ভারতে বসবাস করছে প্রায় দুই কোটি বেআইনি বাংলাদেশী। রাজ্যসভায় লিখিত প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছেন ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিরেন রিজিজু। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশী নাগরিকরা বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই ভারতে ঢুকছে বলে নানা সূত্রে খবর পাচ্ছে সরকার। যেহেতু নির্বিচারে চুপি চুপি ওদের অনুপ্রবেশ ঘটেই চলেছে, তাই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়া বাংলাদেশীদের ব্যাপারে সঠিক পরিসংখ্যান রাখা সম্ভব নয়। তবে এ ধরনের বেআইনি বিদেশী নাগরিকদের বের করে দেয়ার প্রক্রিয়াও লাগাতার চলছে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদি জানিয়ে ছিলেন যে, তিনি ক্ষমতায় গেলে ‘বাংলাদেশীদের’ বের করে দেয়া হবে। নির্বাচনী প্রচারসভায় তিনি বলেছিলেন, স্রেফ ভোট ব্যাংক হিসেবে ব্যবহার করতে ওদের লাল কার্পেট বিছিয়ে স্বাগত জানাচ্ছেন রাজনৈতিক নেতারা। কিন্তু ১৬ মে’র পর এ ধরনের বাংলাদেশীদের চলে যেতে হবে, তারা বাক্স-পেটরা গুছিয়ে তৈরি থাকুন। ১৬ মে চলে গেছে। বিপুল মেজরিটি নিয়ে বিজেপি ক্ষমতায় এসেছে। নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। কিন্তু তিনি নির্বাচনী বক্তব্য মোতাবেক বাংলাদেশীদেরকে তাড়িয়ে দিতে পারেননি। বিজেপি বহুদিন ধরেই দাবি করে আসছে যে, বেআইনি বাংলাদেশী অনুপ্রবেশের বোঝা সবচেয়ে বেশী বহন করতে হচ্ছে আসাম ও পশ্চিমবঙ্গÑ এই দুই রাজ্যকেই। তার অভিযোগ মোতাবেক আসামে ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৫ পর্যন্ত ছয় বছর ধরে বেআইনি অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছে। বিজেপি’র ২০১৪’র নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছিল, তারা সীমান্ত দেখভাল ব্যবস্থা খতিয়ে দেখে উন্নত করবে, বেআইনি অনুপ্রবেশ রোধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা চালু করা হবে। তারা অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বেআইনি অনুপ্রবেশ, অভিবাসনের সমস্যার দিকে নজর দেবে, স্পষ্ট নীতি তৈরি করে তৃণমূল স্তরে তা যথাযথভাবে রূপায়ণ করবে। কিন্তু এসব প্রতিশ্রুতির কোনটিই তারা পালন করেননি। আর করবে কোত্থেকে? অভিযোগগুলো সত্য হলে তো।
দুই কোটি বাংলাদেশী অনুপ্রবেশের খবর এবারই প্রথম শোনা গেলো না। এর আগে বিজেপি নেতা লাল কৃষ্ণ আদভানী যখন ভারতের উপ-প্রধানমন্ত্রী তখন তিনিও এই দুই কোটি বাংলাদেশী অনুপ্রবেশের অভিযোগ তুলেছিলেন। কিন্তু এই অভিযোগ কোনো দিন প্রমাণ করতে পারেননি। প্রমাণ করতে না পারলে কি হবে, অভিযোগটি তারা অব্যাহতভাবে করেই যাচ্ছেন। এবার অভিযোগের ধরন একটু আলাদা। সেটি করেছেন এবার ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রতিমন্ত্রী এবং এই ব্যাপারে তিনি একটি লিখিত বিবৃতিও ভারতীয় পার্লামেন্টের উচ্চ কক্ষ অর্থাৎ রাজ্যসভায় দিয়েছেন। সুতরাং এটি একটি অফিসিয়াল বক্তব্য তথা ডকুমেন্ট হিসেবে বিবেচনা করা যায়। যেহেতু এই বিবৃতিটি সরকারীভাবে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের পার্লামেন্টে দেয়া হয়েছে তাই এই সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকার নীরব থাকতে পারে না। বাংলাদেশ সরকারকেও অফিসিয়ালি এবং আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের বক্তব্য জানাতে হবে। বাংলাদেশ সরকারের বক্তব্য কি হবে সে বিষয়ে মনে হয় দেশের কোনো নাগরিকের মনে দ্বিতীয় চিন্তার কোনো অবকাশ নেই। সকলেই জানেন যে, এই অভিযোগটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। সেই কথাটিই বাংলাদেশ সরকার দৃঢ়তার সাথে পুনর্ব্যক্ত করবেন। কি বিএনপি সরকার, কি আওয়ামী লীগ সরকার, অতীতে প্রতিটি সরকারের আমলেই পুশ ইন ও পুশ ব্যাক নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। আসাম এবং পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশীরা বিপুল সংখ্যায় অনুপ্রবেশ করছে, এই রকম অভিযোগ ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার, আসাম রাজ্য সরকার এবং পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার করে গেছে। অবশ্য মমতা ব্যানার্জি পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় আসার পর থেকে এই পুশ-ইন তথা বাংলাদেশী অনুপ্রবেশের কথা শোনা যায়নি। কিন্তু আসাম থেকে এই অভিযোগ অতীতেও শোনা গেছে এবং আজও শোনা যাচ্ছে। তবে এবারে শুধু মাত্র আসাম ও পশ্চিমবঙ্গ নয়, বরং বাংলাদেশীরা সমগ্র ভারতে ছড়িয়ে পড়ছে বলে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অভিযোগ করেছেন। সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও বলা যায় যে, ভারতের অর্থনীতিতে এমন কোনো মধু নাই যার জন্য বাংলাদেশীরা ঝাঁকে ঝাঁকে ভারতে প্রবেশ করবে। ভারতের জীবন যাত্রার মানও বাংলাদেশের জীবন যাত্রার মানের চেয়ে কোনো অংশে উন্নত নয়। বরং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির যেসব সুযোগ-সুবিধা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের অনেকের দুয়ারে পৌঁছেছে, ভারতের অনেক অঞ্চলে সেসব সুযোগ-সুবিধা পেঁৗঁছায়নি। অন্যান্য প্রদেশের কথা বাদ দিয়ে তুলনামূলকভাবে উন্নত ব্যাঙ্গালুরুর কথাও যদি ধরা যায়, তাহলেও একই সূত্র বেরিয়ে আসে। গত নির্বাচনের সময় অনেক দল অভিযোগ করেছে যে, ভারতের প্রদীপের নিচেই অন্ধকার রয়েছে। অর্থাৎ কতগুলো শহর আলো ঝলমলে হলেও ঐসব রাজ্যের গ্রাম অঞ্চলে বিশুদ্ধ খাবার পানি নাই এবং স্যানিটারি সিস্টেম নাই। বাংলাদেশের প্রতিটি উপজেলা এখন পাকা সড়ক দিয়ে সংযুক্ত। এসব উপজেলায় বিদ্যুৎ পৌঁছেছে, বিশুদ্ধ খাবার পানি পৌঁছেছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই স্যানিটারি ল্যাট্রিন বসানো হয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে বেশী এগিয়ে না থাকলেও সামগ্রিকভাবে খুব একটা পিছিয়েও নাই। তাহলে কোন আকর্ষণে বাংলাদেশের মানুষ কোটিতে কোটিতে ভারতে যাবে? বেকার সমস্যায় বাংলাদেশ যতখানি জর্জরিত ভারত তারচেয়েও বেশী জর্জরিত। সুতরাং বাংলাদেশের মানুষ ভারতে বোঝার ওপর শাকের আঁটি হতে যাবে কেন?
এখন বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে উষ্ণ এবং মধুর। এই ধরনের ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলে সম্পর্কের উষ্ণতায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করা উচিত নয়। যদি অতীতের মতো ভারত এই সব অভিযোগ অব্যাহত রাখে তাহলে বন্ধুপ্রতীম দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। তার চেয়ে বরং এই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরো উন্নত করার জন্য দুই দেশের সম্পর্কে এখন যে সমস্ত প্রতিবন্ধকতা বিরাজমান, সেগুলো দূর করতে ভারত সরকারের সচেষ্ট হওয়া উচিত। তিস্তার পানি বণ্টন সমস্যা দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে আছে। নিষ্পত্তির কোনো আলামত নাই। মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঢাকায় এসেছিলেন। তিস্তা সমস্যার সমাধান হয়নি। সরকার বদল হয়ে গেছে। নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঢাকায় এসেছিলেন। তারপরেও সমস্যার সমাধান হয়নি। মমতা ব্যানার্জি দ্বিতীয় মেয়াদে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। তিস্তার সমাধান হয়নি। ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বা বিএসএফ গুলি করে বাংলাদেশীদেরকে মেরেই চলেছে। এখন আবার তাদের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মনোহর পারিকর ঢাকায় আসছেন। বলা হচ্ছে যে, বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান চীনা প্রভাব ঠেকাতেই তিনি ঢাকা আসছেন। এই ধরনের চিন্তা-ভাবনা বাদ দিয়ে তাদের উচিত, ভারত সম্পর্কে বাংলাদেশের অভিযোগ ও অনুযোগ দূর করার প্রতি বেশী করে নজর দেয়া। ভারতের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাংলাদেশী অনুপ্রবেশ নিয়ে যা বলেছেন সেটি ব্লেইম গেম ছাড়া আর কিছু নয়। অতীতে বলা হয়েছিল বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে সন্ত্রাসীদের ঘাঁটি রয়েছে। জবাবে বাংলাদেশ সরকার বলেছিলো যে, তোমরা বাংলাদেশে এসো। তোমাদেরকে হেলিকপ্টার দেয়া হবে। তোমরা হেলিকপ্টারে চড়ে সন্ত্রাসী ঘাঁটি খুঁজে বের কর। অনুপ্রবেশ ইস্যুতেও যদি বাংলাদেশ অনুরূপ অবস্থান গ্রহণ করে তাহলে এই ইস্যুতেও ভারত তার অভিযোগের পুনরাবৃত্তি ঘটাবেনা বলেই আমাদের বিশ্বাস।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন