রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ বাড়ছে বলে জানা গেছে। ২০১৩ সালে রেন্টাল-কুইক রেন্টাল থেকে সরে আসার এবং ২০১৮ সাল নাগাদ ভাড়াভিত্তিক কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র আর থাকবে না বলে সরকারের তরফে প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও সে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। পিডিবির তথ্য থেকে দেখা যায়, শুরুতে রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ছিল হাতেগোনা কয়েকটি। পরবর্তীতে এই সংখ্যা বেড়েছে। ২০১৩ সালের পরও বেড়েছে। ২০১১,২০১২ ও ২০১৩ সাল পর্যন্ত রেন্টাল-কুইক রেন্টালের সংখ্যা ছিল মোট ৭+৭=১৪টি। বর্তমানে এ সংখ্যা ৩২। রেন্টাল ১৪টি ও কুইক রেন্টাল ১৮টি। এগুলোর একাংশ তেলভিত্তিক, অপরাংশ গ্যাসভিত্তিক। জরুরি বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণে রেন্টাল-কুইক রেন্টালের ভূমিকা স্বীকার করা হলেও একে রাষ্ট্রের ঘাড়ে এক ধরনের বোঝা হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। দ্রুত এই বোঝা থেকে মুক্ত হওয়া অত্যাবশ্যক হলেও আমাদের দেশে দেখা যাচ্ছে ব্যতিক্রম। রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের সংখ্যা ও মেয়াদ দুই-ই বাড়ছে। কেন এমনটি হচ্ছে? কথা ছিল, বড় বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হবে এবং সেসব কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হলে রেন্টাল-কুইক রেন্টাল থেকে সরে আসা সম্ভব হবে। দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, বড় আকারের কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র কোনো উৎপাদনে আসতে পারেনি। কেন পারেনি, তার কোনো সদুত্তর নেই। ব্যর্থতার এই প্রেক্ষাপটে রেন্টাল-কুইক রেন্টালের মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে। কেন রেন্টাল-কুইক রেন্টালের সংখ্যা ও মেয়াদ বাড়ছে, এমন প্রশ্নের জবাবে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, আমাদের অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে এসেছে, তবে যতদিন পর্যন্ত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে না আসছে ততদিন কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র চলবে। বলা বাহুল্য, সাত মণ তেল কবে পুড়বে আর রাধা কবে নাচবে, কেউ জানে না।
রেন্টাল-কুইক রেন্টালের বিদ্যুৎ উচ্চমূল্যে কিনে পিডিবিকে বরাবরই মোটা অংকের লোকসান গুনতে হচ্ছে। ভর্তুকি দিয়েও এ লোকসান কমানো সম্ভব হচ্ছে না। রেন্টাল কুইক রেন্টালের বিদ্যুতের উৎপাদনব্যয় ও মূল্য দুই-ই বেশি। পিডিবির গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ব্যয় যেখানে ইউনিটপ্রতি দুই টাকারও কম সেখানে গ্যাসভিত্তিক কুইক রেন্টলে এ ব্যয় ছয় টাকার ওপরে। এমনকি বেসরকারি খাতের দীর্ঘমেয়াদি গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর ইউনিটপ্রতি উৎপাদন ব্যয় যেখানে গড়ে দুই টাকা, সেখানে তেলভিত্তিক কুইক রেন্টালের উৎপাদন ব্যয় প্রতি ইউনিটে ১৬-১৭ টাকা। প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ১৭ টাকা আর প্রতি ইউনিট দুই টাকা মূল্যে কিনলে পিডিবির প্রতি ইউনিটের গড় দাম দাঁড়ায় সাড়ে নয় টাকা। পিডিবি প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ বিক্রি করে চার থেকে ছয় টাকায়। এ হিসাবে পিডিবিকে কত লোকসান গুনতে হচ্ছে তা সহজেই অনুমেয়। অথচ এ সময়ের মধ্যে যদি রাষ্ট্রায়ত্ত বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালু হতো তাহলে পিডিবি বিদ্যুতের দাম কমিয়েও বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা লাভ করতে পারত। আসলে রেন্টাল-কুইক রেন্টালের নামে বিদ্যুৎ খাতে এক ধরনের লুটপাটের উৎসব চলছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানা গেছে, সরকার দরপত্র ছাড়া বিদ্যুৎ কিনে গত সাড়ে তিন বছরে প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা গচ্চা দিয়েছে। এ সময়ে ১৩টি কুইক রেন্টালের কাছ থেকে গড়ে ১৪ লাখ ২৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেনা হয়েছে। দেখা গেছে, এই বিদ্যুৎ কেনা হয়েছে প্রতি ইউনিট সাত টাকার বেশি দামে। ২০১০ সালে এসব কুইক রেন্টালের কাছ থেকে গড়ে ১২ টাকা থেকে ১৮ টাকা ৭৫ পয়সা দামে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ কেনার সিদ্ধান্ত হয় এবং ওই দামেই কেনা হয়েছে। বিষয়টি ধরা পড়েছে দরপত্রের মাধ্যমে বিদ্যুৎ কেনার সিদ্ধান্ত হওয়ার পর। দেখা গেছে, এসব প্রতিষ্ঠান প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছে গড়ে আট টাকা ২০ পয়সা দামে। এই হিসাবে গত সাড়ে তিন বছরে কেনা বিদ্যুতের জন্য বাড়তি দিতে হয়েছে ২৩ হাজার নয়শ’ কোটি টাকা। রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকরা এই বিপুল অঙ্কের জনগণের ট্যাক্সের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। শুধু তাই নয়, সরকারি দামে তেল ও গ্যাসের যোগান পেয়েছেন। একই সঙ্গে পেয়েছেন হ্যান্ডলিংয়ের জন্য নয় শতাংশ হারে সার্ভিস চার্জ।
এখন দরপত্রের মাধ্যমে বিদ্যুৎ কেনার সিদ্ধান্ত হওয়ার কিছুটা গোমর ফাঁস হয়েছে। রেন্টাল-কুইক রেন্টালের কাছ থেকে দরপত্র ছাড়া বিদ্যুৎ কেনার এমন নজির বিশ্বে আছে বলে আমাদের জানা নেই। এর মাধ্যমে বস্তুত বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের সুবিধা দেয়া হয়েছে। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিক কারা, খোঁজ নিলে তা জানা অসম্ভব হয়। অবশেষে দরপত্রের মাধ্যমে বিদ্যুৎ কেনার যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তাকে আমরা স্বাগত জানাই। তবে শঙ্কার আরেক দিকও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় জ্বালানি তেল আমদানির জন্য বর্তমান আইন সংশোধনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তাতে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য তেল আমদানি শুল্কমুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। পর্যবেক্ষকদের ধারণা, এ প্রস্তাব গৃহীত হলে তেলের অবৈধ কারবারের একটা ধান্ধা খুলে যাবে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য তেল আমাদানি করে তা যে খোলাবাজারে বিক্রি করে মুনাফা লোটা হবে না। তার নিশ্চয়তা কোথায়! এমনকি তেল পাচার হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। এ ব্যাপারে তত্ত্বাবধান বা মনিটরিংয়ের কোনো ব্যবস্থা বা নির্দেশনা নেই। বিদ্যুৎ নিয়ে যা কিছু হয়েছে বা হচ্ছে, তা অত্যন্ত দুঃখজনক ও অনভিপ্রেত। এর অবসান হওয়া জরুরি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন