আগামী নির্বাচন অর্থাৎ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের এখনো এক বছর ৭ থেকে ৮ মাস বাকি। কিন্তু এর মধ্যেই ঐ নির্বাচন নিয়ে সরকারি দল এবং বিরোধী দলসমূহের মধ্যে যে বাকযুদ্ধ শুরু হয়েছে তার ফলে পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় সেটা এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কিছুটা আঁচ করা যায়। এই আঁচ অনুমানের শেষে দেখা যায় একটি অশনি সংকেত।
প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এবং অন্যান্য ৯/১০টি বিরোধী দল বেশ কয়েক মাস আগে থেকেই বলছে যে, দলীয় সরকারের অধীনে অর্থাৎ বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে তারা কোনো নির্বাচনে যাবে না। মাস ছয়েকেরও বেশি হলো তারেক রহমান লন্ডন থেকে ভার্চুয়াল মাধ্যমে বিএনপির স্ট্যান্ডিং কমিটি থেকে শুরু করে একেবারে তৃণমূল পর্যন্ত সকল স্তরের নেতা ও কর্মী সাথে কথা বলেন। তিনি জানতে চান যে, তারা এই সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে চান কিনা। ৯৫ শতাংশ নেতা ও কর্মী একসুরে জবাব দেন যে, তারা বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে যেতে চান না। সমস্ত পর্যায়ের নেতাকর্মীর মতামত গ্রহণের পর ভার্চুয়াল মাধ্যমে স্ট্যান্ডিং কমিটির বৈঠক হয়। এই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন তারেক রহমান। সভায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে, বিএনপি এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবে না। তারা নির্বাচনকালীন একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন করবে। সেই নিরপেক্ষ সরকারের জন্য তারা অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দলের সাথে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করবে এবং রাজপথের আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটাবে।
এই সিদ্ধান্তের পর ছয় মাসের বেশি অতিক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু বিরোধী দলসমূহের এই ঐক্যের কোনো আলামত এখনো পাওয়া যায়নি। বৃহস্পতিবার আমি এই কলাম লেখা শুরু করেছি। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত কোনো বিরোধী দলের ‘আনুষ্ঠানিক’ বৈঠক হয়নি। পাঠক, লক্ষ করবেন যে, আমি বলেছি যে, আনুষ্ঠানিক কোনো বৈঠক হয়নি। টেলিফোনে অন্যান্য বিরোধী দলের কোনো কোনো নেতাকে হয়তো ‘হাই-হ্যালো’ করেছেন। একজন আরেকজনের বাসায় হয়তো গিয়েছেন। হয়তো এক কাপ চা খেয়েছেন। তাদের গল্পে রাজনীতিও হয়তো এসেছে। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। কোনো দলের সাথে এখন পর্যন্ত জোট গঠনের বা আন্দোলনের কর্মসূচি কী হবে সেটি নিয়ে ইনফরমাল আলোচনা হয়তো করেছেন। ব্যাস, ঐ পর্যন্তই।
২০১৮ সালের আগে গঠিত হয়েছিল ২০ দলীয় জোট। ২০১৮ সালে ইলেকশনের পূর্বাহ্নে গঠিত হয়েছিল ঐক্যফ্রন্ট। ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পর দেখা গেল, ২০ দলীয় জোট তলে পড়ে গেছে। ২০২১ সাল থেকে শুরু করে ২০২২ সালের এই মে মাস পর্যন্ত শুধুমাত্র ঐক্যের কথাই শোনা গেছে। বহুবার বিএনপির অত্যন্ত সিনিয়র নেতারা বলেছেন, গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী সরকারকে বিদায় দেওয়া হবে। কিন্তু বিগত দেড় বছরেও গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি বা বৃহত্তর ঐক্য গড়ার কোনো প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়নি। বিএনপি নেতারা তো হ্যামিলনের বংশীবাদক নন যে, বাঁশিতে ফুঁ দিলেই জনগণ পিলপিল করে ঘর থেকে বের হয়ে এসে গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করবেন। অথবা বাঁশিতে ফুঁ দিলেই নিজ নিজ অফিস থেকে বিরোধী দল পিলপিল করে বেরিয়ে আসবে এবং বিএনপির পেছনে কাতারবন্দী হয়ে বৃহত্তর ঐক্য সৃষ্টি করবে।
॥দুই॥
প্রধান বিরোধী দলের এই শামুকের গতিতে এগিয়ে চলা দেখে ছোট ছোট কয়েকটি দল একটি জোট গঠনের চেষ্টা করছে। এই চেষ্টা তারা এ বছরের প্রায় শুরু থেকেই করতে শুরু করেছে, যখন থেকে করোনার প্রকোপ কমা শুরু হয়েছে। তবে এপ্রিল এবং মে এই প্রচেষ্টা জোরদার হয়েছে। গত ২৫ এপ্রিল একটি জাতীয় দৈনিকের রিপোর্ট: আগামী নির্বাচন ও সম্ভাব্য রাজনৈতিক কর্মসূচি সামনে রেখে নতুন একটি রাজনৈতিক জোট গঠনের আলোচনা শুরু হয়েছে। বিএনপি ছাড়া অন্যান্য বিরোধী দল এই আলোচনায় অংশ নেয় বলে জানা গেছে। যদি তারা জোট করে তাহলে সেখানে থাকবে আ স ম আব্দুর রবের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি, মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্য, জোনায়েদ সাকীর গণসংহতি আন্দোলন, সাইফুল হকের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, রেজা কিবরিয়ার গণঅধিকার পরিষদ, ডা. জাফরুল্লাহর ভাসানী অনুসারী পরিষদ এবং রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন। বিএনপি সরাসরি এই জোটে না থাকলেও আন্দোলন সংগ্রামে সবাই একসাথে মাঠে থাকবে। সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে যারা মাঠে সরব থাকবে তাদের সাথে আলোচনা করে বিএনপি আন্দোলনের একটি রূপরেখা তৈরি করছে। এই আন্দোলনের রূপরেখা বিএনপি ইতোমধ্যেই তৈরি করা শুরু করেছে। চলতি মাসের মধ্যেই সেই রূপরেখা তৈরির কাজ সমাপ্ত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সহযোগী দৈনিকের খবরে বলা হয়েছে, একটি জোট বা একাধিক জোট হোক না কেন, সেইসব জোট এবার নির্বাচনমুখী না হয়ে হবে আন্দোলনমুখী। মূলত দুইটি লক্ষ্যকে সামনে নিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো কাছাকাছি আসছে। ১নং হলো, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ। ২নং, আওয়ামী সরকারের অপসারণের পর নির্বাচন করার জন্য একটি নির্দলীয় সরকার গঠন।
নির্বাচনকালীন সরকারের মেয়াদ কতদিন হবে, অথবা নির্বাচনের পর বিরোধী দল জয়লাভ করলে কীভাবে কাদেরকে নিয়ে সরকার গঠিত হবে সে সব বিষয়ও আলোচনায় উঠে আসছে। সে সম্পর্কে বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী দলের মধ্যে মতদ্বৈধতা রয়েছে। আবার তাদের মধ্যেই এই পর্যায়ে প্রশ্ন উত্থাপনকে অপ্রসাঙ্গিক না বললেও প্রিম্যাচিওর বা অপরিপক্ক বলে মনে করা হচ্ছে।
জোট অথবা ঐক্য প্রক্রিয়ায় জামায়াতে ইসলামীর অবস্থান কী হবে সেটি নিয়েও তাদের মধ্যে আলোচনা চলছে। সাতটি দলের মধ্যে দুইটি দলের জামায়াত সম্পর্কে এলার্জি রয়েছে। জামায়াতকে নিলে অন্য দুটি দলের কোনো আপত্তি নাই। তবে সে কথাটি তারা মুখ ফুটে বলতে রাজি নয়। তবে জামায়াতের ব্যাপারে সমস্যা খোদ বিএনপিতে। বিএনপির একটি অংশ জামায়াত সম্পর্কে আওয়ামী লীগের মনোভাব পোষণ করে। তারা মনে করে যে, মুক্তিযুদ্ধকালে তাদের ভূমিকার কারণে জামায়াত একটি লায়াবিলিটি। অপর অংশ মনে করে, ঐগুলো তো অর্ধশতাব্দী আগের ঘটনা। এছাড়া আওয়ামী লীগ সরকার বিগত ১৩ বছরে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি দেওয়াসহ অনেক কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। যাদের বিরুদ্ধে আওয়ামী সরকার ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেছিল তাদেরকে সর্বোচ্চ শাস্তি দিয়েছে। এরপর জামায়াতের বিরুদ্ধে আর তো নতুন কোনো অভিযোগ শোনা যাচ্ছে না।
॥তিন॥
বিএনপির আরেকটি অংশ মনে করে যে, আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ বা অপসারণের কথা মুখে বলা যত সহজ, সেটি কাজে পরিণত করা ততোই কঠিন। আওয়ামী সরকারের উদ্যোগেই ত্রয়োদশ সংশোধনী বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হয়েছে। বর্তমান সংসদ বহাল রেখে আরেকটি সংসদ নির্বাচনের বিধি-বিধান আওয়ামী লীগ সরকারই চালু করেছে। এটা ছেলের হাতের মোয়া নয় যে, দুই-একটি সমাবেশ এবং দুই-একটি মিছিল করলে শেখ হাসিনার সরকার চলে যাবে। ২০১৮ সালের দিনের ভোট রাতে হওয়ার পর ৩ বছর ৫ মাস পার হয়ে গেল। বিএনপি এই সাড়ে তিন বছরে একটি বড় জনসভাও করতে পারেনি অথবা একটি মিছিলও করেনি বা করতে পারেনি। তাহলে এখন তার নেতারা কীভাবে, কোন শক্তিতে বলছেন যে, এই সরকারের অবস্থা শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী রাজাপাকসে এবং তার মন্ত্রী এবং এমপিদের মত হবে? সরকার পালাবার পথ পাবে না, এই ধরনের আওয়াজও তো মানুষ বিগত ২/৩ বছর হল শুনছে। কিন্তু দেখা গেল, তারা নিজেরাই ঘর থেকে বের হতে পারছেন না। তারা রাস্তায় দাঁড়াতেই পারছেন না।
আন্দোলনের প্রশ্ন তুললে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আমরা তো আন্দোলনে আছিই। আমরা তো বিগত ৩ বছর হলো আন্দোলন করে যাচ্ছিই। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে মির্জা ফখরুল কি এগুলোকে আন্দোলন বলেন? নয়াপল্টনে এবং গুলশান অফিসের প্রেস কনফারেন্সকে যদি তিনি আন্দোলন বলেন তাহলে আন্দোলনের সংজ্ঞাই পাল্টে দিতে হয়। মাঝে মাঝে মানববন্ধন আর আলোচনা সভাকে যদি আন্দোলন বলা হয় তাহলে আন্দোলন সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করতে আমাদের নতুন করে লেখাপড়া করতে হবে। অথচ, তারা যখন প্রেসক্লাবের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ ডাকেন, তখন বেশ কয়েক হাজার মানুষ হয়। সেই বিএনপির অবিসংবাদিত নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে যেদিন কারাগারে নেওয়া হলো সেদিন তার হাজার ভক্ত ও অনুগামী তাকে অনুসরণ করলেন, কিন্তু কোনো বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হলো না। এর কারণ আজও অনুদঘাটিতই রয়ে গেল।
॥চার॥
শনিবার এই লেখাটি শেষ করছি। রাতেও ইন্টারনেট ভিজিট করলাম। কিন্তু বিরোধী দলসমূহের ঐক্যের কোন খবর দেখলাম না। শুধু দেখলাম, গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন যে, ঐক্য জোটের এবং আন্দোলনের রূপরেখা এবং পরবর্তী করণীয় নিয়ে একটি শ্বেতপত্র বা পরিপত্র তৈরি হচ্ছে এবং শীঘ্রই তা প্রকাশ করা হবে। তবে এবার বিএনপি বাইরে থেকে নেতা ইমপোর্ট করবে না। অর্থাৎ সকলের মাথার ওপর আরেক ড. কামাল হোসেনকে চাপিয়ে দেবে না। কী হবে সেটি তো পরিষ্কার নয়।
আওয়ামী লীগের ইলেকশন স্ট্র্যাটেজি পরিষ্কার হওয়া শুরু হয়েছে। ৭ মে দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, (১) আওয়ামী লীগ ১৪ দলকে সাথে নিয়ে ইলেকশন করতে চায় (২) ৩০০টি আসনেই ইভিএমের মাধ্যমে ভোট হবে এবং (৩) এবার বিদেশিরা ইলেকশনে একটি ফ্যাক্টর হবে। তাই আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদেরকে বিদেশি বন্ধুদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে (ডেইলি স্টার, প্রথম পৃষ্ঠা, প্রধান সংবাদ, ৮ মে ২০২২)।
এখন বিএনপিকেও তার স্ট্র্যাটেজি প্রকাশ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, আওয়ামী লীগ কিন্তু এরশাদের মতো জাতীয় পার্টি নয়। তারাই কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা আদায় করেছিল। আবার তারাই সেই কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছে। এ যেন ‘হাকিম হইয়া হুকুম করো, ওজা হইয়া ঝাড়ো’। তার সাথে রাজনৈতিক টক্কর দিতে হলে সেয়ানে সেয়ান হতে হবে। সামনের দিনগুলি বিএনপি এবং বিরোধী দল সমূহের জন্য অগ্নিপরীক্ষা। ইংরেজিতে লিটমাস টেস্ট।
Email: journalist15@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন