আসলে যারা কৃষকদের কাছ থেকে ধান কিনে, তারা প্রতি বছর ধানের মূল্য নিয়ে এক প্রকার সিন্ডিকেট করে। সারাদেশে তারা নিজেরা একটা দাম ঠিক করে দেয় যে, সেই দাম থেকে বেশি দামে কেউ কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনবে না। যার ফলে কৃষকরা বাধ্য হয়ে লস হওয়া সত্ত্বেও কম দামে ধান বিক্রি করে। আর একারণেই কৃষকরা ধান বিক্রি করে লোকসানে পড়ছে বারংবার। এই সিন্ডিকেট যে শুধু ব্যবসার ক্ষেত্রে হয় তা কিন্তু নয়, বরং অন্যান্য ক্ষেত্রেও হয়ে থাকে। যেমন, গাড়ির টিকিটের বিষয়টাই বলি। টিকিট থাকা সত্ত্বেও টিকিট নেই এরকম অজুহাত দেখিয়ে গাড়ির মালিকরা যাত্রীদের কাছ থেকে বাড়তি টাকা নেওয়ার জন্যও কিন্তু সিন্ডিকেট করে। বর্তমানে এটা এক ধরনের মহামারি আকার ধারণ করেছে।
মাসআলা : মজুদদারের প্রকারভেদ : মজুদদার দুই প্রকার। প্রথম প্রকার: যে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতীক্ষায় থাকে না। বরং বাজারে পণ্যের মূল্য সস্তা ও পণ্যদ্রব্য পর্যাপ্ত দেখে নিজের জন্য তা কিনে জমা করে রাখে। যেমনটা বর্নিত আছে : মামার ইবনু আবদুল্লাহ ইবনু নাযলাহ্ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল সা.-কে বলতে শুনেছি, শুধুমাত্র দুর্নীতিপরায়ণ মানুষই মজুতদারি করে থাকে। আমি (মুহাম্মাদ ইবনু ইবরাহীম) সাঈদকে বললাম, হে মুহাম্মাদের পিতা! আপনিও তো মজুতদারি করে থাকেন। তিনি বললেন, মজুতদারি তো মামারও করতেন। (তিরমিজি : ১২৬৭)।
ইমাম তিরমিজি রহ. বলেন, সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যিব প্রসঙ্গে বর্ণিত আছে যে, তিনি তেল, গম ও এই জাতীয় জিনিস নিজের পরিবারের জন্য মজুদ করতেন। সুতরাং উক্ত হাদিস মোতাবিক আলিমগণ অন্যকে কষ্ট না দিয়ে নিজের জন্য পণ্য মজুদদারি করার পক্ষে অনুমতি দিয়েছেন। ইবনুল মুবারাক বলেছেন, তুলা, ছাগলের চামড়া বা ঐ ধরণের অন্য কিছুর মজুদদারি করাতে কোন সমস্যা নেই।
মজুদদারি করা জায়েয কখন হবে: ১. অন্যকে কষ্ট দেয়া উদ্দেশ্য না হলে। ২. নিজের পরিবারের জন্য প্রয়োজন মোয়াফিক পণ্য সংগ্রহ করে রাখলে। ৩. খাদ্যদ্রব্য ছাড়া অন্যান্য জিনিস সংরক্ষণ করে রাখলে। ৪. প্রত্যেক মানুষের জন্য তার বাড়ীতে এক বছরের প্রয়োজনীয় জিনিস জমা করে রাখাও জায়েয’।
দ্বিতীয় প্রকার: দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতীক্ষায় যে জিনিসপত্র মজুদ করে রাখে এবং মানুষের প্রয়োজন যখন তীব্র হয় তখন সে মূল্য নিয়ন্ত্রণ করে উচ্চমূল্যে পণ্য বিক্রি করে। এই দ্বিতীয় প্রকার ব্যক্তিই প্রকৃত মজুদদার। হাদিসে এরূপ মজুদদারকেই পাপী বা অপরাধী বলা হয়েছে।
মজুদদারির বিধান : মজুদদারির বিধান সম্পর্কে ফকীহগণের মধ্যে দুই ধরনের মত রয়েছে। প্রথম মত: মজুদদারী হারাম। মালেকী, শাফেঈ, হাম্বলী সহ অধিকাংশ ফকীহর মত এটি। এঁরা কুরআন, সুন্নাহ, আসার ও যুক্তি দ্বারা দলীল পেশ করেছেন। দ্বিতীয় মত: মজুদদারী মাকরূহ। অধিকাংশ হানাফী ও কতিপয় শাফেঈদের মত এটি। তাদের দলীল হলো, ১. সনদ ও দলীলের দিক থেকে মজুদদারির বিষয়ে বর্ণিত হাদীসগুলির স্বল্পতা। যেগুলি দ্বারা শক্তিশালীভাবে হারাম সাব্যস্ত হয় না। অনুরূপভাবে এগুলি হারাম হওয়ার দলীলের উপযুক্তও নয়।
এর জবাবে বলা যায়, হানাফীদের মতে সাধারণভাবে মাকরূহ দ্বারা মাকরূহে তাহরীমী উদ্দেশ্য। তাদের মতে মাকরূহ কাজ হারাম। হারাম কাজ সম্পাদনকারীর ন্যায় মাকরূহ কাজ সম্পাদনকারীও শাস্তির যোগ্য। ২. মানুষ তাদের সম্পদের উপর কর্তৃত্বশীল। তাদের কর্তৃত্ব হারাম করা হলে তা তাদের জন্য প্রতিবন্ধক হবে। এর জবাবে বলা যায়, সাধারণভাবে সম্পদের মালিক তার মালিকানার ব্যাপারে স্বাধীন। যতক্ষণ না অন্যরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাছাড়া নিজের অধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে কারো স্বেচ্ছাচারিতা চলবে না। বরং তার অধিকার সামষ্টিক কল্যাণের সাথে শর্তযুক্ত থাকবে। (আল-ইহতিকার ওয়া আসারুহু ফিল ফিক্বহিল ইসলামী, পৃ. ১০৩-১০৬)
অগ্রাধিকারযোগ্য মত : অধিকাংশ ফকীহর মতামতই অগ্রাধিকারযোগ্য। অর্থাৎ মজুদদারী হারাম। সর্বোপরি জনসাধারণকে ভোগান্তিতে ফেলতে পণ্য গুদামজাত করা বা বিভিন্ন জিনিসে সিন্ডিকেট করা ইসলামে চরম ঘৃণিত কাজ। কেননা ব্যবসায়িদের স্বার্থের জন্য গরিব-দুঃখী ও অসহায় মানুষ কষ্টের মধ্যে পতিত হয়। আল্লাহর কাছে তাদের ফরিয়াদ বয়ে আনতে পারে সমাজ ও রাষ্ট্রের দুর্ভিক্ষসহ নানান কঠিন আযাব।
আল্লাহ তা'য়ালা ইরশাদ করেন, যে সব লোক বিনা দোষে মুমিন পুরুষ ও নারীকে কষ্ট দেয়। তারা অতি বড় একটা মিথ্যা অপবাদ ও সুষ্পষ্ট গুনাহের বোঝা নিজেদের মাথায় তুলে নেয়। (সুরা : আহজাব, আয়াত : ৫৮)। তাই সরকার বা প্রশাসনসহ সর্বসাধারণকে এবিষয়ের প্রতি লক্ষ রাখতে হবে। ইসলামকে বুঝতে হবে এবং তা মানার চেষ্টা করতে হবে। আল্লাহ তায়া’লা আমাদেরকে আমল করার তৌফিক দান করুক। আমীন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন