আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার বাড়ছে। তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনায়ও এর ব্যবহার লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এতে দেশজুড়ে মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার পাশাপাশি অনিরাপত্তাবোধও বাড়ছে। প্রধানত অবৈধ অস্ত্রই ব্যবহৃত হচ্ছে। ব্যবহারকারীদের মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সংখ্যাই বেশি। তারা রীতিমত বেপরোয়া। একইসঙ্গে চিহ্নিত এবং উঠতি সন্ত্রাসীরাও অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার করছে আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশী। কে যে কখন অস্ত্রবাজদের শিকারে পরিণত হবে, বলা মুশকিল। গত কিছুদিন ধরে ক্ষমতাসীন দল ও তার বিভিন্ন সংগঠনের একশ্রেণীর সদস্য অভ্যন্তরীণ কোন্দলের সুবাদে পরস্পরের বিরুদ্ধে অবৈধ অস্ত্র ব্যবহারে রীতিমত উন্মত্ত হয়ে পড়েছে। এ নিয়ে দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ যেমন তেমনি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যেও এক প্রকার বিচলন দেখা দিয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে এই অভ্যন্তরীণ কোন্দলজাত সন্ত্রাস, হানাহানি, অস্ত্র প্রদর্শন ও ব্যবহার এবং রক্তপাত এমনভাবে বেড়ে গেছে যে, তার অনুপুঙ্খ বিবরণ দেয়ার প্রয়োজন নেই। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবরাখবরই এ জন্য যথেষ্ট। একটি বেসরকারী সংস্থার হিসাবে বলা হয়েছে, গত সাড়ে সাত বছরে কেবল ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে নিহত হয়েছে ৫৫ জন। এ হিসাব ২০১৪ সাল পর্যন্ত। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত যে কতজন নিহত হয়েছে তার পরিসংখ্যান হাতের কাছে না থাকলেও আন্দাজ করতে অসুবিধা হয় না। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী ও অপরাধীদের গুলিতে বহু মানুষ হতাহত হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে হতাহতের সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়। অমূল্য জীবন কতটা মূল্যহীন হয়ে পড়েছে, এ থেকেই তা সম্যক উপলব্ধি করা যায়।
রাজনৈতিক কর্মীদের হাতে এত অবৈধ অস্ত্রের সমাবেশ কিভাবে ঘটলো সেটা যেমন একটা বড় প্রশ্ন, তেমনি সন্ত্রাসী-অপরাধীদের দৌরাত্ম্য এতটা বৃদ্ধি পেলো কিভাবে সেটাও কম বড় প্রশ্ন নয়। বিচারহীনতা এর প্রধান কারণ বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। রাজনৈতিক কর্মী নামধারী ও সন্ত্রাসী-অপরাধীরা যা কিছুই করছে, বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, তাদের কিছুই হচ্ছে না। এখানে একথাটিও বলে রাখা দরকার, পেশাদার সন্ত্রাসী-অপরাধীরা কোনো না কোনোভাবে রাজনৈতিক প্রশ্রয় বা ছত্রছায়া পাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। রাজনৈতিক কর্মীরা যখন অভ্যন্তরীণ হানাহানিতে লিপ্ত হয়, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তখন হয় নীরব থাকে, না হয় নিরপেক্ষতা অবলম্বন করে। তাদের সাহস হয় না অস্ত্রবাজদের গ্রেফতার করার। অন্যদিকে সন্ত্রাসী-অপরাধীদের গ্রেফতার করার পর দেখা যায় নানামুখী তদবির। অনেক সময় চাপে পড়ে তাদের ছেড়ে দিতে হয় কিংবা আইনের ফাঁক-ফোঁকর গলিয়ে তারা বাইরে চলে যায়। এমতাবস্থায়, হত্যা, সন্ত্রাস ও অপরাধ দমন, দায়ী লোকদের গ্রেফতার ও বিচারে সোপর্দ করার বিষয়ে বড় রকমের ভাটার টান দেখা দিয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীতে যে ব্যাপক দলীয়করণ হয়েছে তাতে রাজনৈতিক কর্মী নামের ক্যাডার-অস্ত্রবাজরা এক ধরনের ‘দায়মুক্তি’ ভোগ করছে। অন্যদিকে পেশাদার সন্ত্রাসী-অপরাধীরাও এক ধরনের সুবিধা ভোগ করছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর একশ্রেণীর কর্মকর্তা ও সদস্যের বিরুদ্ধেও অনিয়ম, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। প্রকৃত অবস্থা যদি এই হয়, তবে সুষ্ঠু আইন-শৃঙ্খলা ও নাগরিক নিরাপত্তা কিভাবে নিশ্চিত হতে পারে ?
অবৈধ অস্ত্র কিভাবে আসছে এবং কিভাবে সে অস্ত্র রাজনৈতিক কর্মী ও সন্ত্রাসীদের হাতে চলে যাচ্ছে, এ প্রসঙ্গে সে প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়। এ কথা সবাই বোঝে, অবৈধ অস্ত্র যদি না আসে এবং ‘বাজারজাতকরণে’র ব্যবস্থা যদি মসৃণ না হয়, তাহলে হাতে হাতে ওই অস্ত্র চলে যাওয়ার কোনো কারণ থাকতে পারে না। এ খবর কারো অজানা নেই, সীমান্ত পথে বিশেষ করে ভারত সীমান্ত দিয়ে অবাধে অবৈধ অস্ত্র অনুপ্রবেশ করছে। অবৈধ অস্ত্রের কারবারিরা সেই অস্ত্র একটি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে দিচ্ছে। বিজিবি অস্ত্রের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে পারছে না। ক’দিন আগে বিজিবি’র সদ্য সাবেক প্রধান এ ব্যাপারে তাদের অসহায়ত্বের কথা জানিয়েছেন। অন্যদিকে পুলিশ বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দেশের অভ্যন্তরে অস্ত্র চলাচল রোধ করতে পারছে না। ফলে অবৈধ অস্ত্র যত বাড়ছে তার ব্যবহারও তত বাড়ছে। সুষ্ঠু আইন-শৃঙ্খলা ও নাগরিক নিরাপত্তা বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্য, উন্নয়ন-অগ্রগতিÑ সবকিছুই পূর্বশর্ত। আইন-শৃংখলা স্বাভাবিক ও সুষ্ঠু না হওয়ায় এবং নাগরিক নিরাপত্তা চরম অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় বর্ণিত সকল ক্ষেত্রেই নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থেই অবৈধ অস্ত্রের অনুপ্রবেশ ও ব্যবহার রোধ করা অপরিহার্য। এ ব্যাপারে সর্বাগ্রে এই সিদ্ধান্তে আসতে হবে যে, অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার যেই করুক, তার রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিচয় যাই থাকুক, রেহাই দেয়া হবে না। তাকে ধরা হবে এবং আইনের হাওলা করে দেয়া হবে। এটি প্রথমত, একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়, দ্বিতীয়ত, সরকারী সিদ্ধান্তের বিষয়। এর পাশাপাশি সীমান্ত পথে অবৈধ অস্ত্রের অনুপ্রবেশ যে কোনো মূল্যে রোধ করতে হবে। অস্ত্র ব্যবসায়ীদের দেশব্যাপী নেটওয়ার্ক গুঁড়িয়ে দিতে হবে। এ দায়িত্ব বিজিবি ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে পালন করতে হবে। বৈধ অস্ত্রের হিসাব-নিকাশ এবং তা অবৈধ কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে কিনা, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে সেটাও দেখতে হবে। রাজনৈতিক বিবেচনা ও তদবিরে যাদের অস্ত্রের লাইসেন্স দেয়া হয়েছে, তাদের লাইসেন্স বাতিল করতে হবে। এভাবেই অবৈধ অস্ত্রের বা বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহারের হুমকি প্রতিহত করা সম্ভব হতে পারে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন