সাধারণ রাষ্ট্রনায়কদের সাথে স্টেটসম্যানদের সূক্ষ্ম অথচ বিশাল একটা পার্থক্য করা হয়ে থাকে। স্টেটসম্যানরা বর্তমান-ভবিষ্যৎ উভয় কালেই বিচরণ করেন অনায়াসে। সরল বাংলায় তাদের বলা যায়, ভবিষ্যতদ্রষ্টা, স্বপ্নদ্রষ্টা। তারা জাতির অনাগত ভবিষ্যতের স্বচ্ছ ছবি এঁকে বর্তমানকে সাজাতে থাকেন। পৃথিবীর ইতিহাসে খুব স্বল্প সংখ্যক মানুষই পেরেছেন জাতির আশা-আকাক্সক্ষাকে ধারণ করে স্টেটসম্যান হবার গৌরব অর্জন করতে। তাদের ছোঁয়ায় ঘুমন্ত, হতাশাগ্রস্থ, সমস্যাপীড়িত জাতি জেগে উঠে, নতুন উদ্যোমে শুরু হয় সবকিছু। শত সমস্যা মোকাবেলা করে জাতি তখন এগিয়ে যাবার প্রেরণা পায়। এক কথায় জাতিকে এই মহান ব্যক্তিরা স্বপ্ন দেখাতে পারেন। যে স্বপ্ন বুকে ধারণ করে সমস্ত বাধাকে অতিক্রম করে একটি জাতি এগিয়ে যায়।
জিয়াউর রহমান ক্ষণজন্মা সেইসব স্টেটসম্যানদেরই একজন ছিলেন। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকসহ নানা দিক থেকে বিপর্যস্ত, তলাবিহীন ঝুড়ি আখ্যাপ্রাপ্ত একটি সদ্য স্বাধীন দেশের জন্য আশির্বাদ হয়ে তিনি এসেছিলেন। আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার মাহাথির মুহাম্মাদের কয়েক বছর আগেই ‘বাংলাদেশের মাহাথির’ জিয়ার আবির্ভাব ঘটেছিল। স্টেটসম্যানসুলভ দূরদৃষ্টি নিয়ে তিনি এঁকে ফেলেছিলেন এদেশের উন্নয়নের রূপকল্প। সমগ্র জাতির প্রাণে সৃষ্টি করেছিলেন এক অন্যরকম স্পন্দন। জাতি গঠনের এক মহাপরিকল্পনা নিয়ে নেমে পড়েছিলেন। রাষ্ট্রের এমন কোনো সেক্টর ছিল না যেটাতে তিনি তরঙ্গ সৃষ্টি করতে পারেননি। তিনি শুরু করেছিলেন জাতিকে স্বাবলম্বী করার বাস্তবসম্মত কার্যক্রম। ‘আদর্শ গ্রাম’ তৈরির এক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত উন্নয়নের সুষম সুফল পৌঁছে দিতে তিনি জনতার দ্বারে দ্বারে ছুটলেন। বিপুল জনসংখ্যায় হতাশ বা আশাহত না হয়ে জনসংখ্যাকে জনশক্তিকে পরিণত করার বাস্তবসম্মত উদ্যোগ গ্রহণ করলেন। টপ টু বটম সকলকে প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসলেন। নিজের রাজনৈতিক সহকর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ বেকার যুবক শ্রেণী পর্যন্ত সকলকেই নিজ নিজ ক্ষেত্র ও পর্যায়ে প্রশিক্ষণ নিতে হবে, তারপর পথচলাÑ এ নীতি কার্যকর হলো। এর ফলে দেশের প্রতিটি সেক্টরে এর ইতিবাচক ফল লাভ তো ঘটলই, উপরন্তু বিদেশেও দক্ষ জনশক্তি রপ্তানির মাধ্যমে সুনাম অর্জন করে বিপুল এক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করা সম্ভবপর হলো। দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টির এ অত্যাধুনিক পদ্ধতি জিয়া বহু আগেই কার্যকর করে তাঁর দূরদৃষ্টির যথাযথ প্রমাণ রেখে গেছেন। তাঁর আরেকটি বিস্ময়কর পরিকল্পনা ছিল ‘খাল খনন প্রকল্প’। শুকনো মৌসুমে পানি ধরে রাখা আর বন্যার সময় তলিয়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচার কি মোক্ষম ব্যবস্থার কথাই না তিনি চিন্তা করেছিলেন। দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো, সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণে পরিত্যাক্ত এ প্রকল্পটির প্রয়োজনীয়তার কথা আজ আমাদের বিশেষজ্ঞরা স্বীকার করছেন। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছিল তেমনি এক সুদূরপ্রসারী ফলাফলের কথাও ভাবা হয়েছিল।
জিয়ার অসামান্য অবদান হলো দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা। এ ক্ষেত্রেই তাঁর অন্তর্দৃষ্টি অবাক করার মতো। ক্ষুদ্র নৃতাত্তি¡ক জনগোষ্ঠি থেকে শুরু করে সকলের জন্য মর্যাদাকর একটি জাতীয় পরিচিতি নিশ্চিত করে ‘বাংলাদেশী’ জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে তিনি দেশকে ঐক্যবদ্ধ করেন। সবচেয়ে বড় যে কাজটি তিনি সেদিন করেন, তা হলো নব্বই ভাগ মানুষের চিন্তা চেতনাকে ধারণ করে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি প্রণয়ন। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের সমান অধিকার নিশ্চিত করে ইসলামের মূলশিক্ষা তাওহীদ বা একত্ববাদকে তিনি ‘আল্লাহর প্রতি পূর্ণআস্থা ও বিশ্বাস’ নামে রাষ্ট্রীয় মূলনীতির অন্তর্ভুক্ত করেন। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও সমাজতন্ত্রকে তিনি ছুঁড়ে ফেলে দেন। এ পদক্ষেপের মাধ্যমে তাঁর যে দূরদর্শিতা পরিলক্ষিত হয়েছে, তা এক কথায় অভূতপূর্ব ও অসাধারণ। এর মধ্য দিয়ে তিনি এদেশের আবহমান ঐতিহ্যকে যেমন তুলে ধরেন, তেমনি সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রবোধ সৃষ্টি করতেও সক্ষম হন। এর ফলে মুসলিম বিশ্ব নতুনভাবে বাংলাদেশকে নিয়ে ভাবনা শুরু করে। তারা এক নতুন জাতিসত্ত¡ার সন্ধান পায়।
জিয়া উপলব্ধি করেছিলেন বাংলাদেশিদের মেধার অভাব নেই, প্রয়োজন শুধু যথাযথ পরিচর্যার। তিনি দেশের বুদ্ধিজীবী-পÐিতদের আন্তরিকতার সাথে সম্পৃক্ত করেন রাষ্ট্র পরিচালনার নানা কর্মকাÐে। এক্ষেত্রে কে কোন মতের তা তিনি দেখেননি। দেশের প্রতি তাদের যে দায়িত্ববোধ আছে তার আলোকে তাঁরা দেশকে যা দিতে পারেন তার সমন্বয় সাধন এবং সে আলোকে জাতীয় উন্নয়নের পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। এ জন্যই তাঁর পরামর্শকদের মধ্যে যেমন ছিলেন আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত ব্যক্তিত্ব মোজাফফর আহমেদ, তেমনি ছিলেন বরেণ্য কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ সৈয়দ আলী আহসান। নবীন প্রজন্মের মেধাগুলো যেন ঝরে না পড়ে, তাদের মধ্যে যেন দেশপ্রেমই সবকিছুর ঊর্ধ্বে স্থান পায়, তাদের মেধা যেন দেশেরই কল্যাণের জন্য নিবেদিত হয় এজন্য শহীদ জিয়ার কর্মপরিকল্পনা ও উদ্যোগ ছিল ব্যতিক্রমধর্মী। দেশের সেরা মেধাবী সন্তানদের তিনি জাতীয়ভাবে পুরস্কৃত ও মূল্যায়িত করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর গৃহীত নৌবিহারের কথা স্মরণযোগ্য। দেশের নবীন মেধাবী মুখগুলোকে নিয়ে তিনি ‘হিযবুল বাহার’-এ সমুদ্রভ্রমণের ব্যবস্থা করেন। নবীনদের দীক্ষা দিতে সংগে নিয়েছিলেন দেশের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের। এর মাধ্যমে তিনি নবীন-প্রবীণের মধ্যে এক অন্যরকম সেতুবন্ধন রচনার প্রয়াস পেয়েছিলেন।
জিয়াউর রহমানের বিচক্ষণ নেতৃত্ব ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কর্মকাÐের পরিধি দেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিমÐলেও বিস্তার লাভ করেছিল। তাঁর দেশপ্রেম, দেশগঠনে তাঁর পরিকল্পনা, দক্ষতা-যোগ্যতা তাঁকে তৃতীয় বিশ্বের এক ‘লড়াকু সৈনিকের’ ইমেজ এনে দিয়েছিল বিশ্বজুড়ে। দ্বিপাক্ষিক, আঞ্চলিক নানা ইস্যুতে বাংলাদেশের গুরুত্ব প্রথমবারের মতো অনুভূত হতে শুরু করেছিল তাঁর গতিশীল নেতৃত্বের কারণেই। একদিকে সফল কূটনৈতিক পলিসির মাধ্যমে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সাথে সম্পর্ক একটা সম্মানজনক পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারা, অপরদিকে দেশের সার্বভৌমত্ব ও জাতির আত্মমর্যাদার ক্ষেত্রে সামান্য অপমান বরদাশত না করার এক সমন্বয়র্ধী পররাষ্ট্রনীতির প্রণেতা তিনি। দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সহযোগিতা জোট সার্ক-এর স্বপ্নদ্রষ্টা তিনি। স্নায়ুযুদ্ধের সেই সময়কালটায় অত্যন্তযোগ্যতার সাথে একটা ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করে তিনি বিশ্বজুড়ে খ্যাতি অর্জন করেন। ইসলামী উম্মাহর সাথে নিবিড় যোগাযোগ স্থাপন তাঁর দক্ষ নেতৃত্বের কারণেই সম্ভবপর হয়েছিল। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা অবাক করার মতো ছিল। মুসলিম বিশ্বের নানামুখী সমস্যা-বিরোধ মেটাতে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ইরাক-ইরান যুদ্ধ নিয়ে তাঁর উদ্যোগ ও ভূমিকার কথা এক্ষেত্রে উল্লেখ করার মতো। এভাবে ওআইসিকে শক্তিশালীকরণ, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় মুসলিম উম্মাহর যথাযথ অংশগ্রহণ, স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন প্রভৃতি ইস্যুতে জিয়ার বলিষ্ঠ ভূমিকা ইতিহাসে তাঁকে অমর করে রেখেছে। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত একটা স্মৃতির কথা না বলে থাকতে পারছি না। বছর কয়েক আগে মরক্কো সরকারের স্কলারশিপ নিয়ে উচ্চ শিক্ষার্থে সেখানে অবস্থান করছিলাম। সেখানের ক্যাসাবøাংকা নগরীর দ্বিতীয় হাসান বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য একজন শিক্ষক আমার সুপারভাইজার হিসেবে ছিলেন। প্রথম পরিচয়ে আমি বাংলাদেশি জেনে উৎসাহিত হয়ে তিনি বলেন: ‘জিয়াউর রহমানের দেশের লোক?’ সেই অচেনা পরিবেশে একজন উচ্চশিক্ষিত বিদেশির মুখে এ কথা শুনে গর্বে মনটা ভরে গিয়েছিল। আমার জন্য আরও চমক অপেক্ষা করছিল, তখনও বুঝতে পারিনি। কিছুদিন পর আমার সুপারভাইজার রাজধানী রাবাতেই থাকছি জানতে পেরে একটা এলাকার নাম বলে বললেন, সেখানে গিয়ে এমন কিছু দেখবে, যা তোমাকে পুলকিত করবে। পরের দিনই ছুটলাম কী হতে পারে তা জানার তীব্র আকর্ষণ নিয়ে। সত্যি আমি রীতিমত বিস্মিত, গর্বিত। মরক্কোর রাজধানী রাবাতের প্রাণকেন্দ্রের একটি এভিনিউয়ের শুরুতে বিরাট করে আরবিতে লেখা ‘শারি আশ-শহীদ জিয়াউর রহমান’ (শহীদ জিয়াউর রহমান এভিনিউ)। শুধু মরক্কোতেই নয় সেনেগাল, তুরস্কসহ মুসলিম বিশ্বের আরও কয়েকটি দেশে জিয়ার নামে সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। কী অসাধারণ যোগ্যতা নিয়ে তিনি রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বে সমাসীন ছিলেন, যার প্রভাব আন্তর্জাতিক মহলেও ছড়িয়ে পড়েছিল। তৃতীয় বিশ্বের বিশেষ করে, মুসলিম জাহানের মজলুম মানুষের কণ্ঠস্বরে পরিণত হয়েছিলেন তিনি। আধিপত্যবাদ বিরোধী বলয়েও তাঁর প্রভাব ছিল সুস্পষ্ট। ভারতীয় আধিপত্যবাদ মোকাবেলায় তিনি চীনের সাথে সম্পর্কন্নোয়নের উদ্যোগ নেন এবং এ অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক পরিমÐলে একটি ভারসাম্য আনতে সক্ষম হয়েছিলেন।
লেখক: অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
masud1978@ru.ac.bd
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন