মহামারী করোনার মধ্যেও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আয় বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) এনবিআরের রাজস্ব আয় হয়েছে ২ লাখ ২৭ হাজার ৬৪১ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৫ দশমিক ২১ শতাংশ বেশি। আগের অর্থবছরের একই সময়ে রাজস্ব আহরণ হয়েছিল ১ লাখ ৯৭ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকা। গতকাল সোমবার এনবিআর চলতি অর্থবছরের ১০ মাসের রাজস্ব সংগ্রহের যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে এমন চিত্র উঠে এসেছে। আমদানি পর্যায়ে রাজস্ব সংগ্রহ বেড়ে যাওয়ায় মোট রাজস্ব সংগ্রহে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। অবশ্য আগের অর্থবছরের রাজস্ব আয় তুলনায় বাড়লেও তা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কম।
চলতি অর্থবছরের দশ মাসে যে রাজস্ব আয় এসেছে, তা পুরো অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার ৮৭ দশমিক ৫৪ শতাংশ। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে আয়কর, ভ্যাট ও শুল্ক খাতে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রাজস্ব আদায়ে ঘাটতিতে পড়েছে এনবিআর। এ ঘাটতির পরিমাণ প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকা। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। চলতি অর্থবছরে এনবিআরকে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছে সরকার। এতে গড়ে প্রতি মাসে সাড়ে ২৭ হাজার কোটি টাকা করে রাজস্ব সংগ্রহের কথা। লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হয় অর্থবছরের বাকি দুই মাসে রাজস্ব আদায় করতে হবে আরও ১ লাখ ২ হাজার ৩৫৯ কোটি টাকা, যা প্রায় অসম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তার চেয়ে রাজস্ব আদায় হওয়ায় সরকারকে ব্যাংক, সঞ্চয়পত্র ও উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে বেশি পরিমাণে ধার করতে হবে।
এনবিআর চলতি অর্থবছরের ১০ মাসের রাজস্ব সংগ্রহের যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, রাজস্ব আয়ের তিনটি খাতেই আগের বছরের তুলনায় বেশি আদায় হয়েছে। এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত আমদানি-রফতানি পর্যায়ে ১০ মাসে ৭৩ হাজার ৬০ কোটি টাকা, স্থানীয় পর্যায়ে মূসক ও সম্পূরক শুল্ক থেকে ৮৪ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা এবং আয়কর ও ভ্রমণ কর থেকে ৬৯ হাজার ৬৯৫ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে। এতে করে আমদানি খাত থেকে রাজস্ব আয় ১৯ দশমিক ৫১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এছাড়া স্থানীয় পর্যায়ে মূসক ও সম্পূরক শুল্ক এবং আয়কর ও ভ্রমণ কর থেকে রাজস্ব আদায় আগের অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসের চেয়ে ১০ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজস্ব সংগ্রহ টাকার অংকে বেশি হলেও প্রকৃত অর্থে বেশি হচ্ছে না। কারণ মূল্যস্ফীতি ও জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যোগ করলে রাজস্ব সংগ্রহে ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হওয়া উচিত। সে তুলনায় অর্ধেক প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
এনবিআর ছাড়াও কিছু খাত থেকে কর এবং করবহির্ভূত রাজস্ব আদায় হয়। সেখানেও এবারে ভালো খবর নেই। এনবিআরবহির্ভূত করের মধ্যে আছে মাদক শুল্ক, যানবাহন কর, ভূমি রাজস্ব, স্ট্যাম্প রাজস্ব ইত্যাদি। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি বাজেটে এনবিআরবহির্ভূত কর আদায়ের লক্ষ্য ১৬ হাজার কোটি টাকা। অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে এ খাতে আদায় হয়েছে মাত্র ২ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যের মাত্র ১৮ শতাংশ। এমনকি আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৯৬ কোটি টাকা কম। সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের লাভ-মুনাফা, সুদ, ভাড়া, ইজারা, টোল, জরিমানা, সেবা বাবদ প্রাপ্ত মাশুল ইত্যাদিও করবহির্ভূত রাজস্ব। এ খাতে ৪৩ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যের বিপরীতে অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে আদায় মাত্র ১৫ হাজার ৮০২ কোটি টাকা, যা গতবারের একই সময়ের চেয়ে ৯ হাজার কোটি টাকা কম।
এনবিআরের কর্মকর্তারা বলছেন, রাজস্ব সংগ্রহ বাড়াতে সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে ভ্যাটের রিটার্ন অনলাইনে দাখিল করা, স্থানীয় পর্যায়ে ভ্যাট সংগ্রহ বাড়ানো ও আয়কর বাড়ানো অন্যতম। এছাড়া করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা করে গত মার্চ পর্যন্ত ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ইতিবাচক অবস্থায় ছিল। স্থানীয় বাজারে চাহিদাও বেড়েছিল, যে কারণে মোট রাজস্ব সংগ্রহ বেড়েছে।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, রাজস্ব আদায়ের বিষয়টি বেশ গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত। রাজস্ব খাতে সংস্কারের বিষয়টি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, প্রেক্ষিত পরিকল্পনাসহ বিভিন্ন সরকারি দলিলেও স্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু কেন জানি সরকার এই খাতের সংস্কারে আগ্রহী হয় না। হয়তো এই ধরনের সংস্কার যেন না হয়, সে জন্য একটি বড় কায়েমি গোষ্ঠী পেছন থেকে কাজ করে। আমরা সবাই রাজস্ব খাতের দুর্বলতা জানি। রোগটা কী, কী ওষুধ খেতে হবে। কিন্তু আমরা ওষুধ খাই না। তিনি বলেন, বাজেটের চাহিদা অনুযায়ী অর্থের জোগান দিতে রাজস্ব খাতের সংস্কারের বিকল্প নেই।#
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন