সারস কোভ-২ বা করোনা ভাইরাস সংক্রমণের ফলে অধিকাংশ মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাস জনিত সমস্যা দেখা দেয়। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে ভাইরাসটি নিউরোলজিক্যাল বা স্নায়ুবিক জটিলতাও বৃদ্ধি করতে থাকে।
রোগের শুরুতে আক্রান্তদের শরীর-পেশী ব্যথা, ক্লান্তি-অবসাদ ইত্যাদি দেখা দেয়, যা যেকোন সাধারণ ফ্লু-এর ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে। তবে এদের মধ্যে ১০-১৫ শতাংশ রোগীর মধ্যে আংশিক বা পুরোপুরি স্বাদ, গন্ধ না পাওয়ার মতো উপসর্গ লক্ষ্য করা গেছে। নিউরোলজিক্যাল জটিলতার প্রাথমিক উপসর্গগুলোর একটি হলো বায়ুপথের উপরিভাগে ওলফ্যাক্টরি হেয়ার সেলস থাকা।
শ্বাস-প্রশ্বাস জনিত অসুস্থতার ক্ষেত্রে রোগীদের কমন কিছু উপসর্গ হলো উত্তেজনা, বিভ্রান্তি, বিরক্তিভাব, একাগ্রতার অভাব এবং অমনোযোগ। যদিও মস্তিষ্কে পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহের অভাব হলে এসব দেখা দেয় বলে মনে করা হয়, তবে যথাযথ চিকিত্সা ও অক্সিজেন সরবরাহ পাওয়ার পরও অনেকের মধ্যে উপসর্গগুলো বুদ্যমান থাকে। ধারণা করা হয়, সিস্টেমিক কোভিড সংক্রমণ বা মস্তিষ্ক ও রক্তনালীতে ভাইরাসের সরাসরি প্রভাব বা ভিরেমিয়ার নিউরোইনফ্ল্যামেটরি প্রতিক্রিয়ার কারণে উপসর্গগুলো উঠে আসে। হাসপাতালে ভর্তি প্রায় ১৭% রোগীদের মধ্যে গুরুতর এনসেফালোপ্যাথি এবং কোমা লক্ষ্য করা গেছে, যা বেশিরভাগই একাধিক প্রক্রিয়ার কারণে হয়েছে। তবে যাদের এনসেফালোপ্যাথি গুরুত্বর নয়, তাঁরা দ্রুতই সুস্থ হয়ে উঠেন।
ব্রেইন ফগ খুবই কমন একটি টার্ম। যেসব রোগীর বিভ্রান্তি, এলোমেলো ভাব, মনযোগ দিতে ও গুছিয়ে কথা বলতে সমস্যাবোধ করেন তাদের জন্য এই টার্মটি ব্যবহার করা হয়। করোনা ভাইরাস থেকে সেরে ওঠা রোগীদের মধ্যে ডিসেক্সিকিউটিভ উপসর্গগুলো লক্ষ্য করা যায়। দুশ্চিন্তা, মানসিক চাপমুক্ত থাকা, ইতিবাচক চিন্তা করা এবং পুষ্টিকর খাদ্য (ফল, বাদাম ইত্যাদি) খাওয়ার অভ্যাস করলে ব্রেইন ফগ থেকে উত্তোরণ সম্ভব। ৭-৮ ঘন্টার পর্যাপ্ত ঘুম, নিয়মিত ব্যায়াম, মদ ও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার কমিয়ে ব্রেইন ফগের অবস্থা নির্ণয় করা সম্ভব।
আবার, এক তৃতীয়াংশ রোগীর মধ্যে অনিদ্রাসহ ঘুমের অসুবিধা লক্ষ্য করা যায়। অনেকের ক্ষেত্রে সাধারণ একটি উপসর্গ হলো মাথাব্যথা।
অধিকাংশ করোনা আক্রান্ত এবং হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের মধ্যে স্ট্রোক, ইস্কেমিক (উভয় ধমনীতে রক্ত প্রবাহের অভাব), রক্তক্ষরণ (মস্তিষ্কের ভিতরে রক্তপাত) ইত্যাদি দেখা যায়। স্ট্রোকের ক্ষেত্রে অল্টারড কোয়াগুলেশন প্রোফাইল গুরুত্বপূর্ণ প্যাথো-ফিজিওলজির ভূমিকা রাখছে। গুরুত্বর অবস্থায় থ্রম্বোলাইটিক ওষুধ (জমাট ভাঙ্গার ওষুধ) ব্যবহার করে বড় স্ট্রোকের চিকিত্সা করা ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ এতে করে অবস্থা জটিল হতে পারে। এমনটি করলে বড় স্ট্রোকের রোগীরা সাধারণত নেতিবাচক সাড়া দিয়ে থাকে এবং তাদের দীর্ঘমেয়াদী রিহ্যাবিলিটেশন কেয়ারের প্রয়োজন হয়। কিছু রোগীদের আমাদের সেন্টারে সুভিটাসে অভিজ্ঞ দলের অধীনে সফলভাবে চিকিৎসা প্রদান করা হয়।
অন্যান্য নিউরোলজিক্যাল উপসর্গের মধ্যে রয়েছে চোখের পেশীর দুর্বলতা, যার ফলে ডাবল ভিশন বা দৃষ্টিভ্রম, ফেশিয়াল নার্ভ উইকনেস, মেরুদন্ডের রোগ (মাইলাইটিস) এবং শরীরের উপর-নীচ প্যারালাইসড হওয়া (জি বি সিনড্রোম) ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে পারে। অনেক রোগীর তীব্র পেশী ব্যথা ও দুর্বলতা, খুড়িয়ে হাঁটা ইত্যাদি সমস্যা হয়। ওষুধ এবং উপযুক্ত রিহ্যাবিলিটেশনের মাধ্যমে এসকল রোগী সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন। করোনা মহামারীতে ঘরে থাকতে থাকতে পর্যাপ্ত শারীরিক ব্যায়াম ও যত্নের অভাবে বয়স্ক রোগীরা ডিমেনশিয়ার মতো রোগে আক্রান্ত হন, ফলে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও হ্রাস পায়। নিমহানস-এর একটি গবেষণায়, প্রথম লক ডাউনের ছয় মাসে ডিমেনশিয়া’র অবস্থায় উল্লেখযোগ্য হারে অবনতি ঘটে বলে জানা যায়।
সুতরাং, এটি স্পষ্ট যে করোনা আক্রান্তদের নিউরোলজিক্যাল বা স্নায়ুবিক উপসর্গগুলো সচরাচরই দেখা যায়। এই রোগ প্রতিরোধে রোগ নির্ণয়ে অগ্রগতি, দীর্ঘমেয়াদী ফলাফল এবং আর্থ-সামাজিক প্রভাব বুঝতে বিশ্বজুড়ে এখনও গবেষণা চলছে।
লেখক: কনসালটেন্ট, নিউরো ফিজিশিয়ান, নিউরোলজি বিভাগ, ইয়াশোদা হসপিটাল, হায়দ্রাবাদ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন