সিন্ডিকেট-এর সংজ্ঞা: আভিধানিক অর্থ: সিন্ডিকেট ইংরেজি শব্দ তার বাংলা হলো, গুদামজাত করা, মজুদ করে রাখা। সিন্ডিকেটের আরবী প্রতিশব্দ হল, ‘আল-ইহতিকার'। প্রথম আরবী অভিধান রচয়িতা খলিল ইবনু আহমদ আল-ফারাহিদী রহ. বলেন, খাদ্যদ্রব্য বা খাদ্যজাত অন্যান্য জিনিস মজুদ করাকে সিন্ডিকেট বলে। এর অর্থ: জমা করা। সুতরাং যে ব্যক্তি মূল্য বৃদ্ধির অপেক্ষায় খাদ্যদ্রব্য জমা করে রাখে তাকে মজুদদার বলে। (আল-আইন ৩-৬২)।
পারিভাষিক অর্থ: মজুদদারির পারিভাষিক অর্থ বর্ণনা করতে গিয়ে হাফেয ইবনু হাজার আসকালানী রহ. বলেন, নিজের প্রয়োজন মুক্ত থাকা এবং জনগণের প্রয়োজন সত্ত্বেও মূল্য বৃদ্ধির অপেক্ষায় খাদ্যদ্রব্য বিক্রি করা থেকে বিরত থাকাকে সিন্ডিকেট বা মজুমদারী বলে। (ফাতহুল বারী ৪-৪৪০।)
ইমাম আবুদাঊদ রহ. বলেন, আমি ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল রহ.-কে জিজ্ঞাসা করলাম, কোন জিনিস গুদামজাত করা নিষেধ? তিনি বললেন, মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিস। অর্থাৎ যাতে মানুষের জীবন ও জীবিকা (খাদ্য) রয়েছে। ইমাম আওযাঈ রহ. বলেন, যে ব্যক্তি পণ্য বাজারজাত করার পথে প্রতিবন্ধক হয় সেই মজুদদার। অর্থাৎ বাজারে বাজারে ঘুরে মানুষের প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য মজুদকরণের উদ্দেশ্যে ক্রয় করার কাজে যে নিজেকে নিয়োজিত করে তাকে মজুদদার বলে। (আবূদাঊদ হা-৩৪৪৭; ইমাম শাওকানী, নায়লুল আওতার (বৈরূত: দারুল কিতাব আল-আরাবী, ১৪২০ হি:/২০০০ খ্রি:), ৩-৬০৫।)
আধুনিক গবেষক আহমাদ হিলমী সাইফ আন-নাছর বলেন, সিন্ডিকেট হলো, মানুষের প্রয়োজনীয় জিনিস আটকে রাখা। সেটা খাদ্যদ্রব্য হোক বা অন্য কিছু। যা আটকে রেখে মানুষকে ক্ষতিগ্রস্থ করা হয়। বর্তমান সময়ে ‘সিন্ডিকেট’ শব্দটি আমাদের মাঝে বহুল পরিচত এবং প্রসিদ্ধ। ছোট থেকে বড় প্রায় সবার মুখেই এখন সিন্ডিকেট শব্দটি ব্যাপক হারে উচ্চারিত হচ্ছে। কেউ উচ্চারণ করে এ থেকে লাভবান হয়ে আর কেউ বা এর জাঁতা কলে পিষ্ট হয়ে। তাছাড়া পত্র-পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলে চোখ বুলাতেই ভেসে উঠে সিন্ডিকেট চক্রের বাজার দখলের কথা।
সিন্ডিকেট চক্র যখন ইসলামী হুকুম অমান্য করে পণ্য বা মালপত্র গুদামজাত করে, তখন সাধারণ জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে বিভিন্ন পণ্য সংগ্রহ করা শুরু করে। এর কারণ হল, সরকার প্রতিটি পণ্যের অল্প মূল্য নির্ধারণ করে দেয়। এ নির্ধারণকৃত মূল্যের সুযোগ নিয়ে কুচক্রী মহল পণ্য রপ্তানি করা বন্ধ করে দেয়। পরবর্তীতে যখন বাজারে পণ্যের সংকট দেখা দেয় তখন পণের মূল্য বৃদ্ধি করে তা তারা বাজারজাত করে। ফলাফল দাঁড়ায়, পণ্যের মূল্য আকাশচুম্বী। যা ক্রয় করা সাধারণ জনগণের সাধ্যের বাইরে চলে যায়। ভোগান্তির শিকার হতে হয়। সবচে' বেশি ভোগান্তির শিকার হয়; নিম্ন, নিম্ন মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক জনগণ। তারা না পারে চড়া দামে কিনে নিতে আর না পারে কিনে জমা করে রাখতে। অথচ ইসলামে এমনটি করাকে সম্পূর্ণ নাজায়েজ ও হারাম বলেছে।
রাসূলু সা. বলেন, শুধুমাত্র পাপী ব্যক্তিই মজুদদারী বা সিন্ডিকেট করে থাকে। (মুসলিম : ১৬০৫)। রাসূল সা. আরো বলেন, যে ব্যক্তি মুসলমানদের উপর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে মজুদদারী করবে, সে গোনাহগার। হযরত মাকিল বিন ইয়াসার রা. বর্ণনা করেছেন, তিনি যখন রোগাক্রান্ত হলেন তখন উমাইয়া গভর্ণর উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদ তাঁকে দেখতে এলেন। তিনি তাঁকে বললেন, হে মাকিল! আপনার জানা মতে, আমি কি কোনো হারাম রক্তপাত করেছি? তিনি বললেন, আমি জানি না। উবায়দুল্লাহ পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি জানেন আমি মুসলমানদের পণ্যের মূল্যে নির্ধারণে কোন হস্তক্ষেপ করেছি? তিনি বললেন, আমি জানি না। অতঃপর মাকিল লোকদেরকে বললেন, তোমরা আমাকে বসিয়ে দাও। লোকেরা তাঁকে বসিয়ে দিল। তিনি বর্ণনা করলেন, হে উবায়দুল্লাহ! শুনুন, আমি আপনাকে একটি হাদিস শোনাচ্ছি, যা রাসূল সা.–এর কাছ থেকে আমি মাত্র এক-দুইবার শুনিনি বরং বহুবার শুনেছি। তিনি বলেছেন,–মুসলিম জনগণের জন্যে পণ্যদ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে যদি কেউ কোনরূপ হস্তক্ষেপ করে, তাহলে আল্লাহ তা‘আলার অধিকার হলো তিনি ক্বিয়ামতের দিন তাকে জাহান্নামের একটি বড় আগুনের স্থানের উপর বসাবেন’। (আহমাদ, হা/১৯৪২৬, শু‘আইব আরনাঊত বলেছেন, ‘এর সনদ উত্তম’; আল-হালালু ওয়াল হারামু ফিল ইসলাম, পৃ: ২২৫)। তা ছাড়া সাহাবিদের আসার থেকেও জানা যায় যে গুদামজাত নিষিদ্ধ। যেমন: ওমর রা. বলেন, আমাদের বাজারে কেউ মজুদদারী করবে না। (মুওয়াত্তা ইমাম মালিক রহ., হা-২৩৯৮)। আলী রা. বলেন, যে ব্যক্তি চল্লিশ দিন খাদ্য মজুদ করে রাখবে, তার অন্তর কঠোর হয়ে যাবে।
গত কিছুমাস আগের কথা। পণ্যের দাম হুট করে বেড়েছিল। বিশেষ করে পিঁয়াজের দাম খুব বেড়েছিল। ৩০/৪০ টাকা কেজির পিঁয়াজ ১৫০ থেকে ২০০ টাকাতেও বিক্রি হয়েছে। এমনকি অনেক জায়গায় এই পিঁয়াজের দাম ৩০০ টাকাতেও গিয়ে ঠেকেছিল। বর্তমান সময়ে তেলের দামও হুঁ হুঁ করে বাড়ছে। যে তেল ১২০-১২৫ টাকা দিয়ে বাজার থেকে কেনা যেত তা হালের বাজার ২২০-২৫০ পর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছে। যা আমাদের মতো নিম্নমাধ্যমিক ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর জন্য একধরনের মুগুর পিঠার মতো হয়ে যাচ্ছে। লজ্জা-শরম ধুয়েমুছে দেখা যায় পরিবারের হর্তাকর্তারা সিরিয়াল দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে কিছু কম মূল্যে টি এস সি কর্তৃক বিক্রি তেল সংগ্রহ করছেন। কিন্তু কেন? তারা কী বাজার থেকে কেনার সামর্থ্য রাখেন না? এর জবাব হল, রাখেন, কিন্তু পণ্যের মূল্য হুঁ হুঁ করে বাড়লেও তো তাদের বেতনের চাকা ঘুরছে না। তাদের আগের বেতন দিয়েই চালাতে হচ্ছে সংসার।
আমাদের দেশের ঋতুগুলোকে সাধারণত দু’ভাগে ভাগ করা যায়। ১. বর্ষা ২. শুকনো। এই শুকনো মৌসুমেই আমাদের দেশের কৃষকরা নানান ধরনের পণ্য উৎপাদন করে বাজারজাত করেন। সে সময় কৃষকদের কাছ থেকে কিছু অসাধু ব্যবসায়ীরা ও-ই পণ্য নিম্ন দামে খরিদ করে গুদামজাত করে রাখে। পরবর্তীতে পণ্য উৎপাদনের অমৌসূমী সময় অর্থাৎ বর্ষায় যখন বাজারে মানুষের চাহিদানুযায়ী সে সমস্ত পণ্যের অভাব দেখা দেয় ঠিক তখনই তারা চড়া দামে পণ্য বাজারে ছাড়ে।
এ সময় যাতে পণ্যের দাম না বাড়তে পারে, সেজন্য সরকার অতিরিক্ত নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করে বাজারে পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে চায়। এমনকি সরকারি ভাবে পণ্যের একটা নির্ধারিত মূল্যও নির্ধারণ করে দেয়। অথচ ইসলামের দৃষ্টিতে সরকারিভাবে মালের মূল্য নির্ধারণ করারও প্রয়োজন নেই। বরং পণ্যকে তার স্বাভাবিক গতিতেই চলতে দেওয়া উচিত। আনাস রা. বলেন, রাসূল সা.-এর যুগে একবার জিনিসপত্রের দাম অনেক বেড়ে গিয়েছিল। তখন সাহাবায়ে কেরাম বললেন: হে আল্লাহর রাসূল সা.! আপনি পণ্যের একটা মূল্য নির্ধারণ করে দেন। তখন তিনি বললেন, নিশ্চয় আল্লাহ মূল্য নির্ধারণকারী। তিনি সংকুচিত করেন আবার প্রশস্তও করেন। তিনিই রিযিক দান করেন।’ [সুনানে তিরমিযি, হাদিস: ১৩১৪]
যে সব অবস্থায় মাল গুদামজাত করা নিষেধ : ১. স্বল্পমূল্য চলাকালীন খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করে বেশি লাভের আশায় এমনভাবে গুদামজাত করা যে, বাজারে তার প্রতিক্রিয়া পড়ে। ২. কোনো দ্রব্য এমন পরিমাণে গুদামজাত করা, যে কারণে ক্রেতা সাধারণত সে পণ্যের চরম সংকটের সম্মুখীন হয়। ৩. মানুষের খাদ্যদ্রব্য সংকট অবস্থায় যে কোনো পরিমাণ খাদ্যদ্রব্য গুদামজাত করা। ৪. বাজারে কৃত্রিম খাদ্য সংকট সৃষ্টির জন্য গুদামজাত করা। উল্লেখিত অবস্থায় মাল গুদামজাত করা নিষিদ্ধ ও গুনাহের কাজ। এখন প্রশ্ন হলো এই সিন্ডিকেটের দ্বারা মূলত লাভবান হয় কে? এর উত্তর নির্দ্বিধায় বলে দেয়া যাবে যে, এর দ্বারা মূলত উপকৃত হয় পাইকারি, মধ্যস্থতাকারী ও খুচরা ব্যবসায়ীরা। আর আর্থিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় আমাদের মতো সাধারন ক্রেতারা।
বেশ ক'বছর থেকে পরিলক্ষিত হচ্ছে যে, কৃষক তার সোনালী ফসল ধানের দাম ঠিক মতো পাচ্ছেন না। অপরদিকে সে সব কৃষকরা-ই যখন চাল কিনতে হাটে-বাজারে যান তখন চালের দাম শুনে তাদের মাথা চক্কর দিয়ে মাটিতে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। এখানেও একটা প্রশ্ন থেকে যায় যে, কেন তারা ধানের ন্যায্য মূল্য না পাওয়া সত্ত্বেও ধান বিক্রি করতে হচ্ছে, আবার চড়া দামে চাল কিনছে? এর উত্তর একজন কৃষকের বক্তব্য দ্বারাই দিচ্ছি– আমরা গরীব মানুষ ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে ক্ষেতে ধান চাষ করি। ধান ফলিয়ে তা বিক্রি করে ব্যাংকের লোন পরিশোধ করে যা লাভ হবে তা দিয়ে পরিবার-পরিজনদের নিয়ে বাকি একবছর বা পরের ধান মৌসুম পর্যন্ত চালিয়ে যাবো। কিন্তু আমরা ধানের ন্যায্য মূল্য পাই না। তারপরও বাধ্য হয়ে বিক্রি করে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করি। নয়ত সুদের গ্লানি টানতে টানতেই বাকি জীবন পার করতে হবে'।
আসলে যারা কৃষকদের কাছ থেকে ধান কিনে, তারা প্রতি বছর ধানের মূল্য নিয়ে এক প্রকার সিন্ডিকেট করে। সারাদেশে তারা নিজেরা একটা দাম ঠিক করে দেয় যে, সেই দাম থেকে বেশি দামে কেউ কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনবে না। যার ফলে কৃষকরা বাধ্য হয়ে লস হওয়া সত্ত্বেও কম দামে ধান বিক্রি করে। আর একারণেই কৃষকরা ধান বিক্রি করে লোকসানে পড়ছে বারংবার। এই সিন্ডিকেট যে শুধু ব্যবসার ক্ষেত্রে হয় তা কিন্তু নয়, বরং অন্যান্য ক্ষেত্রেও হয়ে থাকে। যেমন, গাড়ির টিকিটের বিষয়টাই বলি। টিকিট থাকা সত্ত্বেও টিকিট নেই এরকম অজুহাত দেখিয়ে গাড়ির মালিকরা যাত্রীদের কাছ থেকে বাড়তি টাকা নেওয়ার জন্যও কিন্তু সিন্ডিকেট করে। বর্তমানে এটা এক ধরনের মহামারি আকার ধারণ করেছে।
মাসআলা : মজুদদারের প্রকারভেদ : মজুদদার দুই প্রকার। প্রথম প্রকার: যে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতীক্ষায় থাকে না। বরং বাজারে পণ্যের মূল্য সস্তা ও পণ্যদ্রব্য পর্যাপ্ত দেখে নিজের জন্য তা কিনে জমা করে রাখে। যেমনটা বর্নিত আছে : মামার ইবনু আবদুল্লাহ ইবনু নাযলাহ্ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল সা.-কে বলতে শুনেছি, শুধুমাত্র দুর্নীতিপরায়ণ মানুষই মজুতদারি করে থাকে। আমি (মুহাম্মাদ ইবনু ইবরাহীম) সাঈদকে বললাম, হে মুহাম্মাদের পিতা! আপনিও তো মজুতদারি করে থাকেন। তিনি বললেন, মজুতদারি তো মামারও করতেন। (তিরমিজি : ১২৬৭)।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন