বৃহস্পতিবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সারা বাংলার খবর

কৃষিপণ্য ও শ্রমের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে

নীলকন্ঠ আইচ মজুমদার | প্রকাশের সময় : ২৪ মে, ২০২২, ১২:০৫ এএম

কৃষি প্রধান আমাদের এই বাংলাদেশ যার ৮০ ভাগ সাধারণ মানুষই কৃষি সম্পৃক্ত পেশার মাধ্যমে জীবনজীবিকা নির্বাহ করে আসছে। এর পরিপ্রেক্ষিতেই আজ আমরা উন্নত দেশের স্বপ্ন দেখছি। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে বিভিন্ন কারণে এ পেশায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে সাধারণ মানুষ। এর অনেক কারণের মধ্যে দুটি কারণকে অন্যতম হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। একটি হলো কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া অন্যটি কৃষি ক্ষেত্রে শ্রমিকের শ্রমের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত না হওয়া। প্রথম সমস্যাটির দিকে তাকালে দেখা যায়, কৃষক তার জমিতে যে পরিমাণ ব্যয় করে উৎপাদন করছে, সে পরিমাণ দাম তার হাতে পাচ্ছে না। আবার সাধারণ জনগণকে চড়া মূল্য দিয়েই কিনতে হচ্ছে কৃষকের উৎপাদিত পণ্য। মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যের কারণে কৃষককের ন্যায্যমূল্য প্রপ্তির যে স্বপ্ন তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এক সময় কেবলমাত্র নিজের প্রয়োজনীয় পণ্য উৎপাদন করার ক্ষেত্রে বেশি আগ্রহ দেখা যেত কৃষকদের। সময়ের পরিক্রমায় সে জায়গা থেকে সাধারণ মানুষ এখন অনেক অগ্রসর হয়েছে। কৃষিকে কৃষক এখন জীবিকার এক নম্বর আসনে নিয়ে এসেছে। যার জন্য কৃষকের এ থেকে পর্যাপ্ত আয়ের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু বাজারে কৃষিপণ্যের মূল্য একেবারেই অস্থিতিশীল। কৃষক যখন পণ্য উৎপাদন করে তার সাথে সাথেই পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য হয় দুটি কারণে। একটি হলো উৎপাদিত অনেক দ্রব্য পঁচনশীল হওয়া, অন্যটি উৎপাদিত পণ্যের সাথে সম্পৃক্ত শ্রমিকের ব্যয় মিটানো এবং ঋণ শোধ করা। কৃষকের অনেক পণ্য বিশেষ করে উৎপাদিত সবজি সাথে সাথে বিক্রি করতে হচ্ছে। এছাড়াও কিছু পণ্য সংরক্ষণ করতে না পারার কারণে কৃষক পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। এক্ষেত্রেও কৃষক ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। উৎপাদনের সময় বাজারে যোগানের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় চাহিদার পরিমাণ কমে যায়। ফলে সঠিক দাম পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না এছাড়াও রয়েছে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য। কৃষককের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তিতে বাজার ব্যবস্থা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। আমাদের বাজার ব্যবস্থায় সরকারের যথোপযোযুক্ত নজরদারির অভাব সুস্পষ্ট। কৃষিতে উৎপাদিত পণ্যসমূহকে সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বাজারজাতকরণের ব্যবস্থাকে একটি কাঠামোতে আনা জরুরি। কৃষক উৎপাদিত পণ্য সঠিকভাবে বাজারে প্রেরণের ক্ষেত্রে কৃষকদের পরিবহনের ও যোগাযোগ ব্যবস্থাতে সার্বিক সহায়তা প্রদান করতে হবে সরকারকে। কেননা, কৃষিপণ্যগুলো গ্রামেই উৎপাদন হয়ে থাকে। যার কারণে পণ্য ভোক্তার নিকট সহজভাবে পৌঁছানো অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হচ্ছে না। সবচেয়ে বড়কথা এদেশের কৃষক সমাজ এখনও প্রান্তিক পর্যায়ে থাকায় তাদের জীবনমানের সেভাবে উন্নয়ন ঘটাতে পারেনি। এছাড়াও প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের নিত্যসঙ্গী। ফলে প্রায় সময়ই আমাদের কৃষকদের বিভিন্ন বিপদের সম্মুখিন হতে হয়। সেক্ষেত্রে কৃষকদের আর্থিক প্রণোদনার মাধ্যমে স্বাবলম্বী করতে হবে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে কৃষকদের বিভিন্ন সময় বিভিন্নখাতে প্রণোদনা ও ভর্তুকি প্রদান কৃষক সমাজকে ব্যাপকভাবে উৎসাহ যুগিয়েছে, এ কথা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। তবে সরকারের সুনজর না থাকার ফলে বাজারে দ্রব্যমূল্য ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেলেও তা থেকে বঞ্চিত সাধারণ কৃষক সমাজ। সম্প্রতি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম যে হারে বেড়েছে সে তুলনায় লাভবান হয়নি কৃষক সমাজ। এছাড়াও রয়েছে আমদানি নির্ভরতা। অনেক পণ্য রয়েছে যা আমাদের দেশে উৎপন্ন হলেও আমদানির কারণে দেশি পণ্য ভালো দামে বিক্রি করা যাচ্ছে না। তার মানেটা হচ্ছে কৃষিপণ্যের মূল্য নির্ধারণের সঠিক কোনো নীতিমালা নেই। ফলে বাজার ব্যবস্থায় একটি অস্থিতিশীলতা বিরাজ করে সবসময় এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয় এদেশের সাধারণ কৃষক। মোট কথা হচ্ছে, কৃষির উন্নয়নের জন্য কৃষকের পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা জরুরি। আর এ মূল্য নিশ্চিত করা গেলে কৃষকের জীবনযাত্রার মানে পরিবর্তন আসবে। তাছাড়া আমাদের দেশের বেশির ভাগ কৃষি উৎপাদন এখনও প্রকৃতিনির্ভর। ফলে বারবার কৃষকরা ক্ষতির সম্মুখিন হয়ে থাকে। এসব ক্ষতি থেকে কৃষককে বাঁচাতে হলে কৃষি ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার আরো বৃদ্ধি করতে হবে।


অন্যদিকে কৃষিপ্রধান দেশ হলেও কৃষি শ্রমিকরা সঠিক শ্রমমূল্য না পাওয়ার কারণে অন্য লাভজনক পেশাকে বেছে নিচ্ছে দিনদিন। ফলে ভরা মৌসুমে কৃষি শ্রমিকের সংকট দেখা দেয় অত্যধিক। যদিও বর্তমানে কৃষি যান্ত্রিকিরণের ফলে কৃষি শ্রমিকের চাহিদাও কমে আসছে। কিন্তু এটা সারাদেশে সমভাবে এখনো সম্ভব হচ্ছে না। সে কারণেই হাওর অঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকায় ধান কাটার সময় শ্রমিকের অভাব তীব্র আকার ধারণ করে। দেশে চলমান শিল্পায়নের ফলে দ্রুত কৃষি জমি কমে আসছে এবং কৃষকরা তাদের জমির মালিকানা ধরে রাখতে সক্ষম হচ্ছে না। কৃষি জমির মালিকানা চলে যাচ্ছে সমাজের বিত্তবানদের হাতে। কৃষি কাজ পারিবারিকভাবে ছোট হয়ে আসছে।

একটা সময় নিজের প্রয়োজনই কেবল কৃষি কাজ করা হলেও সময়ের প্রয়োজনে এখন কৃষিতে বিপ্লব সংগঠিত হয়েছে। কৃষি এখন বাণিজ্যিকিকরণ হচ্ছে। জিডিপিতে ব্যাপকভাবে অবদান রাখছে কৃষি। ফলে কৃষি এখন আর বর্তমানে নিম্ন স্তরের পেশা হিসেবে নেওয়ার সুযোগ নেই। তাই এক্ষেত্রে সরকারের সবচেয়ে বেশি নজর দেওয়া জরুরি। কৃষক যাতে নিজের সবটুকু জমি সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে পণ্য উৎপাদনের জন্য মানুষ আপ্রাণ চেষ্টা চালায় সে ব্যাপারে উৎসাহ ও প্রেরণা দিতে হবে। কৃষি কাজের ক্ষেত্রে উৎপাদনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রচুর শ্রম দিয়ে থাকে নারী সমাজ। কিন্তু বেশির ভাগই সময়ই তাদের শ্রম সঠিকভাবে নিরূপিত হয় না বা মূল্যায়ন করা হয় না। ফলে এই শ্রম বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে নারীরা উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। কেউ কেউ হয়তো পারিবারিক কারণেই করতে বাধ্য হয়। কিন্তু তাদের শ্রমের সঠিক মূল্যায়ন হলে কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ আরো বাড়বে। ফলে শ্রমিক সংকটেরও অবসান হতে পারে।

কৃষক, কৃষিপণ্যের উৎপাদন, উৎপাদিত পণ্যের দাম ও কৃষি শ্রমিকের চাহিদা এবং শ্রমের মূল্য একটি আরেকটি বিষয়ের সাথে জড়িত এবং এগুলিকে ঠিক রাখার জন্য একটি সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে কৃষি ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে এটা দৃশ্যমান। সরকারের পক্ষ থেকে অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। তবে কৃষিপ্রধান দেশে হিসেবে আমাদের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে সমন্বিত কর্মসূচি গ্রহণ করা প্রয়োজন। কেননা, এখনও এদেশের কৃষক সমাজ সুবিধা বঞ্চিত মানুষ হিসেবে তাদের জীবনযাত্রা অব্যাহত রেখেছে। আশার বিষয় হলো, সম্প্রতি শিক্ষিত অনেক তরুণ-তরুণীকে কৃষিকে পেশা হিসেবে নিতে দেখা যাচ্ছে। কৃষিতে তাদের অংশগ্রহণ সাধারণ মানুষের কাছে এ পেশাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পেশা হিসেবে তুলে ধরতে সক্ষম হচ্ছে। তাদের এ উৎসাহ যেন হারিয়ে না যায় সে জন্য সরকারকে কৃষিখাতের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, কৃষক সমাজকে সামাজিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান করতে হবে। তারা যেন সামাজিকভাবে সম্মানের সহিত বসবাস করতে পারে সেক্ষেত্রে সরকারকে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। কারণ, কৃষিনির্ভর দেশ হলেও কৃষকরা যথোপোযুক্ত সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সম্মান থেকে বঞ্চিত।

লেখক: শিক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মী

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন