বরিশাল কৃষি অঞ্চলসহ সারা দেশে ‘কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট’ উদ্ভাবিত উন্নত জাতের ভুট্টার আবাদ সম্প্রসারণের মাধ্যমে গবাদি পশুসহ হাঁস-মুরগি এবং মাছের খাবারের সাথে বিশাল জনগোষ্ঠীর পুষ্টি চাহিদারও বিকল্প উৎস হতে পারে। ব্যাপক চাহিদার প্রেক্ষিতে গত এক দশকে দেশে আবাদ ও উৎপাদন বাড়লেও ‘গ্রমিনী গোত্রের অধিক ফলনশীল দানা শষ্য’ ভুট্টা নিয়ে আরো মনযোগী হবার পরামর্শ দিয়েছেন মাঠ পর্যায়ের কৃষিবীদগণ।
কিন্তু বিষয়টি নিয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর-ডিএই’র মাঠ কর্মীসহ জেলা পর্যায়েও খুব একটা তৎপড়তা লক্ষ্যনীয় নয় বলে জানা গেছে। এখনো দেশে প্রায় ১ কোটি টন ভুট্টার চাহিদার প্রায় অর্ধেকই ভারত থেকে আমদানি হয়ে থাকে। ফলে ভুট্টার আমদানি ব্যয় মেটাতেও বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হচ্ছে। দেশে প্রতি বছর রবি ও খরিপ মৌসুমে ভুট্টার উৎপাদন প্রায় ৬০ লাখ টনের কাছে। এখনো দেশে এ ফসলের গড় উৎপাদন হেক্টর প্রতি ১০ টনের কম বেশি হলেও ‘বারি’ উদ্ভাবিত উন্নত জাতের বীজ ও সঠিক প্রযুক্তি ব্যবহারে তা অনায়সেই ১১ টনে উন্নীত করা সম্ভব বলে মনে করছেন কৃষিবীদগণ।
এমনকি অত্যন্ত সম্ভবনাময় এ ফসল রবি ও খরিপ মৌসুমে দুবার আবাদ হলেও আজ পর্যন্ত আবাদী জমির পরিমান ৬ লাখ হেক্টর অতিক্রম করেনি। গত বছর দেশে ৪ লাখ ৮৮ হাজার হেক্টরে প্রায় ৫০ লাখ টনের কাছে ভুট্টা উৎপাদন হয়েছে বলে ডিএই’র দায়িত্বশীল সূত্রে বলা হয়েছে। সদ্য সমাপ্ত রবি মৌসুমে প্রায় ৪ লাখ ৯০ হাজার হেক্টরে ৫০ লাখ টন ভুট্টা উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করেছেন কৃষি যোদ্ধাগণ। সে লক্ষ্যে প্রায় পৌঁছান সম্ভবও হয়েছে। ইতোমধ্যে ফসল ঘরে তোলাও সম্পন্ন হয়েছে। এখন চূড়ান্ত হিসেব কষছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর। এছাড়াও দেশে খরিপ মৌসুমেও আরো প্রায় ১ লাখ হেক্টরে আবাদের মাধ্যমে আরো ৬ থেকে ৭ লাখ টন ভুট্টা উৎপাদন হয়ে থাকে।
বিগত রবি মৌসুমে বরিশাল কৃষি অঞ্চলের ১১টি জেলাতেই প্রায় ১৪ হাজার হেক্টরে আবাদ সম্পন্ন হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্য ছিল ১ লাখ ৩৫ হাজার টনের মত। সে লক্ষ্যে পৌঁছানোর আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন ডিএই’র দায়িত্বশীল মহল। এর মধ্যে বরিশাল বিভাগের ৬টি জেলাতে ১০ হাজার ২৫ হেক্টরে এবং বৃহত্বর ফরিদপুরের পাঁচ জেলায় আরো প্রায় ৪ হাজার হেক্টরে ভুট্টার আবাদ হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্য ছিল বরিশাল বিভাগে প্রায় ১ লাখ টন এবং ফরিদপুর এলাকায় আরো প্রায় ৩৬ হাজার টন।
ফলত্বক ও বীজত্বক একইসাথে মিশ্রিত ভুট্টায় ধান ও গমের তুলনায় পুষ্টিগুন অনেক বেশি। এ দানা শষ্যে এ্যামিনো এসিড, ট্রিপটোন ও লাইসিন সমৃদ্ধ প্রায় ১১% আমীষ জাতীয় উপাদান রয়েছে। কৃষি বিজ্ঞানীদের মতে, হলদে রঙের প্রতি ১শ’ গ্রাম ভুট্টা দানায় ৯০ গ্রাম পর্যন্ত ক্যরোটিন বা ‘ভিটামিন-এ’ রয়েছে।
শীত মৌসুমের বাইরে গ্রীষ্মকালেও আমাদের দেশে ভুট্টার আবাদ হচ্ছে। দুটি মৌসুম মিলে এর উৎপাদন ৫৬-৫৭ লাখ টনের মতো হলেও কিছু উদ্যোগ নিলে তা অনায়াসেই ৭০ লাখ টনে উন্নীত করা সম্ভব বলেও মনে করেন কৃষি বিজ্ঞানীগণ। যা আমাদের বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য বিকল্প খাদ্য চাহিদা মেটাতেও সক্ষম। পাশাপাশি ভুট্টা উন্নতমানের হাঁস-মুরগী, মাছ ও গবাদিপশুর খাদ্য উৎপাদনেও যথেষ্ঠ সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। এমনকি উন্নত বিশে^ ভুট্টা বেকারী শিল্পের অন্যতম উপাদান হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে। আমাদের দেশেও ১/১১ সরকারের সময় ভুট্টার আটা প্রচলন শুরু হলেও পরে তা স্তিমিত হয়ে যায়।
বেলেÑদোআঁশ ও দোআঁশ মাটি ভুট্টা চাষের জন্য যথেষ্ঠ উপযোগী। এমনকি দক্ষিণাঞ্চলসহ উপকূলীয় এলাকার নদ-নদী তীরবর্তি চরাঞ্চলের মাটি ভুট্টা চাষের জন্য যথেষ্ঠ সহায়ক বলে জানিয়েছেন কৃষি বিজ্ঞানীগণ। ভাল ফলন পেতে পরিমিত সার প্রয়োগের পাশাপাশি ভুট্টার জমিতে ৪টি সেচ প্রদানের কথা জানিয়ে যেন পানি আটকে না যায় সেদিকেও মনযোগী হতে বলেছেন কৃষি বিজ্ঞনীগণ। এমনকি উপকূলীয় লবনাক্ত এলাকায় আমন ফসল ঘরে তোলার পরে গোখাদ্য হিসেবেও ভুট্টা আবাদের কথা বলেছেন বারি’র বিজ্ঞনীগণ। এতে ঐসব এলাকার গোখাদ্য চাহিদা বাহুলাংশেই মেটান সম্ভব হতে পারে।
কৃষি বিজ্ঞানীদের মতে, ভুট্টার জীবনকাল দীর্ঘ বিধায় আরো কয়েকটি ফসলও ভুট্টার সাথে আবাদ করা সম্ভব। এমনকি আমাদের কৃষি বিজ্ঞানীগন ভুট্টার সাথে চিনাবাদাম, মাসকালাই, সয়াবিন ও গোল আলুসহ বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজিসহ নানা ধরনের আন্তঃফসল আবাদের প্রযুক্তিও উদ্ভাবন করেছেন। বিনা চাষে সেচের মাধ্যমেও ভুট্টা আবাদের কথা বলেছেন কৃষি বিজ্ঞানীগণ। ভুট্টায় রোগবালাই ও পোকার আক্রমন তুলনামূলকভাবে কম বিধায় বলাইনাশকের প্রয়োগ সিমিত হওয়ায় উৎপাদন ব্যয়ও কমিয়ে আনা সম্ভব। তবে বারীর এসব প্রযুক্তিসহ উচ্চ ফলনশীল বীজ মাঠ পর্যায়ে কৃষকের কাছে পৌঁছানোর কোনো বিকল্প নেই। দেশে রবি ও খরিপ মৌসুমে দুবার ভুট্টার আবাদ হলেও রবি মৌসুমেই এর আবাদ ও উৎপাদন বেশি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন