শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

পাঠ বিমুখতা ও আমাদের করণীয়

সাজ্জাদুল করিম | প্রকাশের সময় : ৫ জুন, ২০২২, ১২:০৪ এএম

সম্প্রতি বিবিসি বাংলা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যার শিরোনাম হলো, ‘পাবলিক লাইব্রেরি: বিমুখ পাঠক ফেরাতে কী করছে কর্তৃপক্ষ?’ প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, গত এক দশকে বাংলাদেশে পাবলিক লাইব্রেরিতে পাঠকের সংখ্যা অনেক কমেছে। এরকম খবর বা প্রতিবেদন মাঝে মাঝেই বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে আসে। এসকল প্রতিবেদনে পাঠক কমে যাওয়ার নানামুখী কারণ খুঁজে বের করা হয়। যার মধ্যে অন্যতম কারণ হিসেবে যেটিকে দেখানো হয় সেটি হলো, আমাদের পাঠাভ্যাস কমে যাওয়া। তাছাড়া প্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান আধিপত্য, লাইব্রেরিগুলোর নানা রকম সীমাবদ্ধতা, অবসর সময়ের অভাব, সিলেবাসকেন্দ্রিক লেখাপড়ার চাপ এবং সর্বোপরি ভোগবাদী জীবন ব্যবস্থার আগ্রাসন উল্লেখযোগ্য কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। অএই প্রবন্ধে, পাঠাভ্যাস কমে যাওয়া সম্পর্কে আমার কিছু পর্যবেক্ষণ উপস্থাপনের চেষ্টা করবো।

পাঠ বিমুখতার চিত্র উপস্থাপন করতে গিয়ে আমরা সাধারণত কী করি? আমরা লাইব্রেরিগুলোর করুণ চিত্র তুলে ধরে দাবি করি যে, আমাদের পাঠাভ্যাস কমে গিয়েছে। অর্থাৎ আমরা বলতে চাই, যেহেতু আজকাল মানুষ লাইব্রেরিতে খুব একটা যায় না, সেহেতু বুঝা যায় আমাদের পাঠাভ্যাস কমেছে। আমার কাছে মনে হয়, বিষয়টি নিয়ে ভিন্নভাবেও চিন্তা করার অবকাশ রয়েছে। লাইব্রেরিতে পাঠক কমে যাওয়া আর পাঠাভ্যাস কমে যাওয়া এক কথা নয়। নানা কারণেই আজকাল মানুষ লাইব্রেরিতে যাচ্ছে না। সেটি ভিন্ন বিষয়, কিন্তু এথেকে প্রমাণিত হয় না যে, আমাদের পাঠাভ্যাস কমে গিয়েছে।

পাঠ বলতে আমরা আসলে কী বুঝাতে চাই, সেটিও পরিষ্কার করতে হবে। পাঠের সংজ্ঞা, উদ্দেশ্য, ধরন ও পরিধি অনেক বিস্তৃত। অথচ এই শব্দটিকে আমরা সংকীর্ণ অর্থে বুঝে থাকি। এবিষয়ে আমরা ‘পাঠ, পাঠাভ্যাস ও পাঠক’ শিরোনামের অন্য একটি প্রবন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। সুতরাং এখানে আর কিছু বলছি না। লক্ষণীয় বিষয় হলো, শিক্ষায়তনিক বই, সংবাদপত্র বা সাময়িকী, চাকরির প্রস্তুতিমূলক বই-পুস্তক, গবেষণা ও কর্মজীবনের প্রয়োজনীয় বই পড়াও যে একধরনের পাঠ, তা আমরা স্বীকার করতে চাই না। যদিও বিভিন্ন উদ্দেশ্য বা কারণে আমরা পড়ালেখা করি যেমন: ডিগ্রি অর্জন, চাকরি লাভ, জ্ঞানার্জন, বিনোদন, গবেষণা, জীবিকার তাগিদ ইত্যাদি
পাঠ সামগ্রী, পাঠের উপকরণ বা মাধ্যম নিয়েও আমাদের মাঝে অস্পষ্টতা রয়েছে। আমরা সাধারণত কাগজের পটে অংকিত লিপি আওড়ানোকেই পাঠ বা পড়া বলে বিবেচনা করি। অথচ, আজকাল প্রযুক্তি নির্ভর বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করেও যে পড়ার সুযোগ তৈরি হচ্ছে; সেটিকে অস্বীকার করি বা বিবেচনায় নিতে কার্পণ্য করি।

হ্যাঁ, পাঠাভ্যাস কমেছে বলতে মোটাদাগে আমরা যা বুঝাতে চাই তা হলো: সৃজনশীল বই পাঠের অভ্যাস কমেছে। অর্থাৎ শিক্ষায়তনিক বা কর্মজীবনের প্রয়োজন ব্যতীত আমরা পড়ি না। প্রমথ চৌধুরীর ভাষায়, ‘আমাদের শিক্ষিত সম্প্রদায় মোটের উপর বাধ্য না হলে বই স্পর্শ করেন না। ছেলেরা যে নোট পড়ে এবং ছেলের বাপেরা যে নজির পড়েন, সে দুইই বাধ্য হয়ে অর্থাৎ পেটের দায়ে। সেইজন্য সাহিত্যচর্চা দেশে একরকম নেই বললেই হয়, কেননা সাহিত্য সাক্ষাৎভাবে উদরপূর্তির কাজে লাগে না।’ এর পেছনে অবশ্য কিছু কারণও রয়েছে। যেমন:

(১) আমাদের দেশে বেশিরভাগ পরিবারে পড়ার কোনো চর্চা নেই এবং তারা এর প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করে না। যেখানে শরীরে চাহিদা (ক্ষুধা) মেটাতেই আমরা ব্যতিব্যস্ত, সেখানে মন বলে যে কিছু একটা আছে এবং তারও যে খাদ্য প্রয়োজন এই সত্যটিই তো আমরা জানি না। তাহলে পড়ার চর্চাই বা থাকবে কেন?

(২) যারা পড়া-লেখার গুরুত্ব উপলব্ধি করেন তারাও শিক্ষায়তনিক পড়া বা সিলেবাসের বাইরের পড়াকে অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর মনে করেন। আর এর পেছনে রয়েছে ভুল বার্তা। যেমন পড়ালেখার গুরুত্ব বোঝাতে আমাদেরকে ছোটবেলা থেকেই শেখানো হয় ‘পড়া-লেখা করে যে, গাড়ি-ঘোড়া চড়ে সে।’ অর্থাৎ পড়া-লেখার উদ্দেশ্যই ভুলভাবে শেখানো হয়েছে। অথচ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন, ‘শিক্ষার উদ্দেশ্য মনুষ্যত্বের বিকাশ করা, চাকরি বা শুধু জ্ঞানার্জন নয়।’ ভালো মানুষ হওয়ার জন্য, সত্য ও সুন্দরের পূজারী হওয়ার জন্য যে পড়তে হয় তা আমাদের শেখানো হয় না।

(৩) আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এবং শিক্ষকগণও সিলেবাসের নির্দিষ্ট গুটিকয়েক বিষয়ের বাইরে যে জ্ঞানের বিশাল জগৎ রয়েছে তার সন্ধান দিতে পারে না বা দেয় না।

(৪) পড়া কাজটিকেই আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো নিরানন্দ ও বিরক্তিকর কাজে পরিণত করেছে। যে কথাটি প্রমথ চৌধুরী বলেছেন শতবছর পূর্বেই, ‘আমাদের স্কুল কলেজের শিক্ষার পদ্ধতি ঠিক উল্টো। সেখানে ছেলেদের বিদ্যে গেলানো হয়, তারা তা জীর্ণ করতে পারুক আর নাই পারুক। এর ফলে ছেলেরা শারীরিক ও মানসিক মন্দাগ্নিতে জীর্ণ শীর্ণ হয়ে কলেজ থেকে বেরিয়ে আসে।’ পড়ার মধ্যে যে আনন্দ রয়েছে সেই আনন্দকে আমরা ভয় ও বিতৃষ্ণায় পরিণত করে ফেলেছি। ফলস্বরূপ একবার যে ছেলেটি বিদ্যালয়ের গন্ডি পেরোয়, পড়ার সাথে তার সকল সম্পর্ক তখনই চুকে যায়। এজন্যই বোধ করি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘বাল্যকাল হইতে আমাদের শিক্ষার সহিত আনন্দ নাই। কেবল যাহা কিছু নিতান্ত আবশ্যক তাহাই কণ্ঠস্থ করিতেছি। তেমনি করিয়া কোনো মতে কাজ চলে মাত্র, কিন্তু মনের বিকাশ হয় না।’

(৫) মজার বিষয় হলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যে বইগুলো পড়ানো হয় তার বাংলা পরিভাষা করেছি ‘পাঠ্যবই’। এক অর্থে যার মানে দাঁড়ায়, বিদ্যালয়ে পড়ানো হয় না, এমন সকল বই হলো অপাঠ্য। অবচেতনভাবেই এই ভুল শব্দটি আমাদেরকে সৃজনশীল বই পাঠে অনুৎসাহিত করছে।

(৬) সৃজনশীল পড়ালেখা, সাহিত্য চর্চা, গবেষণা এরকম কাজকে আমরা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে মূল্যায়ন করি না। যে কারণে বিশ্বমানের লেখক, কবি, সাহিত্যিক, গবেষক বা বিজ্ঞানী আজ আর আমাদের দেশে জন্ম নিচ্ছে না। তাই আমাদের ছেলে-মেয়েরাও আজ আর লেখক, কবি, সাহিত্যিক, গবেষক, বিজ্ঞানী বা এরকম সৃজনশীল মানুষ হতে চায় না।

(৭) আমাদের পড়ালেখার মূল উদ্দেশ্যই থাকে অর্থ উপার্জন। তাই অর্থমূল্যে বিনিময় নেই বা যে সকল পুস্তক পাঠে সরাসরি অর্থ লাভ হয় না সে পড়ায় আমাদের আগ্রহও শূন্য। অথচ, মহাত্মা গান্ধী বলেছেন, ‘শিক্ষা জীবিকা উপার্জনের পথ বলে ধরে নেওয়া আমার সামান্য বুদ্ধিতে নিচু বৃত্তি বলে বোধ হয়।’

(৮) সর্বোপরি পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র, সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার কোথাও সৃজনশীল সাহিত্য পাঠের অনুকূল পরিবেশ না থাকাই আমাদেরকে পাঠবিমুখ জাতিতে পরিণত করছে।

পাঠাভ্যাস কমেছে বলতে আমরা যা বুঝাতে চাই তা হলো, কাগজে মুদ্রিত বই ও অন্যান্য পাঠসামগ্রী পড়ার অভ্যাস কমেছে। তার কারণ আমরা সবাই জানি, তথ্য প্রযুক্তির নিত্য-নতুন আবিষ্কার ও সহজলভ্যতা। এই চিত্রটি যে শুধু এখনই পরিলক্ষিত হচ্ছে তা কিন্তু নয়, বরং ঐতিহাসিকভাবেই আমরা জানি, মানুষের পাঠোপকরণ ধারাবহিকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। যেমন কাগজ, কালি ও মুদ্রণ যন্ত্র আবিষ্কারের পূর্বে মানুষ পশুর চামড়া, গাছের ছাল-বাকল, পাতা, পোড়া মাটির ফলক, কাঠ, পাথর ইত্যাদি পাঠোপকরণ হিসেবে ব্যবহার করতো। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা এখন প্রযুক্তিনির্ভর বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহারে অভ্যস্ত হচ্ছি।

পাঠাভ্যাস কমেছে বলতে আমরা বুঝাই, লাইব্রেরিতে গিয়ে পড়ার অভ্যাস কমেছে। অর্থাৎ এত কিছুর পরেও যারা পড়ার অভ্যাস ও চর্চা ধরে রেখেছেন তারাও আজকাল লাইব্রেরিতে গিয়ে পড়ার সময় ও সুযোগ পান না বা এর প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করেন না। এর পেছনেও যৌক্তিক কিছু কারণ রয়েছে। যেমন:

(১) আমাদের দেশের লাইব্রেরিগুলো যুগের সাথে তাল মিলিয়ে পাঠকদের উপযোগী পাঠোপকরণ, পরিবেশ ও ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে পারছে না।

(২) প্রযুক্তির নিত্য-নতুন আবিষ্কার ও তথ্যের অবাধ প্রবাহের সাথে পাল্লা দিয়ে লাইব্রেরিগুলো পেরে উঠছে না। আমাদের প্রয়োজনীয় তথ্য ও পাঠসামগ্রী আমরা লাইব্রেরিতে না গিয়েও সহজেই পেয়ে যাচ্ছি। ফলে লাইব্রেরির গুণগত ব্যবহার কমে যাচ্ছে।

(৩) সেই সাথে আমাদের আর্থ-সামজিক জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন, ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি, পাঠোপকরণের সহজলভ্যতা, তথ্যের মহাবিস্ফোরণ ইত্যাদিও লাইব্রেরির পাঠক হ্রাসে ভূমিকা রাখছে। বইপ্রেমী অনেক রুচিশীল পাঠক এখন নিজেরাই তাদের পছন্দের বই কিনে নিজস্ব সংগ্রহে রাখছেন। ফলে লাইব্রেরিতে যাওয়ার অভ্যাস কমেছে।

উপসংহারে আমরা একথাই বলতে চাই, পাঠবিমুখতা বা পাঠাভ্যাস কমে যাওয়া কথাটি একটি ব্যাখ্যা সাপেক্ষ বিষয় এবং এই অবস্থার পেছনে নানাবিধ কারণ রয়েছে। ঢালাওভাবে শুধু পাঠক বা লাইব্রেরির উপর দোষ চাপালেই এই অবস্থার উন্নতি হবে না। পাঠ বিমুখতার এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে একটি সৃজনশীল, আলোকিত ও উন্নত জাতি বিনির্মাণে সময় এসেছে এখনই কাজ করার। এজন্য প্রয়োজন একটি সামাজিক আন্দোলনের যেখানে পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র, সমাজ, রাষ্ট্র তথা সকলের সম্মিলিতভাবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ রয়েছে। তা না হলে শুধু লাইব্রেরির একার পক্ষে পাঠাভ্যাসে আগ্রহ তৈরি ও পাঠ বিমুখতার সংস্কৃতি রোধ করা সম্ভব নয়।


লেখক: জেলা লাইব্রেরিয়ান, শেরপুর
sazzad.karim70@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন