যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের বাফেলো শহরের একটি সুপারমার্কেটে পেটন গেন্ড্রন নামের এক শ্বেতাঙ্গ তরুণের নির্বিচার গুলিবর্ষণে ১০ জন নিহত ও ৩ জন আহত হয়েছে। এই মর্মান্তিক ঘটনাকে নিউইয়র্ক পুলিশ ‘বর্ণবাদী সহিংস হামলা’ বলে বর্ণনা করেছে। পুলিশ বলেছে, ওই তরুণ বর্ণবাদে উৎসাহী হয়ে হামলার ঘটনাটি ঘটিয়েছে। সুপার মার্কেটটি কৃষ্ণাঙ্গ অধু্যুষিত এলাকায় অবস্থিত। হতাহতদের ১১ জনই কৃষ্ণাঙ্গ। পেটন গেন্ড্রনের হামলার লক্ষ্যবস্তু যে কৃষ্ণাঙ্গরাই ছিল, তা তার অনলাইনে পোস্ট করা লেখা থেকেই স্পষ্ট। ওই লেখায় বার বার বলার চেষ্টা করা হয়েছে, শ্বেতাঙ্গ মার্কিনীরা অন্য বর্ণের লোকজনের দ্বারা প্রতিস্থাপিত হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিস্ময়করই তত্ত্ব এই ‘প্রতিস্থাপন তত্ত্ব’ বা রিপ্লেসমেন্ট থিওরি’র কথা বলা হচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ম্যাস শুটিংয়ের পেছনে এই তত্ত্ব প্ররোচক হিসেবে কাজ করছে। শ্বেতাঙ্গ বিশ্বে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদের ধারণা বরাবরই ছিল। এখনো আছে। ক্রমাগত এ ধারণা রাজনীতি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করছে। শ্বেতাঙ্গ বিশ্বে উগ্র ডানপন্থীরা শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদকে রাজনীতির বিষয়বস্তু বানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ডোনাল্ড ট্রাম্প শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদকে পুঁজি করেই প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। গত নির্বাচনে ক্ষমতার পালাবদল ঘটলেও শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদভিত্তিক রাজনীতি সেখানে বহাল আছে। আগামীতে ট্রাম্প আবারো প্রেসিডেন্ট হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, শ্বেতাঙ্গ বিশ্বের সব দেশেই শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী রাজনীতিকে জনপ্রিয় করে তোলার পরিকল্পিত চেষ্টা চলছে। তথাকথিত প্রতিস্থাপন তত্ত্ব এ ক্ষেত্রে হাতিয়ার হিসেবে ভূমিকা রাখছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, যুক্তরাষ্ট্রে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ বা শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদ উদার, মানবিক, পারস্পারিক শ্রদ্ধাপূর্ণ ও সহনশীল সমাজব্যবস্থাকে দ্রুত ভেঙ্গে দিচ্ছে। তার স্থলে বিদ্বেষ, প্রতিহিংসা, জিঘাংসা প্রতিস্থাপিত করছে। এটা ওই দেশ ও সমাজের জন্য মোটেই শুভ নয়।
শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ কিংবা প্রতিস্থাপন তত্ত্ব একদিকে যেমন বিশ্বকে শ্বেতাঙ্গ ও অশ্বেতাঙ্গ রূপে বিভক্ত করেছে। অন্যদিকে তেমনি বর্ণবাদী সহিংসতা বা সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের বিস্তার ঘটাচ্ছে। শ্বেতাঙ্গ-অশ্বেতাঙ্গ বিরোধকে তুঙ্গ অবস্থানে নিয়ে যাচ্ছে। মানুষকে মানুষ হিসেবে নয়, সাদা বা কালো মানুষ হিসেবে পরিচিহ্নিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ২০১৯ সালে নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে দুই মসজিদে ৫১ জন মুসলিমকে হত্যা বর্ণবাদী হত্যাকাণ্ডের একটি বড় ঘটনা। অন্যান্য দেশে এবং যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া, টেক্সাসের এল প্যাসো প্রভৃতি স্থানে ইতোপূর্বে যেসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে তার মূলে রয়েছে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ ও প্রতিস্থাপনভীতি। শ্বেতাঙ্গ বিশ্বে শ্বেতাঙ্গপ্রীতি কোন পর্যায়ে উপনীত হয়েছে তা বুঝা যায় শরণার্থীদের প্রতি দ্বিমুখী নীতি ও আচরণে। লিবিয়া, সিরিয়া বা অন্যান্য মুসলিম দেশ থেকে ইউরোপে যাওয়া লোকদের দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তাদের প্রতি অমানবিক আচরণ প্রদর্শন করা হয়েছে। তাদের দুভোর্গ ও বিপন্নতার সীমা-পরিসীমা নেই। পক্ষান্তরে ইউক্রেন থেকে যুদ্ধের কারণে পালিয়ে আসা লাখ লাখ মানুষকে ইউরোপের দেশে দেশে স্বাগত জানানো হয়েছে। তাদের প্রয়োজনীয় আশ্রয় ও সহযোগিতা দেয়া হয়েছে। এই দ্বিমুখী নীতি অবস্থান এই জন্য যে, লিবিয়া-সিরিয়া ও অন্যান্য দেশের মানুষ অশ্বেতাঙ্গ এবং ইউক্রেনের মানুষ শ্বেতাঙ্গ। আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া, প্রভৃতি দেশে যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা আগ্রাসন চালিয়ে, যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে কত মানুষকে হত্যা করেছে, পঙ্গু করেছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। ওই সব দেশের কত সম্পদ লুট করেছে কিংবা ধ্বংস করেছে তারও কোনো হিসাব নেই। দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেশগুলো মুসলিম দেশ এবং তাদের অধিবাসীরা শ্বেতাঙ্গ নয়। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নাম করে আসলে মুসলিম দেশগুলোকেই টার্গেট করা হয়েছে এবং ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হয়েছে। দেশগুলো কবে নাগাদ আগের অবস্থা ও অবস্থানে যেতে পারবে, কেউ বলতে পারে না। শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের মধ্যে মুসলিম বিদ্বেষও রয়েছে ব্যাপকভাবে। এখানে কাজ করছে ইসলামোফোবিয়া বা ইসলামভীতি। ইসলামমোফোবিয়া কীভাবে কাজ করছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মুসলমানদের ওপর সন্ত্রাসী হামলা, বৈষম্য, অবিচার, নির্যাতন এবং সেইসঙ্গে পরিকল্পিত বিদ্বেষী প্রচারণা তার প্রমাণ বহন করে। শ্বেতাঙ্গ দেশেই নয়, অমুসলিম দেশেও মুসলমানরা সমানভাবে নিপীড়ন, নির্যাতন ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। ভারতের সঙ্গে মিয়ানমার, ইসরাইল প্রভৃতি দেশের কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। ভারতে মোদি সরকারের আমলে মুসলমানরা তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হয়েছে। কোনো কোনো রাজ্যে এই তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিকত্বও খারিজ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ভারতে মুসলমানরা বিজেপির উগ্র সাম্প্রদায়িকতার শিকার। তাদের ন্যূন্যতম নিরাপত্তারও নিশ্চয়তা নেই। মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা মুসলমানদের তো ব্যাপক হারে হত্যা ও বিতাড়ন করা হয়েছে। ফিলিস্তিনি মুসলমানেরা আগের মতই ইসরাইলি হত্যা-নির্যাতনের কবলে পড়ে আছে।
অস্বীকার করা যাবে না, যুক্তরাষ্ট্র এখনো বিশ্বে সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এক নম্বর দেশ। প্রভাব বিস্তারকারী দেশ হিসেবেও তার স্থান সর্বশীর্ষে। কিন্তু তার নীতি-অবস্থান প্রয়াশই দ্বিমুখী ও প্রশ্ন সাপেক্ষ। তার মুসলিমবিদ্বেষী চরিত্র যেমন স্পষ্ট, তেমনি বর্ণবাদী চরিত্রও খোলামেলা। শ্বেতাঙ্গ ইউক্রেনকে রক্ষা করার জন্য তার ঘুম নেই। সঙ্গী-সাথী নিয়ে সর্বোতভাবে চেষ্টা করছে যুদ্ধে ইউক্রেনকে সহযোগিতা করতে। অথচ, এর আগে অন্য কোনো দেশকে রক্ষা করার এমন দায়িত্ববোধ তার কাছে থেকে লক্ষ করা যায়নি। বহু দেশে যুদ্ধ, প্রাণহানি ও সম্পদধ্বংসের জন্য যুক্তরাষ্ট্র দায়ী। বলার অপেক্ষা রাখে না, যুক্তরাষ্ট্রে যেসব বর্ণবাদী হামলা ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে তার একটিও যদি কোনো মুসলমানের দ্বারা হতো তবে হৈ চৈ পড়ে যেতো। মুসলিমবিদ্বেষ আরো কয়েক ডিগ্রি বেড়ে যেতো। অথচ, বাফেলোর সুপারমার্কেটে হামলাকারীর পরিচয় প্রথমে পুলিশ প্রকাশ করতে চায়নি। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বজুড়ে মানবতা ফেরি করে বেড়ায়। কিন্তু তার নিজস্ব স্বার্থে মানবতাকে তুচ্ছজ্ঞান করতে তার এতটুকু বাঁধে না। বিশ্ববাসী বিশ্বের এক নম্বর দেশ হিসেবে পরিগণিত হওয়া দেশের কাছে তার ভাবমর্যাদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ আচরণই প্রত্যাশা করে। প্রকৃত মানবিক ও মানবতাবাদী দেশ হিসেবে তাকে দেখতে চায় মানুষ। যুদ্ধে ইউক্রেনকে উস্কানি দেয়া বাদ দিয়ে মানবকল্যাণে তার ব্রতী হওয়া বাঞ্ছনীয়। দেশের রাজনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও পরম্পরায় যে ধস এখন চলছে তা রোধ করাই তার প্রধান কর্তব্য হওয়া উচিত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন