সুষ্ঠুভাবে দেশ পরিচালনা এবং দেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য সরকার যে রাজস্ব আয় করে থাকে, তার বড় একটি অংশ আয়কর খাত থেকে আসে। প্রতি বছর জুন মাসে সরকার সংসদে বাজেট পেশ করে থাকে। গত ২১-২২ অর্থবছরে দেশের মোট বাজেট ছিল ৬ লক্ষ ৩ হাজার ৬ শত ৮১ কোটি টাকা। মোট বাজেটের ১৭.৩৯ শতাংশ অর্থাৎ ১ লক্ষ ৪ হাজার ৯ শত ৮১ কোটি টাকাই আয়কর খাত থেকে আসবে বলে নির্ধারণ করা ছিল। আমাদের দেশে আয়কর আইন অনুযায়ী পুরুষ, মহিলা, প্রতিবন্ধী, মুক্তিযোদ্ধা প্রভৃতির আয়করের আওতায় আসার নিয়ম আছে। আয়কর আইন শিথিলের পর প্রথম ১ লক্ষ টাকা আয় পর্যন্ত ৫ শতাংশ, পরবর্তী ৩ লক্ষ টাকায় ১০ শতাংশ, পরবর্তী ৪ লক্ষ টাকায় ১৫ শতাংশ, পরবর্তী ৫ লক্ষ টাকায় ২০ শতাংশ এবং এর পরে অবশিষ্ট আয়ের উপর ২৫ শতাংশ হারে আয়কর দেয়ার বিধান করা হয়েছিল। এই নিয়মে শিথিলযোগ্য আয়ের পরে পরবর্তী ১ লক্ষ টাকার জন্য ৫ % হারে ৫ হাজার টাকা, পরবর্তী ৩ লক্ষ টাকার জন্য ১০% হারে ৩০ হাজার টাকা, পরবর্তী ৪ লক্ষ টাকার জন্য ১৫% হারে ৬০ হাজার টাকা, পরবর্তী ৫ লক্ষ টাকার জন্য ২০% হারে ১ লক্ষ টাকা। এ হিসাবে কারোর বাৎসরিক আয় যদি ১৬ লক্ষ টাকা হয় তবে তাকে মোট আয়কর দিতে হবে ১ লক্ষ ৯৫ হাজার টাকা। এর উপরে যদি কারো আয় আর মাত্র ৪ লক্ষ টাকা, অর্থাৎ মোট বাৎসরিক আয় যদি ২০ লক্ষ টাকা হয়, তবে তাকে আয়কর দিতে হবে ২ লক্ষ ৯৫ হাজার টাকা।
করের নির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি বছরে ৫০ লক্ষ টাকা আয় দেখালে তাকে তাকে কর দিতে হবে গড় প্রায় ২১ শতাংশ হারে ১০ লক্ষ ৪৫ হাজার টাকা। কোম্পানির ক্ষেত্রে এই হার এর থেকেও অনেক বেশি। ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে আয়ের ৩৭.৫% এবং সিগারেট, বিড়ি, জর্দ্দা, গুলসহ সব ধরনের তামাকজাত কোম্পানি ও মোবাইল ফোন অপারেটর কো¤পানির ক্ষেত্রে উক্ত আয়ের ৪৫% হারে কর নির্ধারণ করা থাকলেও বাস্তবে অনেকেই এই নিয়ম মেনে চলে না। অধিক হারে আয়কর দেওয়ার নিয়মের কারণেই আয়কর দাতারা বিভিন্ন পথ অবলম্বন করে কর ফাঁকি দিয়ে থাকেন। এর ফলে বৈধপথে উপার্জন হওয়া সত্ত্বেও অপ্রদর্শনের কারণে এ টাকা বৈধতা হারাচ্ছে। আর এ সুযোগেই কিছু মধ্যভোগী-সুবিধাবাদী, ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সুবিধা নিচ্ছে। তাছাড়া আবাসিক বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্ট ক্রয়ের ক্ষেত্রে এলাকাভিত্তিক ঢাকার গুলশান, বনানী, মতিঝিল, দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকায় প্রতি বর্গমিটার হিসাবে ৬ হাজার টাকা, সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ২শ বর্গমিটারের অধিক আয়তন বিশিষ্ট অ্যাপার্টমেন্টের ক্ষেত্রে প্রতি বর্গমিটারে ১ হাজার ৩শ টাকা এবং জেলা সদরের পৌর এলাকার ২শ বর্গমিটারের অধিক আয়তন বিশিষ্ট অ্যাপার্টমেন্টের ক্ষেত্রে প্রতি বর্গমিটারে ৬শ টাকা নির্ধারণ করা আছে। সড়ক পথে যাত্রীবাহী বাস এবং পণ্য বহনকারী ট্রাকের ক্ষেত্রে ধারণ ক্ষমতা ও মডেল ভেদে বছরে ৭ হাজার ৫শ টাকা থেকে সাড়ে ১২ হাজার টাকা পর্যন্ত নির্ধারণ করা আছে। তাছাড়া প্রাইভেট গাড়ির ক্ষেত্রে ১৫০০ সিসি কার ও জিপের জন্য ২৫ হাজার, ২০০০ সিসি পর্যন্ত ৫০ হাজার টাকা, ২০০০ থেকে ২৫০০ সিসি পর্যন্ত ৭৫ হাজার টাকা, ২৫০০ সিসি থেকে ৩০০০ সিসি পর্যন্ত ১ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা, ৩০০০ থেকে ৩৫০০ সিসি পর্যন্ত ১ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা, ৩৫০০ সিসি থেকে যত উপরেই হোক ২ লক্ষ টাকা নির্ধারণ করা আছে। এছাড়া প্রতিটি মাইক্রোবাসের জন্য ৩০ হাজার টাকা নির্ধারিত আছে।
সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, একজন নাগরিক তার কর্মজীবন শুরু হওয়ার পর, ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের জন্য ৫ হাজার, অন্যান্য সিটি কর্পোরেশনের জন্য ৪ হাজার টাকা আয়কর দিয়ে নথিভুক্ত হতে পারেন। এছাড়া অন্যান্য এলাকার জন্য ৩ হাজার টাকা আয়কর দিয়ে শুরু করলে সর্বোচ্চ ১৫ লক্ষ টাকা তার আয়কর নথিতে সাদা টাকা হিসাবে মূলধন দেখানোর নিয়ম আছে। এছাড়াও উক্ত নথিতে পৈত্রিক সম্পত্তি যোগ হতে পারে। এরপর তার কর্মজীবনের সমস্ত আয়ের ওপর নির্ধারিত কর পরিশোধের মাধ্যমে স্থাবর, অস্থাবর সম্পত্তি ও মূলধন বাড়ার কথা থাকলেও করদাতার আয়কর নথির সঙ্গে বাস্তব অবস্থার তেমন মিল পাওয়া যায় না। তাছাড়া দেশে লক্ষ লক্ষ যানবাহন (বাস-ট্রাক, প্রাইভেটকার, জিপ, মাইক্রো) এবং একই ব্যক্তির একাধিক গাড়ি থাকা সত্ত্বেও অনেকের আয়কর নথিতে মূলধন হিসাবে কমমূল্যের দুই-একটি গাড়ি দেখানো আছে। গাড়ির প্রকৃত সংখ্যা বা মূল্য মূলধনে দেখানো হয় না। একজন নাগরিকের বাড়ি, গাড়ি, জায়গা, জমি, সম্পদের মূল্য ৫ কোটি টাকা হলেও তার আয়কর নথিতে হিসাব লেখানো আছে হয়ত ৩০ থেকে ৪০ লক্ষ টাকা, যা প্রকৃত হিসাবের ১৫ ভাগেরও কম। এতে করে সরকার করদাতার কাছ থেকে আয়কর হারাচ্ছে, অন্য দিকে অধিক কর নির্ধারণ করায় করদাতা দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে সরকারকে কর দিতে অনীহা প্রকাশ করছে। অনেক বড় বড় ব্যবসায়ীর বৈধ পথে আয় করা অপ্রদর্শিত টাকা, অধিক হারে আয়কর নির্ধারণের কারণে সাদা টাকা হিসাবে বৈধতা না পাওয়ায়, দেশে বিনিয়োগ করার সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না। এ কারণে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে। এছাড়াও অবৈধভাবে আয় করা কালো টাকাও অধিকহারে বিদেশে পাচার হচ্ছে।
সাধারণত, একটি উপজেলা শহরে পৌর এলাকাধীন একতলা থেকে তিনতলা পর্যন্ত ব্যবসায়িক এবং আবাসিক ভবনের সংখ্যা কমপক্ষে ৩০০টি। একেকটি ভবনের মূল্য আনুমানিক জমিসহ এক কোটি টাকার অনেক ঊর্ধ্বে। উল্লেখিত ভবনের মূল্য আয়কর নথিতে মূলধন হিসাবে ১ কোটি টাকা দেখালে শতকরা ২ শতাংশ হারে আয়কর ধরা হলেও তাকে ওই ভবনটির জন্য দুই লক্ষ টাকা আয়কর দিতে হবে। এ কারণেই দেখা যায়, কোনো একটি উপজেলা শহরের ৩০০ ভবনের মধ্যে ১০০ ভবনও আয়কর দাতার নথিতে দেখানো নাই। অথচ, উপজেলা শহরে শুধু ৩০০ বাড়ির সর্বনিম্ন ২% হারে সরকারকে আয়কর দিলে প্রতি উপজেলায় অতিরিক্ত প্রায় ৬ কোটি টাকা সরকারের রাজস্ব খাতে আয় হবে। একই নিয়মে প্রতি জেলা শহরে কমপক্ষে ১০ গুণ হারে আয় হবে প্রায় ৬০ কোটি টাকা। তাহলে ৬৪ জেলায় রাজস্ব আয় হবে ৩ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা। পুরাতন জেলা শহরে এর ১০ গুণ বেশি টাকা কর আদায় হবে। বিভাগীয় শহরে ভবনের সংখ্যা জেলা শহর থেকে অন্তত ১০ গুণ বেশি। তাহলে কর আদায় হবে হাজার হাজার কোটি টাকা। রাজধানীসহ দেশের বড় বড় শহরগুলোয় লক্ষ লক্ষ বাণিজ্যিক ও আবাসিক বাড়ির মূল্যকে মূলধন হিসাবে সর্বনিম্ন হারেও আয়কর নির্ধারণ করে আদায়ের সুযোগ সৃষ্টি করলে সরকারের আয় হবে হাজার গুণ বেশি টাকা।
করদাতাদের কাছে করের হার অত্যন্ত বেশি হওয়ার কারণে তারা কর দিতে আগ্রহ হারাচ্ছে। এছাড়াও ব্যবসায়ীদের উৎপাদন ও বিক্রয়ের উপরে অধিক হারে ভ্যাট নির্ধারণ করায় ব্যবসায়ীরা দিশেহারা। অনেক করদাতার সঙ্গে আলাপে জানা যায়, সরকার নিম্ন হারে কর দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি করলে, তারা বৈধপথে অপ্রদর্শিত আয়ের আয়কর দিয়ে সমস্ত স্থাবর, অস্থাবর সম্পত্তি, নগদ টাকা, স্বর্ণালংকার প্রদর্শন করে দায়বদ্ধতা থেকে মুক্ত হতে চায়। সরকার স্বল্প হারে কর নির্ধারণ করলে আয় প্রদর্শনের সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং সরকারের রাজস্ব আয় অনেক বেড়ে যাবে। অন্যদিকে বৈধ পথে অপ্রদর্শিত আয় প্রদর্শন করার সুযোগ পেলে দেশে বিনিয়োগের অনেক সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং বিদেশে অর্থ পাচার অনেকাংশে কমে যাবে। তাছাড়া করদাতা স্ব-ইচ্ছায় কর দিলে পরামর্শদাতা, মধ্যভোগীদের দৌরাত্ম্য কমবে। এতে করদাতাদের ভোগান্তি বন্ধ হবে এবং সবাই স্ব-ইচ্ছায় কর দিতে উৎসাহিত হবে।
দেশকে উন্নতির দিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য রাজস্ব আয়ের বিকল্প নাই। কাজেই আয় করের হার শিথিল করা হলে বৈধ পথে উপার্জিত অপ্রদর্শিত সম্পদ, টাকা-পয়সা ধারাবাহিক প্রমাণ সাপেক্ষে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রদর্শন করার সুযোগ দিলে সরকারের আয় বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে। এতে করে করদাতারা প্রতি বছর স্বইচ্ছায় তার সঠিক আয় প্রদর্শন করে কর দেয়ার জন্য উৎসাহিত হবে। এছাড়াও সহজ শর্তে কর হার কমিয়ে আনলে নতুন করদাতার সংখ্যাও অনেক বেড়ে যাবে, ফলে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে। তাছাড়া অস্বাস্থ্যকর নেশা জাতীয় দ্রব্য ব্যবহার নিরুৎসাহিত করার জন্য ৪৫ শতাংশের জায়গায় ১০০ শতাংশ কর নির্ধারণ করা যেতে পারে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, যেন অবৈধ পথে আয়, ধারাবাহিকতা না থাকা, আয়ের উৎস না থাকা, অধিক হারে অপ্রত্যাশিত আয় দেখানো বা ইতিপূর্বে আয়কর নথি না থাকা, এদের এ সুযোগের আওতায় আনা যাবে না। দুর্নীতিবাজরা এ সুযোগের আওতায় এলে অতি উৎসাহিত হয়ে কালোটাকা, সাদা করার সুযোগ নিতে পারে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
makader958@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন