সাম্প্রতিককালে শ্রীলংকা তাদের স্বাধীনতা-উত্তর ৭৪ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে জটিল অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে অগ্রসর অর্থনীতির দেশ শ্রীলংকা, যেখানে মাথাপিছু জিডিপি চার হাজার ডলারের বেশি। শ্রীলংকার ৯৫ শতাংশ মানুষ শিক্ষিত, তাদের শিক্ষাব্যবস্থা দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে গণমুখী। তাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থাও দক্ষিণ এশিয়ার সেরা, একমাত্র ভারতের কেরালার স্বাস্থ্যব্যবস্থা এর চাইতে উন্নততর ও সর্বজনীন। দক্ষিণ এশিয়ার পর্যটনের আকর্ষণের বড় ঠিকানাও ছিল শ্রীলংকা। অথচ, বছরখানেক ধরে শ্রীলংকার অর্থনীতি কঠিন সংকটে ক্রমশ হাবুডুবু খেতে খেতে এখন ধসে পড়েছে। দেশটিতে আমদানীকৃত পণ্যের ক্রমবর্ধমান ঘাটতি জনগণের জীবনকে পর্যুদস্ত করে দিয়েছে। বেশ কয়েকমাস ধরে ভয়ংকর খাদ্য সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশটি। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ একেবারে তলানীতে পৌঁছে যাওয়ায় বিদেশ থেকে খাদ্যদ্রব্য আমদানি করে সংকট মোকাবেলার সামর্থ্যও এখন তাদের নেই। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির ক্রমবর্ধমান ঘাটতি জনজীবনে অভূতপূর্ব বিপর্যয় ডেকে এনেছে। বিভিন্ন আইটেম কেনার জন্য লাইন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে, ফলে ক্রুদ্ধ জনতার সরকারবিরোধী সমাবেশও দিনদিন বেড়ে অবশেষে গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়েছে। শ্রীলংকান রুপির বৈদেশিক মান কিছুদিন আগেও ছিল এক ডলারে এক’শ নব্বই রুপি, গত দু’মাসে সেটা বেড়ে তিন’শ ত্রিশ রুপি ছাড়িয়ে গেছে। বর্তমানে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পঞ্চাশ মিলিয়ন ডলারেরও কম, অথচ আগামী এক বছরের মধ্যে শ্রীলংকার ৭.৩ বিলিয়ন ডলারের ঋণ সুদাসলে পরিশোধ করার কথা। শ্রীলংকা ইতোমধ্যেই নিজেকে ‘আর্থিক দেউলিয়া’ ঘোষণা করেছে এবং কোন বৈদেশিক ঋণ শোধ করবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। দেশটি এখন রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগতকারী রাজাপাকসে পরিবারকে উৎখাত করার জন্য গণঅভ্যুত্থানের সম্মুখীন হওয়ায় গত ৯ মে প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে পদত্যাগ করেছেন। অনেকের হয়তো জানা নেই, শ্রীলংকার সরকারে রাজাপাকসে পরিবারের পাঁচজন--প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী এবং আরো তিনজন মন্ত্রী ছিলেন। শ্রীলংকার সরকারী বাজেটের প্রায় ৭৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করত রাজাপাকসে পরিবার। অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত জনগণ পুরো এপ্রিল মাস জুড়ে কলম্বোর রাজপথে রাজাপাকসে পরিবারের প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রীদের পদত্যাগের দাবিতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু, মাহিন্দা রাজাপাকসের এক অবিমৃষ্যকারী ‘রাজনৈতিক গুন্ডামির’ কারণে গত ৯ মে সোমবার এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলন মারাত্মক সংঘাতপূর্ণ গণঅভ্যুত্থানে পর্যবসিত হলো, যেখানে একজন সংসদ-সদস্য সহ আটজন ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছেন। আন্দোলনের তীব্রতায় প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগে বাধ্য হওয়ার পর মাহিন্দা তাঁর সমর্থকদেরকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বাসে করে কলম্বোয় নিয়ে আসেন। এই ভাড়াটে গুন্ডারা বিনা উসকানিতে মাসাধিককাল ধরে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী জনতার উপর লাঠিসোঁটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং বেশ কয়েকজনকে হত্যা করে ও আরো বহু মানুষকে মারাত্মকভাবে আহত করে। এই হামলার খবর ছড়িয়ে পড়লে হাজার হাজার মানুষ ঘটনাস্থলে ছুটে আসে এবং গুন্ডাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এর জেরে সরকার-বিরোধী আন্দোলনকারীরা সরকার সমর্থকদেরকে গনপিটুনি দেওয়ার পাশাপাশি সরকারের মন্ত্রী, সংসদ-সদস্য এবং রাজাপাকসে পরিবারের বাড়ীঘর আগুনে পোড়ানো শুরু করে দেয় এবং অনেককে মারধোরের পাশাপাশি পানিতে চুবানো শুরু করে। এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রীর অফিসিয়াল বাসভবনে জনতা ঢুকে পড়তে উদ্যত হলে মাহিন্দা এবং তার পরিবার হেলিকপ্টারে চড়ে সেখান থেকে ভেগে গিয়ে ত্রিনকোমালির একটি নৌবাহিনী ঘাঁটিতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এখন গোতাবায়ার ক্ষমতা ধরে রাখার প্রাণপণ প্রয়াস চলছে।
দেশটির এই দেউলিয়াত্ব ডেকে এনেছে করোনা ভাইরাস মহামারি, উল্টাপাল্টা নানা প্রকল্পের জন্য বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের হিড়িক এবং রাতারাতি কৃষিখাতে ‘অর্গানিক ফার্মিং’ চালুর জন্য প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের একটি হঠকারী সিদ্ধান্ত। প্রেসিডেন্ট গোতাাবায়া দেশের কৃষিবিদ এবং বিজ্ঞানীদের সাথে শলা-পরামর্শ না করেই নিজের খামখেয়ালী সিদ্ধান্তে দেশের কৃষিতে রাসায়নিক সার এবং কীটনাশকের ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। তাঁর সরকার নাকি জৈব কম্পোস্ট সার সরবরাহের প্রক্রিয়া গড়ে তুলবে, যাতে রাসায়নিক সারের ‘প্রকৃতি-বান্ধব বিকল্প’ ব্যবহার করে খাদ্যদ্রব্য উৎপাদনে সাফল্য অর্জন করা যায়। কিন্তু, মতাদর্শগত অবস্থান থেকে ‘অর্গানিক ফার্মিং’ চালুর ঘোষণা দেওয়া এক কথা, আর ধাপে ধাপে পরিকল্পিত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে তা সফলভাবে চালু করার চ্যালেঞ্জ বাস্তবায়ন অনেক কঠিনÑ এটা হয়তো তাঁর কিংবা বড়ভাই প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসের বিবেচনায় যথাযথ গুরুত্ব পায়নি! কৃষক জৈব কম্পোস্ট সারের জন্য হাপিত্যেশ করলেও পুরো ফলন-মৌসুমে তার দেখা মেলেনি। ফলে, এক অভূতপূর্ব ফলন-বিপর্যয়ে পতিত হলো শ্রীলংকার কৃষিখাত। ‘অর্গানিক ফার্মিং’ নিয়ে তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে শ্রীলংকার কৃষিজাত খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন এক বছরে বিপর্যয়করভাবে এক-তৃতীয়াংশ কমে গেলো। অন্যদিকে, করোনা ভাইরাস মহামারি শ্রীলংকায় খুব বেশি মানুষের মৃত্যু না ঘটালেও সর্বনাশ ডেকে আনলো শ্রীলংকার বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের গুরুত্বপূর্ণ খাত পর্যটন খাতকে ধসিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে। গত দু’বছর ধরে সারা বিশে^র পর্যটন খাতে এহেন বিপর্যয় গেড়ে বসেছে, যা থেকে উত্তরণ এখনো সুদূরপরাহত। শ্রীলংকার রফতানি আয়ের আরো দুটো প্রধান সূত্র এলাচি এবং দারুচিনিও বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মহামারির দু’বছরে। একইসাথে যুক্ত হলো শ্রীলংকার অভিবাসীদের প্রেরিত রেমিট্যান্সের অভূতপূর্ব ধস। ফলে শ্রীলংকার বৈদেশিক আয়ে বড়সড় ধস নামলো এমন এক সময়ে, যখন কৃষিখাতের ফলন-বিপর্যয় খাদ্যদ্রব্যসহ প্রায় সকল নিত্য-প্রয়োজনীয় পণ্যের ক্ষেত্রে গুরুতর ঘাটতি সৃষ্টি করেছে।
এর সাথে যুক্ত হলো ২০০৯ সাল থেকে বৈদেশিক ঋণের অর্থে যত্রতত্র প্রকল্প গ্রহণের বদখাসলতের চরম মূল্য চুকানোর পালা। ২০০৯ সালে শ্রীলংকার তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে শ্রীলংকার গৃহযুদ্ধে ভারতের ভূমিকার কারণে ভারত থেকে নিজেদেরকে দূরে সরিয়ে চীনের দিকে ঝুঁকে পড়তে শুরু করেন। চীনও শ্রীলংকার ভূরাজনৈতিক অবস্থানের গুরুত্বের বিবেচনায় দেশটিকে নিজেদের প্রভাববলয়ে টেনে নেয়ার জন্য বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) এর আওতায় হাম্বানটোটায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ,
কলম্বোয় সমুদ্রবন্দরের কাছে চাইনিজ সিটি নির্মাণ, জঙ্গলাকীর্ণ স্থানে রাজাপাকসে বিমানবন্দর নির্মাণসহ আরো কয়েকটি প্রকল্পে সহজ শর্তে শ্রীলংকাকে প্রকল্পঋণ প্রদান করে। পরবর্তীতে যখন হাম্বানটোটা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ সম্পন্ন হয় তখন দেখা গেল যে বন্দর ব্যবহারের যথেষ্ট চাহিদা নেই। বন্দরের আয় বাড়াতে চরমভাবে ব্যর্থ হওয়ায় শেষ পর্যন্ত শ্রীলংকা ৯৯ বছরের জন্য বন্দরটিকে চীনের কাছে লীজ দিতে বাধ্য হয়। একই রকম বিপদে পড়তে হচ্ছে কলম্বোর চাইনিজ সিটি নিয়ে এবং বিমানবন্দর প্রকল্প নিয়ে। একইসাথে, দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি দ্রুত বাড়ানোর জন্য আন্তর্জাতিক সভরেন বন্ডের মাধ্যমে শ্রীলংকা প্রচুর বৈদেশিক ঋণ সংগ্রহ করেছিল, যেগুলোর ম্যাচিউরিটি শুরু হচ্ছে ২০২২ সাল থেকে। কিন্তু, এখন তো সুদাসলে ঐ বন্ডের অর্থ ফেরত দেওয়ার সামর্থ্য শ্রীলংকার নেই।
বাংলাদেশেও গত এক দশকে অনেকগুলো মেগা-প্রজেক্ট বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে যেগুলোর কয়েকটিকে স্বল্প-প্রয়োজনীয় অথবা অপ্রয়োজনীয় আখ্যা দেওয়া চলে। চলমান প্রকল্পের মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, ঢাকা থেকে পদ্মাসেতু হয়ে যশোর এবং পায়রা বন্দর পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প এবং চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী হয়ে কক্সবাজার ও ঘুমধুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প ‘সাদা হাতি’ প্রকল্পের নিকৃষ্ট উদাহরণ। রাশিয়ার ১২ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋণ সহ মোট এক লক্ষ তের হাজার কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে নির্মাণাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে বলে বলা হচ্ছে। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হলো, রাশিয়া ভারতে প্রায় একই ক্যাপাসিটির পরমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ করে দিয়েছে রূপপুরের অর্ধেক ব্যয়ে। অতএব, প্রশ্ন করা যৌক্তিক যে বাংলাদেশ কেন এত বেশি বৈদেশিক ঋণ নিয়ে রাশিয়ার সাথে এই পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের জন্য চুক্তি করেছে? আমাদের বর্তমান সরকার যে জনগণের কাছে জবাবদিহিতার ধার ধারে না তার সবচেয়ে নগ্ন উদাহরণ এই রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প। ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের অনেক বিকল্প প্রযুক্তি বিশে^ রয়েছে যেখানে রূপপুর প্রকল্পের অর্ধেক ব্যয়ে ঐ পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। তাহলে এত ব্যয়বহুল ‘সাদা হাতি’ প্রকল্প আমরা কেন গ্রহণ করলাম? এটা কার খামখেয়ালিপনার ফসল? এই ঋণ পরিশোধে ২০ বছর সময় লাগবে বলে সরকারীভাবেই জানানো হচ্ছে, কিন্তু ২০২৫ সাল থেকে ২০ বছর ধরে এই প্রকল্পের ঋণ পরিশোধের জন্য প্রতি কিস্তিতে বাংলাদেশকে সুদাসলে বছরে ৫৬৫ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হবে।
একইসাথে, যে দুটো রেলপথ প্রকল্পের কথা উল্লেখ করা হলো সেগুলো অনেকখানি অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প। ওয়াকিবহাল মহল সহজেই বুঝবেন যে পদ্মা সেতুর সড়কপথ চালু হওয়ার পর ঐ সেতুর মাধ্যমে ঢাকা-যশোর-পায়রা পর্যন্ত নির্মীয়মাণ রেলপথের অর্থনৈতিক ‘ফিজিবিলিটি’ ভবিষ্যতে খুব বেশি আকর্ষণীয় হওয়ার তেমন সুযোগ থাকে না, কারণ রেলপথটি মালামাল পরিবহনের তুলনামূলক খরচের বিবেচনায় সড়কপথের সাথে কখনোই প্রতিযোগিতামূলক বিবেচিত হবে না। ফলে, ভবিষ্যতে কয়েক বছরের জন্য এই রেলপথটি ‘আন্ডার-ইউটিলাইজড’ থেকে যাবে। অতএব, প্রথম কয়েক বছর ঐ প্রকল্পের সম্ভাব্য আয় দিয়ে ৪০ হাজার কোটি টাকায় বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পটির ২১,০০০ টাকা চৈনিক ঋণের সুদাসলে কিস্তি পরিশোধ করা সম্ভব হবে না। এমনকি, ভারতকে এই রেলপথ ব্যবহার করতে দিলেও অদূর ভবিষ্যতে প্রকল্পটি ‘সাদা হাতি’ প্রকল্পই থেকে যাবে। একই আশংকা সৃষ্টি হয়েছে চট্টগ্রাম-দোহাজারী-কক্সবাজার-ঘুমধুম রেলপথ প্রকল্প নিয়ে। ‘কুনমিং ইনিশিয়েটিভ’ আঞ্চলিক সহযোগিতা কর্মসূচির অধীনস্থ ‘বিসিআইএম ইকনমিক করিডোর’ যখন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার তোড়জোর চালু ছিল তখন বাংলাদেশকে মিয়ানমার হয়ে চীনের ইউনান প্রদেশের কুনমিং এর সাথে যুক্ত করার উদ্দেশ্যে এই রেলপথটি নির্মাণের পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু, ভারতে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ভারত ‘বিসিআইএম ইকনমিক করিডোর’ প্রতিষ্ঠার চুক্তি থেকে সরে গেছে। অতএব, এই রেলপথটিও অদূর ভবিষ্যতে ‘আন্ডার-ইউটিলাইজড’ হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। এই রেলপথের আয় দিয়ে প্রথম কয়েক বছর এই প্রকল্পের ঋণের কিস্তি শোধ করা যাবে না। এই তিনটি প্রকল্পই ‘ইকনমিক ফিজিবিলিটি’ এর দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হবে না। শ্রীলংকার ঋণের ফাঁদ সম্পর্কে আলোচনার সময় সেজন্যই এই তিনটি প্রকল্প বাংলাদেশের জন্য ভবিষ্যতে ঋণের বোঝা সৃষ্টি করবে বলে বিশেষজ্ঞরা মতামত ব্যক্ত করছেন।
দুঃখজনকভাবে সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে অত্যন্ত ব্যয়বহুল গ্ল্যামারাস প্রকল্প গ্রহণের চিন্তাভাবনা দেশের শীর্ষ নেতৃত্বের মনোজগত দখল করেছে। উদাহরণ হিসেবে নিচে উল্লিখিত প্রকল্প-প্রস্তাবগুলোর নাম এসে যাবে: ১) ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার বুলেট ট্রেন, ২) দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, ৩) পূর্বাচলে একশ’ দশ তলা-বিশিষ্ট বঙ্গবন্ধু বহুতল ভবন কমপ্লেক্স, ৪) শরীয়তপুরে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ৫) পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া দ্বিতীয় পদ্মা সেতু, ৬) নোয়াখালী বিমানবন্দর ৭) দ্বিতীয় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ প্রকল্প এবং ৮) ঢাকার বাইরে রাজধানী স্থানান্তর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পিএইচডি’র ছাত্র হিসেবে প্রকল্প-মূল্যায়ন সম্পর্কে যেহেতু আমার উচ্চতর জ্ঞান অর্জনের সুযোগ হয়েছে তাই এই প্রকল্পগুলোকে আমি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বর্তমান পর্যায়ে গ্রহণযোগ্য বিবেচনা করছি না। আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ, এসব প্রকল্প-প্রস্তাবের বাস্তবায়ন যে পর্যায়েই থাকুক সেগুলোর বাস্তবায়ন স্থগিত করা হোক্। প্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণের পরিবর্তে যদি এসব চটকদার ও স্বল্প-প্রয়োজনীয় প্রকল্প গৃহীত হয় তাহলে শ্রীলংকার মত ঋণগ্রস্ততার ফাঁদে পড়তে বাংলাদেশেরও দেরি হবে না। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২১ সালের আগস্টের ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে কমে ২০২২ সালের ২৪ মে ৪২.৩৩ বিলিয়ন ডলার হয়ে গেছে। ২০২০-২১ অর্থ-বছর পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের মোট ঋণ জিডিপি’র ৪২.৫ শতাংশ ছিল, কিন্তু এর মধ্যে জিডিপি’র ১৭.৫ শতাংশ ছিল ৬২.৪৩ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক ঋণ। চলমান মেগা-প্রজেক্টগুলোর ব্যয়ের ধারাবাহিকতায় বৈদেশিক ঋণ ৯১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে।
২০২১-২২ অর্থ-বছরের নয় মাসে বাংলাদেশের আমদানি বিল গত বছরের চাইতে ৪৬ শতাংশ বেড়ে গেছে, যেটাকে আসন্ন বিপদের ‘অশনি সংকেত’ আখ্যায়িত করাই সমীচীন। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, এই গতিতে আমদানি এল/সি খোলা অব্যাহত থাকলে ২০২২ সালের ৩০ জুন তারিখে ২০২১-২২ অর্থ-বছরের মোট আমদানি ৮০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যাবে। এর মানে, এই অর্থ-বছরের রফতানি আয় ৫০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানোর প্রাক্কলন সত্ত্বেও অর্থ-বছরের শেষে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে দাঁড়াতে পারে। ধারণা করা হচ্ছে, বর্তমান অর্থ-বছরে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স ২২-২৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে যাবে। অতএব, এটা দেশের জন্য একটা বিপদ ডেকে আনছে। কারণ, আমাদের ব্যালেন্স অব পেমেন্টসের কারেন্ট একাউন্টে এ-বছর প্রায় ৮-১০ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। লেনদেন ভারসাম্যের কারেন্ট একাউন্টে এত বড় ঘাটতি স্বাধীন বাংলাদেশে কখনো ঘটেনি। বরং, গত দুই দশক ধরে (গুটি কয়েক বছর ব্যতিরেকে) দেশের লেনদেন ভারসাম্যের কারেন্ট একাউন্টে উদ্বৃত্ত থাকাটাই নিয়মে পরিণত হয়েছিল। এর ফলে, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যেখানে ২০০১ সালে মাত্র ১.০৯ বিলিয়ন ডলারে নেমে গিয়েছিল সেখান থেকে গত দুই দশকে তা ক্রমাগতভাবে বেড়ে ২০২১ সালের আগস্টে ৪৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গিয়েছিল। এবারের আমদানির বেলাগাম বৃদ্ধির কারণে ইতোমধ্যেই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গত আট মাসে ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে কমে ৪২.৩৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গিয়েছে। আগামী মাসে রিজার্ভ আবারো কমে যেতে পারে। সেজন্যই আমার আকুল আহ্বান, সময় থাকতে আমদানি নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। আমার দৃঢ় বিশ^াস, আমদানিতে ওভার-ইনভয়েসিং পদ্ধতিতে বিদেশে পুঁজিপাচার বেলাগাম গতিতে বেড়ে চলার কারণেই এত দ্রুত আমদানি বিল বাড়ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রী ব্যাপারটি যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে সামাল না দিলে অর্থনীতি গুরুতর বিপদে পড়বে।
করোনা ভাইরাস মহামারির তান্ডব কমতে না কমতেই ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন এবং আগ্রাসনের মোকাবিলায় পশ্চিমা দেশগুলোর সহায়তায় ইউক্রেনের মরণপণ প্রতিরোধ সারা বিশ^কে এক ভয়াবহ যুদ্ধ-পরিস্থিতিতে নিক্ষেপ করেছে। সারা বিশে^র অর্থনীতিতে ভয়াবহ মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি হয়েছে। তেল, এলএনজি, রড, সিমেন্ট, ভোজ্যতেল, গম, ভুট্টাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারে আগুন লেগে গেছে, জাহাজভাড়া বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। এর আঁচ লেগেছে বাংলাদেশের আমদানিতে, দেশের আমদানি ব্যয় ৪৬ শতাংশ বৃদ্ধির পেছনে এটাও বড় কারণ। করোনা ভাইরাস মহামারি অনেকখানি নিয়ন্ত্রণে আসায় দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে গতি সঞ্চার হওয়ায় মূলধনি দ্রব্য আমদানিতেও বেশ কিছুটা গতি সঞ্চারিত হয়েছে নিঃসন্দেহে। কিন্তু, আমদানি এল/সি বেলাগাম গতিতে বাড়ার পেছনে প্রধান কারণ ওভার-ইনভয়েসিং পদ্ধতিতে বিদেশে পুঁজিপাচার আবারো পুরোদমে শুরু হওয়া। করোনা ভাইরাস মহামারির সময়ে হুন্ডি পদ্ধতি বেশ খানিকটা ঝিমিয়ে পড়েছিল চাহিদা এবং সরবরাহ দু’দিক থেকেই। এর সুফল বাংলাদেশ পেয়েছে মহামারির দু’বছরে ফর্মাল চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে দেশে রেমিট্যান্স প্রেরণের জোয়ার সৃষ্টির মাধ্যমে। আমাদের রফতানি আয়ে করোনা ভাইরাস মহামারি কিছুটা ধস নামালেও আমদানির শ্লথগতি এবং রেমিট্যান্সের জোয়ার দেশের ব্যালেন্স অব পেমেন্টসের কারেন্ট একাউন্টে ঘাটতি সৃষ্টি হতে দেয়নি। বরং দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে অভূতপূর্ব প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল এই দু’বছর ধরে, যার ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালের আগস্টে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এখন আবার হুন্ডি ব্যবসা চাঙা হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশের বর্তমান বেলাগাম আমদানির প্রবৃদ্ধি যদি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা না হয় তাহলে আগামী মাসগুলোতে আমাদের দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও ধসের প্রবণতা গেড়ে বসবে। এহেন ধস নামলে তিন/চার বছরের মধ্যেই ৪২ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ বিপজ্জনক স্তরে পৌঁছে যেতে পারে। সেজন্য সময় থাকতেই এ-ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রীকে সাবধান করে দিতে চাই। অবিলম্বে অর্থ-বছরের বাকি সময়ের আমদানির লাগাম কঠোরভাবে না টানলে ৩০ জুন ২০২২ তারিখে ব্যালেন্স অব পেমেন্টসের কারেন্ট একাউন্টের ৮-১০ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি সামাল দেওয়া যাবে না। (বাংলাদেশ ব্যাংক অবশ্য ইতোমধ্যেই আমদানি নিরুৎসাহিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে)। একইসাথে বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি এল/সি’তে ওভার-ইনভয়েসিং হচ্ছে কিনা তা পরীক্ষার জন্য জরুরী ভিত্তিতে একটি শক্তিশালী সেল গঠন করতে পারে, যেখান থেকে ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট’ ব্যতিরেকে কোন বাণিজ্যিক ব্যাংক এল/সি গুলো চূড়ান্তভাবে অর্থায়ন করতে পারবে না। ঐ প্রস্তাবিত সেল অতীতের বিভিন্ন বছরের আমদানির পরিমাণ, মূল্য এবং পণ্যের আন্তর্জাতিক দামের সাথে ইনভয়েসে উল্লিখিত দামের অসঙ্গতি চিহ্নিত করার জন্য তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তা নেবে। আগামী অর্থ-বছরের আমদানি নীতিতেও এহেন কঠোর নিয়ন্ত্রণ বহাল রাখতেই হবে। নয়তো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ধস আগামী বছরেও থামানো যাবে না।
২০২১-২২ অর্থ-বছরের বাজেটে ঋণের সুদাসল পরিশোধ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৬৮,৫৮৮ কোটি টাকা। মেগা-প্রজেক্টগুলোর ঋণ শোধের ‘গ্রেস-পিরিয়ড’ শেষ হলে আগামী অর্থ-বছরগুলোতে এই খাতে বরাদ্দ আরো অনেক দ্রুতগতিতে বাড়বে। সরকারের কর-জিডিপি’র অনুপাত যেখানে ৯ শতাংশের নিচে নেমে গেছে সেখানে ঋণ পরিশোধের জন্য দ্রুতবর্ধমান বাজেট-বরাদ্দ অশনি সংকেতের শামিল। একইসাথে খেয়াল রাখতে হবে, বাংলাদেশের অর্থনীতি পোষাক রফতানি এবং রেমিট্যান্সের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। বর্তমান অর্থ-বছরের রফতানি খাতের ৩৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি আশাব্যঞ্জক হলেও তা আমদানির ৪৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধির সাথে তাল মেলাতে পারছে না। রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধিও শ্লথ হয়ে গেছে। এই প্রবণতাগুলো গেড়ে বসলে আমাদের অর্থনীতি সংকটে পড়তে পারে।
লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ, সাবেক সভাপতি বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন