এই প্রশ্ন আমরা বাধ্য হয়েই করছি। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর সে দেশের সামরিক বাহিনী ও উগ্রবাদী বৌদ্ধরা যেভাবে হামলে পড়েছে, সাম্প্রতিক ইতিহাসে তার কোনো দ্বিতীয় নজির নেই। একটি অবিশ্বাসযোগ্য অভিযোগের ভিত্তিতে মিয়ানমার সরকার রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নির্মম-নৃশংস সামরিক অভিযান শুরু করে এ মাসের প্রথম দিকে। অভিযানে যুক্ত হয় সেখানকার উগ্রবাদী বৌদ্ধরা। এই যুগপৎ অভিযান সেই থেকে লাগাতার চলছে। নির্বিচার হত্যা, গ্রেফতার, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, বিতাড়নসহ এমন কোনো বর্বরতা-নৃশংসতা নেই যা সেখানে চালানো হচ্ছে না। এ পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের শত শত গ্রাম পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। পুড়িয়ে মারা হয়েছে নারী-পুরুষ-শিশুদের। হত্যা করা হয়েছে তিনশ’ রোহিঙ্গাকে। ঘরবাড়ি ছাড়া করা হয়েছে দেড় লাখেরও বেশি মানুষকে। অসংখ্য রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশু প্রাণের ভয়ে জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছে। অনেকে সাগরে ভেসেছে ভেলায়-নৌকায়। দেশে-ঘরবাড়িতে-মাটিতে-সাগরে কোথাও তাদের নিরাপত্তা নেই, নিশ্চিত আশ্রয় নেই। সম্পূর্ণ বিপন্ন ও নিরুপায় হয়ে যারা বাংলাদেশে আশ্রয় খোঁজার জন্য আসছে, বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় না দিয়ে ফিরিয়ে দিচ্ছে। এই দুর্ভাগ্যপীড়িত, ভীত-সন্ত্রস্ত, আশ্রয়হীন, স্বদেশে পরবাসী এবং জাতিগত নির্মূলীকরণের শিকার রোহিঙ্গারা তাহলে যাবে কোথায়? কে তাদের আশা-ভরসা দেবে, কে আশ্রয় দেবে, নিরাপত্তা? তারা কি এভাবে নিঃশেষ ও নির্মূল হয়ে যাবে? এসব প্রশ্নের জবাব বিশ্ববিবেকের কাছে নেই। বিশ্ববিবেক অথর্ব, নীরব।
বিস্ময়কর এই যে, মিয়ানমারের বাংলাদেশসহ অন্যান্য প্রতিবেশী দেশ রোহিঙ্গাদের এই দোজখী নিপীড়ন-নির্যাতন ও নির্মূলীকরণ নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করছে না, তাদের প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে না। জাতিসংঘ, ওআইসি, সার্ক, আসিয়ান, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ তাবৎ রাষ্ট্রসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, ব্রিটেন, জার্মানি, ফ্রান্স, সউদী আরবসহ প্রভাবশালী রাষ্ট্রসমূহ কার্যত নীরবতা পালন করে যাচ্ছে। না হয় যৎসামান্য যা কিছু বলছে, তা লিফ সার্ভিস ছাড়া কিছুই নয়। এসব কথায় কোনো পাত্তা দিচ্ছে না মিয়ানমার। আজকের এই সভ্যতাগর্বী বিশ্বে সকলের চোখের সামনে একটি সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠী ক্লিনজিংয়ের শিকার হয়ে নির্মূল হয়ে যাবে, এটা ভাবাই যায় না। অথচ বাস্তবতা সাক্ষ্য দিচ্ছে এমনই। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের ভূমিপুত্র। বংশপরম্পরায় তারা শত শত বছর ধরে সেখানে বসবাস করছে। তাদের ভাগ্যের নির্মম পরিহাস এই যে, ভূমিপুত্র হিসেবে তাদের কোনো স্বীকৃতি নেই। নাগরিক অধিকারও নেই। এই স্বীকৃতি ও অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। বিশ্বে রোহিঙ্গাই একমাত্র জাতি-গোষ্ঠী, যার কোনো দেশ নেই। রোহিঙ্গাদের দেশহীন, নাগরিক পরিচয়হীন করে নির্মূলীকরণ, নিশ্চিহ্নকরণ জোরদার করা হয়েছে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকার বছরের পর বছর ধরে রোহিঙ্গাদের ওপর অকথ্য ও দুর্বিষহ আচরণ করছে। জুলুম-পীড়ন, উৎখাত-উৎসাদন করে তাদের সম্পূর্ণ বিপন্ন ও নিরালম্ব করে দিয়েছে। আশা করা হয়েছিল, গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে, রোহিঙ্গারা তাদের হৃত অধিকার ফিরে পাবে, নিরাপত্তা পাবে, উন্নয়ন ও আত্মবিকাশের সুযোগ লাভ করবে। দীর্ঘদিন পর সে দেশে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেই সরকারের প্রকৃত প্রধান হয়েছেন নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়া অং সান সুচি। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, সামরিক জান্তা সরকারের চেয়েও সুচির গণতান্ত্রিক সরকার অনেক বেশি নিষ্ঠুর, সাম্প্রদায়িক ও অমানবিক। সর্বশেষ ২০১২ সালে রাখাইনে রোহিঙ্গারা হত্যা-নির্যাতন, উৎখাত-বিতাড়নের শিকার হয়েছিল। তখনো ব্যাপকভাবে হত্যা, গ্রেফতার, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, বিতাড়নের ঘটনা ঘটেছিল। পর্যবেক্ষকদের মতে, এখনকার পরিস্থিতি ২০১২ সালের চেয়েও খারাপ। নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতার মাত্রা তখনকার চেয়ে এখন অনেক বেশি।
সঙ্গত প্রশ্ন, রোহিঙ্গারা কি এভাবেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে? বহু কথিত মানবতাবাদী বিশ্ব, বিবেকবাদী বিশ্ব কি তাদের জন্য কিছুই করবে না? তাদের নিজভূমে প্রতিষ্ঠিত ও নিরাপদ করতে উদ্যোগী হবে না? এই দুর্দিনে এতটুকু অভয় ও আশ্রয় দিতে পারবে না? তাহলে কেন বিশ্বে রয়েছে বিভিন্ন রাষ্ট্রসংঘ, মানবতার ধ্বজাধারী রাষ্ট্রসমূহ এবং মানবতাবাদী সংস্থা ও সংগঠন? রোহিঙ্গাদের ‘অপরাধ’ কি এই যে, তারা মুসলমান এবং একটি দেশে সংখ্যালঘু? আমরা বিপন্ন-বিপর্যন্ত রোহিঙ্গাদের পক্ষে মানবতার ডাক শুনতে চাই, বিশ্ববিবেকের সোচ্চার কণ্ঠস্বর শুনতে চাই। আমরা চাই তাদের পাশে এসে দাঁড়াক প্রতিবেশীসহ সকল দেশ, রাষ্ট্রসংঘ এবং সংস্থা ও সংগঠন। মিয়ানমারের নিকটতম প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশের ভূমিকা আরো জোরদার হবে, এটা প্রত্যাশিত হলেও দেখা যাচ্ছে, কোথায় যেন একটা দ্বিধা রয়েছে। এ দ্বিধার আশু অবসান কাম্য। বাংলাদেশসহ মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশগুলো চলমান পরিস্থিতির অবসানে সক্রিয়ভাবে এগিয়ে এলে তার ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া আন্তর্জাতিক মহল থেকে পাওয়া সম্ভব হতে পারে। মুসলমান নয়, সংখ্যালঘু নয়, মানুষ ও মানবতা সঙ্কটাপন্ন, এই চেতনা জাগ্রত হলে বেঁচে যেতে পারে রোহিঙ্গারা। অবিলম্বে তাদের ওপর হত্যা-নির্যাতন উচ্ছেদের তা-ব বন্ধ হতে হবে। এ জন্য মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির বিকল্প নেই। রোহিঙ্গাদের রক্ষা করতেই এ চাপ জরুরি। বিশ্বসংস্থা, প্রভাবশালী দেশসমূহ এবং বিশেষ করে ইসলামী বিশ্ব এ ব্যাপারে ত্বরিত ও কার্যকর পদক্ষেপ নেবে, এটাই আমরা আশা করি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন