বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইনকিলাব বর্ষ শুরু সংখ্যা

উপকূলীয় অঞ্চলের দুঃখ

ডিএম রেজা সোহাগ | প্রকাশের সময় : ৪ জুন, ২০২২, ১২:০৩ এএম

বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলাগুলোর মধ্যে খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা নিয়ে বৃহত্তর খুলনাঞ্চল গঠিত। পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেষ্ট সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সম্পদ একদিকে যেমন জেলাগুলোকে করেছে সমৃদ্ধ তেমনি নানা প্রাকৃতিক দূর্যোগ থেকে রক্ষা করে চলেছে যুগের পর যুগ। সুন্দরবন ও বঙ্গোপসাগর সন্নিহিত জেলা হওয়ায় মৎস্য, মধু, মাছ ও কাঠ আহরণ এ অঞ্চলের মানুষের বড় একটি অংশের রোজকার জীবিকা।

প্রকৃতি যেমন এ অঞ্চলকে উদারভাবে তার সম্পদ দান করেছে, তেমনি লবণাক্ততা এ অঞ্চলের মানুষ ও পরিবেশকে চরম হুমকির মুখেও ফেলে দিয়েছে। দিনে দিনে লবণাক্ততার এই সমস্যা বেড়ে চলেছে। আশানুরূপ ফসল ফলছে না জমিতে। লোকসংখ্যা বেড়ে চলেছে, কিন্তু বিঘার পর বিঘা অনাবাদি রয়ে যাচ্ছে। এক সময় লবণাক্ত পানিতে ব্যাপকভাবে চিংড়ি চাষ হলেও সময়ের বিবর্তনে তাতেও ধস নেমেছে। সুপেয় পানির অভাবে রোগ ব্যাধি বাড়ছে। নারীরা বিভিন্ন সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছেন। হাহাকার বিরাজ করছে সমগ্র উপকূলীয় এলাকায়। অনেকেই নিজ বাস্তভিটা ছেড়ে চলে গেছেন। লবণাক্ততার কারণে পুরো বাস্তুসংস্থান বদলে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, লবণাক্ততা সমস্যার স্থায়ী সমাধান না হলে আগামী দুই যুগে কয়েক লক্ষ মানুষ এ অঞ্চল ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হবে।

উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা সমস্যা দীর্ঘদিনের। এখন থেকে প্রায় ৬শ’ বছর আগে লবণাক্ততা সমস্যা উপলব্ধি করে হজরত খানজাহান আলী (রহ.) বৃহত্তর খুলনাঞ্চলে ৩৬০ টি মিষ্টি পানির দীঘি খনন করেছিলেন। সে সময় জনসংখ্যা খুবই কম থাকায় মিষ্টি পানির দীঘিগুলো সুপেয় পানির চাহিদা পূরণে সক্ষম ছিল। এখন জনসংখ্যা বহুগুণ বেড়েছে। সময়ের প্রয়োজনে মানুষ খালবিল সব ভরাট করে ফেলেছে। নদনদী ভরাট করেছে। ছোট ডোবা-পুকুর কিছুই দখল থেকে বাদ পড়েনি। মানুষই নিরাপদ পানযোগ্য পানির উৎস সংকুচিত করেছে ফেলেছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে গেছে। বর্ষা মৌসুমে কাঙ্খিত পরিমাণ বৃষ্টিপাত হচ্ছে না।

স্থানীয় নদনদীর গভীরতা বা নাব্যতা কমে যাওয়ায় জোয়ারে সাগরের লবণ পানি প্রবেশ করছে কিন্তু ভাটায় সে পরিমানে নামছে না। বছরের পর বছর এ অবস্থা বিরাজমান থাকায় পানি ও মাটি লবণ আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সাগরপৃষ্টের উচ্চতা বেড়ে চলায়ও লবণ পানি উপকূলে ঢুকছে। উপকূল এলাকায় বাঁধ দিয়ে পুরো প্লাবনভূমিকে আটকে দেওয়া হয়েছে। যার ফলে প্লাবনভূমিতে পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হয়ে লবণাক্ততা বাড়াচ্ছে। অন্যদিকে, ষাটের দশকে নির্মিত দূর্বল বেড়িবাঁধ সামান্য জলোচ্ছাসে, ঝড়ে ভেঙ্গে যাচ্ছে। প্রবেশ করছে লবণপানি। এ পানি নামতে সময় নিচ্ছে ৩ থেকে ৩ মাস।

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ততা বৃদ্ধির নেপথ্যে প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারতও অনেকটা দায়ী। পাহাড় থেকে নেমে আসা পানি বাংলাদেশে প্রবেশ করলে লবণাক্ততার পরিমাণ তুলনামূলক কম হতো। ফারাক্কা ও অন্যান্য বাঁধ দেয়ার পর থেকেই এ অঞ্চলের সকল নদনদীর স্বাভাবিক পানি প্রবাহে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়েছে। স্রোত কমে আসায় নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে। পানি চুক্তির ন্যায্যতা ভারত রক্ষা করলে লবণাক্ত পানির সমস্যা বহুলাংশে হ্রাস পেতো।
এ বিষয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের (বিভাগ) অধ্যাপক দিলীপ কুমার দত্ত বলেন, উপকূলীয় অঞ্চলের জনঘনত্ব আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। উপকূলীয় এলাকায় পানির অভাব নেই, অভাব রয়েছে সুপেয় পানির। জীবনধারণের জন্য যে পরিমাণ পানি দরকার, তা মাথাপিছু অনুযায়ী কমে গেছে। খাবার পানির সমস্যা সমাধানের জন্য প্রায় ৬০০-৭০০ বছর আগে থেকেই এসব অঞ্চলে বড় বড় দীঘি খনন করা হয়েছিল। খানজাহান আলীসহ অন্যরা হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন, এটাই একমাত্র উপায়। এটা হলো প্রকৃতিগত পদ্ধতি। এই পদ্ধতির কথাই এখন অনেকে বলছেন, কিন্তু সেটা নিয়ে কেউ কাজ করছেন না। ইতিমধ্যে যেসব জলাশয় ছিল, তা আমরা ভরাট করে ফেলেছি। আসলে আমাদের যেটা প্রয়োজন, আমরা ঠিক তার উল্টো পথে চলছি। আমরা সব সময় ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল। ভূগর্ভস্থ পানি হলো যেকোনো উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। ভূগর্ভস্থ পানির বয়স কমপক্ষে ৬০০ বছর, ওপরে ২ হাজার ৫০০ বছর। অর্থাৎ আমরা বর্তমানে যে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করছি, তার বয়স এমনই। এই ভূগর্ভস্থ পানি পূরণ হতে কমপক্ষে ৬০০ বছর লাগবে। বর্তমানে আমাদের উপকূলীয় এলাকায় কমপক্ষে ৯৮ শতাংশ মানুষ ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল। অন্যদিকে যে পরিমাণ পানি তোলা হচ্ছে তা পূরণ হচ্ছে না। যেসব জলাশয় ছিল তা ভরাট হয়ে গেছে।

খুলনার কয়রা, পাইকগাছা, সাতক্ষীরার আশাশুনি, শ্যামনগর, তালা, বাগেরহাটের শরণখোলা প্রভৃতি উপজেলায় দেখা গেছে, পানযোগ্য পানি আনতে গৃহবধূদের কয়েক মাইল পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে। মিষ্টি পানির পুকুর থেকে ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে তারা পানি সংগ্রহ করছে। ওই সকল উপজেলায় একসময় প্রায় ৮০ হাজার মৎস্য ঘেরে লোনা পানির চিংড়ি চাষ করা হতো। লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় এখন ঘেরের সংখ্যা ২০ হাজার কমে গেছে। লাভজনক চিংড়ি চাষ এখন লোকসানের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। লবণাক্ততার কারণে চিংড়ি ঘেরে মড়ক দেখা দিচ্ছে। চিংড়ি রেণু পোণা বাড়ছে না। অন্যদিকে, ফসলের আবাদ কমছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশনের একটি গবেষণাপত্রে জানা গেছে, খুলনার কয়রা, দাকোপ ও পাইকগাছা এবং সাতক্ষীরার আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলায় ১৯৯৫ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে কৃষিজমি কমেছে ৭৮ হাজার ১৭ একর।

খুলনাভিত্তিক সংস্থা উপকূলীয় জীবনযাত্রা ও পরিবেশ কর্মজোটের (ক্লিন) প্রধান নির্বাহী হাসান মেহেদি বলেন, আমাদের নিজস্ব গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০৯ সালে ঘুর্ণিঝড় আইলার পর খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলা থেকে ১ লাখ ২৫ হাজার মানুষ অন্যত্র চলে যায়। এর দুই বছর পর আবার ১ লাখ ১০ হাজার মানুষ বাড়িতে ফিরে আসে। বাকি ১৫ হাজার আর ফেরেনি।

এ বিষয়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আইনুন নিশাত বলেন, আমাদের নিজেদের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সব ধর্মের মানুষ এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে। এদের মধ্যে অনেকে ভারতে, কেউ কেউ মধ্যপ্রাচ্যে বা ইউরোপেও যাচ্ছে। আর দেশের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামেও খুলনা-সাতক্ষীরার মানুষকে আমরা যেতে দেখেছি। এই সবকিছুর জন্য জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব অন্যতম দায়ী।

খুলনা মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক ও চর্ম যৌন রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আক্তারুজ্জামান বলেন, লবণাক্ততা সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি হলে শরীরে নানা রোগ ব্যধির সৃষ্টি হতে পারে। বিশেষ করে চর্ম রোগের আশংকা থাকে। খুলনার উপকূলীয় এলাকাগুলোতে চর্মরোগীর সংখ্যা বেশি। দেহে লবনের মাত্রা বেড়ে গেলে বেশ কিছু জীবানুর সংক্রমণ দেখা দেয়। অন্যদিকে লবণ বাড়লে শরীরে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি হয়। খুলনা বাগেরহাট সাতক্ষীরার উপকূলীয় মানুষের উপরে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো জরিপ এ পর্যন্ত করা না হলেও তাদের এ সমস্যাগুলোর তথ্য আমাদের কাছে রয়েছে।

উপকূলীয় এলাকার লবণ সমস্যা দূর করার বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রেইন ওয়াটার হার্ভেস্ট বা বৃষ্টির পানি ধরে রেখে ব্যবহার একটি জনপ্রিয় মাধ্যম। তবে, এটা শুধু স্বল্প সময়ের জন্য খাবার পানির চাহিদা পূরণ করে। তবে মনে রাখতে হবে, মিঠা পানির চাহিদা শুধু মানুষের নয়, পরিবেশের প্রতিটি গাছপালা ও জীবজন্তুর জন্যও প্রয়োজন। বৃষ্টির পানি ধরে রেখে শুধু মানুষের খাবার পানির চাহিদা মিটতে পারে, কিন্তু পরিবেশের নয়। এর জন্য প্রয়োজন প্রকৃতি নির্ভর সমাধান। তবে এ ক্ষেত্রেও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কারণ, উৎসের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার সীমিত করতে হবে। এলাকাভিত্তিক বড় বড় পুকুর, খাল, জলাশয় খনন করে তাতে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। নদ নদী খনন করতে হবে। পানি ব্যবহারে সবাইকে মিতব্যয়ী হতে হবে।

লেখক: খুলনা ব্যুরোপ্রধান, দৈনিক ইনকিলাব।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন