পৃথিবীর সকল জীব একে অন্যের উপর নির্ভরশীল। খাদ্য শৃঙ্খলের মাধ্যমে একে অন্যের উপর এই নির্ভরশীলতার অপর নাম বাস্তুতন্ত্র। মানুষ যেমন আলো বাতাস, পানি, ছাড়া বাঁচে না তেমনি পশু-পাখি তথা জীবজগতও আলো, বাতাস, পানি ছাড়া বাঁচে না। তরুরাজি-বৃক্ষলতার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এই পারস্পারিক নির্ভরশীলতা পৃথিবীকে করেছে সুন্দর, শোভন ও বাসযোগ্য। এর বিচ্যুতি হলেই পৃথিবীর জীবজগত ও প্রাণিকূল মহাসংকটে পতিত হবে। বিভিন্ন সভ্যতার মতো আধুনিক এ সভ্যতাও একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে না, তার নিশ্চতায় কোথায়?
পৃথিবীর আদিযুগে মানুষ যে পরিবেশে বসবাস করতো, সেখানে প্রাণিজগতের কেউ তার মিত্র ছিল না। সবাই শত্রু এবং তাদের কেউ কেউ অনেক ভয়ংকর ও প্রাণঘাতি ছিল। কেবল মাত্র পাখি তাদের ভয়ের কারণ ছিল না। বলা যায়, মানুষ প্রকৃতি থেকে দুটি বড় উপহার পেয়েছে, তার একটি হলো উদ্ভিদ আর অন্যটি হলো পাখি। পাখি উদ্ভিদ আর অরণ্যকে পরিপূর্ণতা দান করেছে আর মানুষ পাখি থেকে তার বাস্তব প্রয়োজন ও বিনোদন তৃষ্ণা মিটিয়েছে। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও পাখির মাধ্যমে তার মেধা ও কল্পনাকে বিকশিত করেছে। পাখি থেকে মানুষ উড়োজাহাজের চিন্তা ভাবনা করেছে। মানুষের জীবনের সাথে পাখিদের জীবন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।
আধুনিক পক্ষি বিজ্ঞানের হিসাবে বিশ্বে ১২০০ প্রজাতির পাখি আছে। এ পাখিরা এলো কীভাবে? আজ থেকে ৩০ লক্ষ বছর আগের সময়ের দানব সদৃশ ডাইনোসর পানি ও স্থল তোলপাড় করে বেড়াতো। এরা ছিল মেরুদন্ডী ও শীতল রক্তের প্রাণী। এই সরীসৃপ গোষ্ঠী তাদের দেহের গড়ন ও স্বভাবের জন্য শেষ পর্যন্ত জীবন সংগ্রামে টিকে থাকতে পারলো না। তবে তাদের একটি প্রজাতির সামনের হাতে চামড়ার পর্দা ছিল। তারা জীবন সংগ্রামে মাঝে মধ্যে হাতকে ডানার মত ব্যবহার করতো। এক সময় এরাই ডানার সাহায্যে উড়তে শুরু করলো। হয়ে গেলো ডানাওয়ালা ডাইনোসর। এদের হাত ধরে আরো কয়েক ধাপ পরে এসে পক্ষীত্ব প্রাপ্ত হলো তারা। জীববিজ্ঞানিরা প্রাচীন শিলা খুঁজে যে ফসীল সংগ্রহ করেছেন তা থেকে পাখিদের গোত্র, বংশ পরিচয় নির্ণয় করা সম্ভব হয়েছে। মূলত সরীসৃপ থেকে পাখির ক্রম বিবর্তন শুরু হয়। ডানাওয়ালা ডাইনোসরের মতো ডানা আজকের পাখিদের মূল বৈশিষ্ট্য। ডানার সাহায্যে পাখি যেন ভাসতে পারে তেমনি তার চলার গতিও পায়। ডানার গড়ন ও দৈর্ঘের সাথে পাখির উড়ার শক্তির সম্পর্ক আছে। আবার বিভিন্ন জাতের পাখিদের ডানার ধরনেও পার্থক্য থাকে। যেমন বেশিরভাগ গায়ক পাখির ডানা ছোট ও গোলাকার।
পাখি প্রকৃতির বিস্ময়কর সৃষ্টি। পৃথিবীর অন্যান্য প্রাণীর সাথে এর তফাৎ অনেকখানি। এমন কি শ্রেষ্ঠ জীব বলে স্বীকৃত মানুষও অনেক ক্ষেত্রে এর সমকক্ষ নয়। এটা সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর এক অপার রহস্য। আমাদের জলবায়ূ ও প্রাকৃতিক পরিমন্ডল পাখি বসবাসের পক্ষে অনুকূল। এতদঅঞ্চলে এক সময় প্রচুর পাখি দেখা যেত। এখানে ছিল অনেক প্রজাতির স্থানীয় পাখি। আবার শীতে আসতো অসংখ্য পরিযায়ী পাখি। আমাদের শৈশবে তথা ৫০ বৎসর আগে পরিযায়ী পাখির ডাকে চোখ তুলো দেখতাম পাখিদের উড়োওড়ি। এরা কখনো চক্রাকারে, কখনো বাঁকা চাঁদের মতো, কখনো এলোমেলো ভাবে উড়ে যেত। এদের কেউ কেউ উড়ার সময় শব্দ করতো। কখনো নিঃশব্দে উড়তো। এখন আর দেখি না তাদের। আমাদের কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতীরা পাখির প্রতি যতখানি কৌতূহলী হওয়া উচিত, ঠিক ততখানি হয়নি। আইপ্যাড, পিসি, ল্যাপটপ, মোবাইল তাদের যতখানি আকর্ষণ করে, ততখানি আকর্ষণ করে না পাখি, প্রকৃতি কিংবা বন্যপ্রাণী। পাখিদের দৈহিক রঙ বা বর্ণ বৈচিত্র্য ও কন্ঠস্বরের ভিন্নতা জেনেই মানুষেরা পাখি চেনে। পাখি কিভাবে উড়ে ভৌগলিক বা রাষ্ট্রীয় সীমারেখা তারা অনায়াসে অতিক্রম করতে পারে। তাদের প্রয়োজন হয় না পাসপোর্ট কিংবা ভিসার। তাদের পৃথিবী উন্মুক্ত, যে দেশে খুশি উড়ে যেতে পারে, অন্য প্রাণীদের পক্ষে তা অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব নয়। বিভিন্ন পরিবেশে বসবাস, কিংবা পরিযায়ী হওয়া,বাসা বানানো, সন্তান লালন-পালন, খাদ্য সংগ্রহ, নিজের পরিচর্যা করা, দেশান্তরি হওয়ার উদ্দেশ্য কি, তারা কি ধরনের রোগ জীবাণু বহন করেÑ এগুলো আজ পক্ষি বিজ্ঞানের বিষয়। এ নিয়ে পৃথিবীতে চলছে গবেষণা। পাখি মানুষের কি কাজে আসে বা উপকারে আসে, তা কেন ক্ষতি হয় কিনা এসব জানার জন্যই পক্ষি বিজ্ঞানের সাধনা। এগুলো জানতে পারলে রহস্যলোকের চাবি খুলে যাবে।
পাখি এখন যেমন প্রকৃতিতে আছে তেমনি আছে সৌখিন পাখি পালকদের খাঁচায়ও। যাকে বলা হয় ‘কেইজ বার্ড’। পৃথিবী জুড়ে এখন কেউজ বার্ডের রমরমা ব্যবসা। মুক্ত পুঁজির রাজ্যে পাখিও পণ্য হয়ে গেছে। পাখি খাঁচায় বন্দী করার প্রচেষ্টা সেই আদি যুগ থেকে। পাখিদের কয়েকটি ছাড়া অন্যরা পোষ মানেনি। কেউ কেউ গৃহপালিত হয়ে গেছে যেমন হাঁস, মুরগী, পায়রা ইত্যাদি। পাখিরা বনে সুন্দর খাঁচার ভেতর কখনো থাকে না অচিন পাখি। খাঁচার পাখির জীবন শৃঙ্খলিত। বনের পাখি মুক্ত। তাইতো পাখিকে বলা হয়ে থাকে মুক্ত বিহঙ্গ। আদিযুগের গুহা গাত্রে, বিভিন্ন ভবনে পাখিদের ছবি আঁকা আছে।
আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতিতে পাখির উপস্থিতি প্রতুল তেমনি বিশ্বসাহিত্যে পাওয়া পাখিদের নিয়ে অমর সাহিত্য গাঁথা। মানুষের বাঁচার জন্যই পাখির দরকার। প্রয়োজন প্রকৃতির সান্নিধ্যতা। হয়ত তাই কবি বলেছেন ‘ফিরিয়ে দাও সে অরণ্য, লও এ নগর’। এ হচ্ছে মানুষের আদিম আকুতি। এই কাক্সক্ষাকার মর্মকথা বোঝার লোক কই? আমরা কি বুঝি সে আর্তি? দেশ এখন ইট-পাথরের জঞ্জ¡ালে পরিপূর্ণ। বায়ূদূষণে, শব্দদূষণে উঠেছে মানুষের নাভিশ্বাস। সময় কোথায় আমাদের প্রকৃতি দেখার। কান পেতে শোনার-বাদলের ধারা। কিংবা পাখির কলকাকলী? নগরায়ণ ও শিল্প কারখানা স্থাপনের দোহাই দিয়ে আমরা অপরিকল্পিতভাবে পাহাড়, নদী, জলাশয়, কৃষিজমি গ্রাস করে চলছি। যেখানে মানুষের হাত লেগেছে সেখানেই বিপদগ্রস্ত হয়েছে প্রকৃতি, বনবনানী, জীব জগৎ, পশুপাখি তথা বন্য প্রাণী।
পাখি পর্যবেক্ষক ইনাম আল হক পৃথিবী থেকে পাখি বিপন্ন হওয়ার জন্য মানুষের সৌখিনতাকেই দায়ী করেছেন। মানুষের বাড়িঘর, রাস্তা, শিল্পকারখানা গড়তে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পাখির আবাসস্থল, যার পরিপ্রেক্ষিতে বিলুপ্ত হচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি। তিনি তার পর্যবেক্ষণের অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, দেশের দক্ষিণাঞ্চল তথা বৃহত্তর চট্টগ্রামে সবচেয়ে বেশি পাখির বসবাস। তারপরও এতদাঞ্চলের ৫০ টি প্রজাতির পাখি সংকটাপন্ন অবস্থায় আছে। দেশের মানুষ আদৌ বুঝতে পারে নি পাখির গুরুত্ব। যদি তারা বুঝতো প্রকৃতি, বনাঞ্চল, জলাশয় রক্ষা করতো নিজের স্বার্থেই। পাখি মানুষকে শুধু আনন্দ ও বিনোদন দেয় না, তারা আমাদের আর্থ ও সামাজিক কাজে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে। পাখিদের দ্বারা সৃজিত হয় বনায়ন, পাখিদের কিছু প্রজাতি ইঁদুর, সাপ, পোকামাকড় খেয়ে খাদ্য উৎপাদনে সহায়তা করে। গৃহপালিত পাখি থেকে আমরা আমিষ পেয়ে থাকি। পাখি পচাগলা মৃত খেয়ে পরিবেশকে নানাভাবে দূষণ মুক্ত রাখতে সাহায্য করে।
পৃথিবীতে এমন কিছু পচাগলা আছে যা শকুনেরা খেয়ে সাবাড় করে। ধরা যাক আনথ্রাক্সবাহিত মরা। অন্য যে কোন প্রাণী যারা মৃত পশু যা তারা খাওয়ার পর বিষ্ঠা বা মলের মাধ্য ঐ রোগের জীবাণু ছড়িয়ে যায়। কিন্তু যদি শকুন তা খায় তবে তার মল থেকে তা আর রোগ ছড়াবে না। শকুনের পেটে এমন এনজাইম আছে, যা বিশেষ বিশেষ রোগ জীবাণু খেয়ে ধ্বংস করতে সক্ষম। এক সময় আমাদের চারপাশে প্রচুর শকুন দেখা যেত। এখন দেখা যায় না। বিগত ত্রিশবছর আগে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার তথা বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, মিয়ানমার ও ভিয়েতনামে প্রায় চার কোটি শকুন বসবাস করতো। এখন তা কমতে কমতে দুই লাখে এসে ঠেকেছে। বাংলাদেশে আছে মাত্র দুইশতটি। ডাইক্লোয়েনাক নামে গবাদি পশুর একটি ওষুধ শকুন মৃত্যুর অন্যতম কারণ বলে পশু বিজ্ঞানিরা জানাচ্ছেন। পাখি নাবিকের উদ্ধারকারী হিসাবে বিবেচিত, সিগাল তাদের অন্যতম। সমুদ্রে বা নদীতে জাহাজের আগে আগে তারা উড়ে পথ দেখায়। পনের ও ষোল শতকে নাবিকেরা জাহাজে করে কাক বা অন্য প্রজাতির পাখি বয়ে বেড়াতো। তারা যখন পথের বা উপকূলে দিশা হারিয়ে ফেলত, তখন পাখিদের আকাশে উড়িয়ে দিত। পাখি তখন উড়ে স্থলভাগের দিকে ছুটে যেত আর নাবিকেরা তার অনুসরণে এগিয়ে যেত উপকূলের ঠিকানায়।
পাখিদের মধ্যে যারা সিলেট অঞ্চলে বসবাস করছে তাদের পঞ্চাশটি আজ অস্তিত্বের সংকটে। এরা যদি হারিয়ে যায়, তাহলে শুধু বাংলাদেশ নয় বিশ্বের মাত্রচিত্র থেকেও হারিয়ে যাবে। বিশ্বে বিপন্ন কিন্তু বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে এখনো টিকে আছে সেসব প্রাণী তাদের মধ্যে বনমোরগ, রাজধন, বড়ময়না, হরিয়াল, হুতোম পেঁচা, কাদাখোচা ধূতিয়াল, রাজহাঁস, পান চিরা ইত্যাদি। প্রকৃতির এই অমূল্য সম্পদ পাখির উপকারিতা অশেষ। সেটা এখন আমাদের উপলব্ধিতে না এলেও যখন পাখি শূন্য হয়ে যাবে তখন আমরা টের পাবো।
পাখিহীন বিশ্ব তখন আমাদের কাছে কেমন লাগবে; আমরা একবারও কল্পনা করেছি? বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় গত কয়েক দশক বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। আধুনিক সুযোগ সুবিধার কারণে গ্রাম আর গ্রাম নেই। শহরের সকল সুবিধা এখন গ্রামে বিদ্যমান। কিন্তু তার নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হিসাবে আমরা প্রকৃতির কি যে ক্ষতি করে চলেছি তা অনুভব করতে পারছি না? ইতোমধ্যে আমাদের অনেক চেনা পশু পাখি হারিয়ে গেছে। আমরা আমাদের প্রকৃতিকে উন্নয়নের নামে নিজেরাই ধ্বংস করে চলছি। এই বিধ্বংসী কার্যকলাপ কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না। প্রকৃতি, পশু, পাখি আমাদের বন্ধু এদের রক্ষা করতেই হবে।
পাখি পর্যবেক্ষণ এখন আনন্দময় ও আকর্ষণীয় শখ হিসাবে বিবেচিত। এতে করে পাখির যত বৈচিত্রতা, মনোহরি গঠন, পালকের সৌন্দর্য, কণ্ঠস্বরের বিভিন্নতা ও মাধুর্যতা সর্বোপরি স্বভাবের নিজস্বতার কারণে পাখি সন্বন্ধে কত অনুসন্ধিৎসা, কতবেশি তা তাদের পাখি বিষয়ক পত্র-পত্রিকা, বই প্রকাশনা থেকে অনুমান করা যায়। পাখি বিষয়ে অন্তত একখানা বই আছে এমন পরিবারের সংখ্যা ইংল্যান্ডে এক লক্ষ এবং আমেরিকায় আড়াই লক্ষ। ইংল্যান্ডে প্রতি সপ্তাহে পাখি বিষয়ক একটি করে বই বা সাময়িকি প্রকাশিত হয়। সুসংবাদ এই যে, আমাদের দেশে পাখি পর্যবেক্ষকদের সৌখিন দলে কিছু মানুষ একত্রিত হচ্ছে পাখি ও প্রকৃতিপ্রেমীরা বিভিন্ন স্থানে নানা নামে বার্ড ক্লাবও প্রতিষ্ঠিত করেছে। এভাবে যদি দেশে পাখি পর্যবেক্ষণের দল বাড়ে, তাতে করে পাখি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের আগ্রহ বাড়বে। পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হবে। মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে। আমাদের নতুন প্রজন্মের মধ্যে গড়ে উঠবে সহমর্মিতা ও আগ্রহ এবং প্রকৃতি বাঁচানোর তাগিদ। প্রকৃতির কাছাকাছি যত মানুষ যাবে ততবেশি করে চিনবে প্রকৃতির অমূল্য সম্পদ পাখিকে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। সদস্য, বন ও পরিবেশ কমিটি, সিলেট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন