বাজেটগুলোতে সুস্পষ্ট নজরদারি থাকা উচিত। বিদেশেও আমাদের কর্মসংস্থান বর্তমানে কাক্সিক্ষত হারে বাড়ছে না। করোনাত্তোর পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া কর্মী নিয়োগের সুযোগ তৈরি হলেও আমরা এ ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে আছি। কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য বেসরকারি বিনিয়োগের প্রতি জোর দিতে হবে। এজন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এর ঋণ ব্যবস্থার তদারকি বাড়াতে হবে। ব্যাংকের কৃত্রিম আয় বন্ধ করে বিনিয়োগের হার বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকে আরও কার্যকর ভূমিকা পালন করা উচিৎ। কিছু ব্যবসায়ী আছেন, যারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা না দিয়ে পারা যায় কিনা, সে চিন্তা করেন। করোনার দোহাই, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ব্যবসা পরিস্থিতি ভালোনা এসব কথা বলে ব্যাংকের ঋণের টাকা দিতে গড়িমসি করে থাকেন। দেশের অর্থনীতিকে টেকসই করতে হলে ব্যবসায়িসহ সকলকেই সহযোগিতা করা উচিৎ। আমাদের প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটছে। কিন্তু ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের প্রসার তেমন ঘটেনি। অনেক ক্ষেত্রে আমরা এখন ও আমদানী নির্ভর। আমাদের অভ্যন্তরীণ অনুঘটকগুলোর প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া উচিৎ। করোনা মহামারী পরবর্তীতে আগামী ২০২২-২৩ অর্থ বছরের বাজেট অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তাই এ বাজেট গতানুগতিক না হয়ে ব্যতিক্রম বাজেট হওয়া উচিত। বাজেট হওয়া উচিত কর্মসংস্থান বান্ধব। দেশের মূল্যস্ফীতিকে সহনীয় পর্যায়ে রাখা, বৈষম্য কমানো, উৎপাদনশীলতা ও প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়ানোর কৌশল বাজেটে নিতে হবে। ব্যক্তিখাতের কর সীমা ৩ লাখ টাকা থেকে বাড়ানো প্রয়োজন। এনবিআর-এর তথ্য মতে, বর্তমানে ৭৮ লাখ টিআইএন ধারী রয়েছে। তাদের মধ্যে আয়কর রিটার্ন দাখিল করেন ৩৫ লাখ। আয় কর রিটার্ন সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি করের আওতা বাড়াতে হবে। স্বল্প আয়ের মানুষের উপর করের বোঝা না বাড়িয়ে, তাদের কষ্ট যাতে না বাড়ে সেদিকে খেয়াল রাখা দরকার। নিত্যপণ্যের উপরে ভ্যাট কমিয়ে ভ্যাটের আওতা বাড়ানো উচিত। কর সংগ্রহের পদ্ধতিগত উন্নয়ন করতে হবে। এনবিআর-এর সক্ষমতা বাড়াতে হবে। আমাদের আয় বুঝে ব্যয় করার বাজেট প্রণয়ন করতে হবে। আমাদের মাথাপিছু বিদেশী ঋণের বোঝা ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। ২০১৬ সালে জুন শেষে মাথা পিছু বিদেশী ঋন ছিল ২৫৭ মার্কিন ডলার। ২০২১ সালে ডিসেম্বরে তা বেড়ে দাড়ায় ৫৪১ ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৬ সালে জুন শেষে দেশি-বিদেশি ঋণ ছিল ৪ হাজার ১১৭ কোটি ডলার। ২০২১ সালে জুনে তা বেড়ে দাড়ায় ৮ হাজার ১৫৭ কোটি ডলার। ২০২১ সালে ডিসেম্বরে তা দাড়ায় ৯ হাজার ৭০ কোটি মার্কিন ডলার। অর্থনীতি ভিত টেকসই করতে হলে অভ্যন্তরীণ কৃষি, শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি, রপ্তানি বৃদ্ধিসহ ক্রমান্বয় আমদানী কমানোর পরিকল্পনা নিতে হবে। বিদেশী ঋণের বোঝা যাতে না বাড়ে সেদিকে নজর দিতে হবে। দ্রুততম সময়ে রপ্তানী বৈচিত্রকরণ ও বিদেশে বাজার সম্প্রসারণের প্রতি মনযোগ দিতে হবে। শুধু তৈরি পোশাকসহ গুটিকয়েক পণ্যের উপর নির্ভর না থেকে আরো বেশি কৃষি ও কৃষিজাত পণ্যসহ নতুন নতুন রপ্তানি পণ্যের সমারোহ ঘটাতে হবে। এবারের বাজেট প্রনয়ণের ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি কর্মসংস্থান বাড়ানো, বৈষম্য হ্রাস ও নিত্যপণ্যের দাম প্রান্তিক মানুষের সাধ্যের মধ্যে রাখার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ।

লেখকঃ ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
আকিব ১১ মে, ২০২২, ১:৩১ এএম says : 0
রাইট
Total Reply(0)
আকিব ১১ মে, ২০২২, ১:৩২ এএম says : 0
দেশে প্রচুর পরিমাণে শিক্ষিত বেকার রয়েছে। তাদেরকে কাজে লাগাতে পারলে সবার উন্নয়ন হবে। বিশেষ করে দেশ আরো উন্নত হবে
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন