সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন করার দাবী ও সুপারিশ বেশ জোরালো হয়ে উঠেছে। দেশের প্রধান বিরোধী দল তো বটেই, নাগরিক সমাজ এবং সংবিধান বিশেষজ্ঞরাও এ নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য জোর তাকিদ দিচ্ছেন। সর্বশেষ ইউরোপীয় পার্লামেন্টের (ইপি) প্রতিনিধি দল সুপারিশ করেছে। বাংলাদেশে ৫ দিনের সফর শেষে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু করতে উপযুক্ত গণতান্ত্রিক পন্থায় শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনের সুপারিশ করেন তারা। প্রতিনিধি দলের প্রধান ইউরোপীয় পার্লামেন্টের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কমিটির সভাপতি বারন্ড লাঙ্গা সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বাংলাদেশ আগামী সাধারণ নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য এ সময়ে নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। নির্বাচন কমিশন গঠনে অবশ্যই উপযুক্ত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া মেনে চলতে হবে। নির্বাচন কমিশন এমনভাবে হওয়া উচিত যাতে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হতে পারে। বাংলাদেশের সাংবিধানিক একটা প্রক্রিয়া আছে। তবে ইউরোপে সাধারণত সব দলের বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশেও সরকারের বাইরের বিরোধী রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজ থেকে বরাবরই দলমত নির্বিশেষে সকলের মতামতের ভিত্তিতে একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠনের কথা দীর্ঘ দিন ধরে বলা হচ্ছে। বাস্তবতা হচ্ছে, এর কোনো প্রতিফলন নেই। সবসময়ই নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে থাকার অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে।
স্বাধীনতার পর থেকে দীর্ঘ ৪৫ বছরেও বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন করা সম্ভব হয়নি। এটা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়। অথচ গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের বিকল্প নেই। দেখা গেছে, যারাই ক্ষমতায় থাকেন তারা গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে নয়, পুনরায় ক্ষমতায় আসা নিশ্চিত করতে তাদের অনুগত লোকজন নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করেছে। ফলে কয়েকটি নির্বাচন বাদে এমন কোনো নির্বাচন নেই, যার সুষ্ঠুতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে বিরোধী দলসহ নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে অভিযোগ উঠেনি। এমনকি প্রধান নির্বাচন কমিশনার যারা থাকেন, তাদের নাম ব্যঙ্গ করে উচ্চারিত হয়েছে এবং হচ্ছে। বিশ্বের আর কোথাও এমন নজির আছে কিনা, আমাদের জানা নেই। এখন অভিযোগ উঠেছে, আইন প্রণয়ন ছাড়াই নির্বাচন কমিশন নিয়োগ দেয়ায় সংবিধান লংঘিত হচ্ছে। সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদে স্পষ্ট করেই বলা আছে, নির্বাচন কমিশন সংক্রান্ত আইনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। সংবিধানের এ ধারা মেনে আজ পর্যন্ত আইন তৈরি করা হয়নি। যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, সেই সরকার সুবিধামতো ও অনুকূলে থাকা ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করেছে। বিভিন্ন আমলে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক উঠলেও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারীর জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের যে চরম বিতর্কিত ভূমিকা, তা অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে বলে ইতোমধ্যে অভিযোগ উঠেছে। অনেকের মতে, বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন মেরুদ-হীন নির্বাচন কমিশন আগে কখনো আসেনি। অথচ সরকার সার্চ কমিটির মাধ্যমে এ নির্বাচন কমিশন গঠন করেছিল। বলা হয়ে থাকে, সার্চ কমিটি বেছে বেছে সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকা ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করেছে। বাস্তবেও বর্তমান নির্বাচন কমিশনের নির্বাচন পরিচালনা সংক্রান্ত কর্মকা-ে তার প্রতিফলন ঘটেছে বলে পর্যবেক্ষকরা বারবার বলেছেন। এ প্রেক্ষাপটে বহুল বিতর্কিত এই নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ আগামী বছরের ফেব্রুয়ারীর প্রথম সপ্তাহের দিকে শেষ হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলসহ নাগরিক সমাজের মধ্যে যথেষ্ট উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা কাজ করছে। যদি এই নির্বাচন কমিশনের মতো বা তার চেয়েও আরও মন্দ নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়, তাহলে দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিতভাবেই বিনষ্ট হবে এবং গণতন্ত্রকে অধিক নাজুক করে তুলবে। ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে সংসদের বাইরে থাকা প্রধান বিরোধী দল ও নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে সবদল ও বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করার দাবী উঠেছে। প্রধান বিরোধী দল নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে তাদের মতামত তুলে ধরার একটি নীতিমালাও প্রস্তুত করেছে এবং তা সবার সামনে উত্থাপন করা হবে বলে ইতোমধ্যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এর বিপরীতে সরকারের তরফ থেকে সাফ জানিয়ে দেয়া হয়েছে, গতবারের মতো সার্চ কমিটির মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন। বর্তমান বিতর্কিত নির্বাচন কমিশনের মতো নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করা নিয়ে সরকারের এমন ঘোষণা স্বাভাবিকভাবেই বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকেও সরকারের এই একতরফা সিদ্ধান্তের বিরোধিতা এবং সমালোচনা করে বিশ্লেষণমূলক বক্তব্য-বিবৃতি দেয়া হচ্ছে। এমনকি আগের পদ্ধতিতে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হলে আদালতে রিটের মাধ্যমে আইনি জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে বলে তারা মনে করছেন। এ অবস্থায় ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রতিনিধি দলও তাদের সাথে সুর মিলিয়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন করার কথা বলেছে।
আমরা মনে করি, সুষ্ঠু ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা কায়েমে নিরপেক্ষ এবং শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন অপরিহার্য। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরও এ ধরনের একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করতে না পারা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য অসম্মানের। দেরিতে হলেও গণতন্ত্র ও সুষ্ঠু রাজনৈতিক সংস্কৃতির স্বার্থে শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন করা নিয়ে আর কাল বিলম্ব করা উচিত নয়। এখানে গোয়ার্তুমি কাম্য হতে পারে না। এ ব্যাপারে ক্ষমতাসীন দলসহ সকল বিরোধী রাজনৈতিক দলকে আন্তরিক হতে হবে। এমন একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে, যে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে ন্যায়ানুগ আচরণ করবে। সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে রাজনৈতিক নীতি-আদর্শ নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, তবে নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক থাকা বাঞ্ছনীয় নয়। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় নিয়ে বিতর্ক ও প্রতিবাদ হচ্ছে ঠিকই, তবে নির্বাচন কমিশন এবং তার প্রক্রিয়া নিয়ে কোনো বিতর্ক উঠেনি। পার্শ্ববর্তী ভারতেও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন থাকায় নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে কোনো বিতর্ক হয় না। আমরা কথায় কথায় উন্নত বিশ্বের গণতন্ত্র এবং তা প্রয়োগের কথা বলি। এটা বলি না, তাদের এ গণতন্ত্র শক্তিশালী হয়েছে, শক্তিশালী, সক্ষম ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের কারণে। তাদের দৃশ্যমান গণতন্ত্রের কথা বললেই হবে না, এর মূল উৎপত্তিস্থল নির্বাচন কমিশনের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে এবং তা বিবেচনায় নিতে হবে। আমরা আশা করব, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে সরকার সব দল ও মতের সম্মিলনে একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন করতে উদ্যোগ নেবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন