মূল্যস্ফীতিতে দেশের মানুষের এখন নাভিশ্বাস অবস্থা। করোনাভাইরাসের কারণে দুই বছর ধরে সারা দুনিয়ার মানুষ ছিল কার্যত অবরুদ্ধ। উৎপাদনব্যবস্থা ছিল স্তব্ধ। সে সংকট কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা যখন চলছে তখন রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ দুনিয়াবাসীর জন্য ডেকে এনেছে অশেষ ভোগান্তি। জ্বালানি, ভোজ্যতেল ও গমের দাম বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। বেড়েছে অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের দাম। সরকারের এক যুগের সব সাফল্য গিলে খাওয়ার চেষ্টা করছে মূল্যস্ফীতির আপদ। করোনাভাইরাস ও রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের কুফল হিসেবে দুনিয়াজুড়ে খাদ্যাভাব দেখা দিতে পারে, এমন আশঙ্কা জাতিসংঘ মহাসচিবের। ব্রিটেনের মতো শক্তিশালী অর্থনীতিতেও মূল্যস্ফীতি ভয়াবহ থাবা বিস্তার করেছে। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে অগ্রসর দেশ শ্রীলঙ্কার মানুষ দুর্ভিক্ষের ভয়ে সময় কাটাচ্ছে। পাকিস্তানে ডলারের দাম ২০০ রুপি ছাড়িয়েছে। রাশিয়ার মূল্যস্ফীতিও ১৮ শতাংশের কাছাকাছি। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার পূর্বাভাস, এ বছর খাদ্যমূল্য ২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ায় আমদানিনির্ভর পণ্যগুলোর মূল্য সমহারে বেড়েছে দেশের বাজারে। ফলে সরকারের হিসাবে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের ধারেকাছে থাকলেও বাস্তবে সাধারণ মানুষের ওপর প্রভাব পড়েছে এর কয়েক গুণ বেশি। মূল্যস্ফীতি যেহেতু এখন এক নম্বর সমস্যা; সেহেতু তা নিয়ন্ত্রণে সরকারকে প্রবৃদ্ধি অর্জনের চেয়েও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ, চাল-ডাল-তেলের দাম বাড়লে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাদের দুর্ভোগ বাড়ে। এ সমস্যার সমাধান করা না গেলে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। মূল্যস্ফীতি রোধে অর্থনীতির লাগাম শক্ত হাতে টেনে ধরতে হবে। নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি রোধকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে হবে। এর কোনো বিকল্পই নেই।
সাধারণভাবে দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি বা হ্রাস পাওয়ার বিষয়টি নির্ভর করে বাজারে পণ্যের চাহিদা ও সরবরাহের ওপর। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকলে পণ্যের দাম বাড়তেই পারে। কিন্তু আমাদের দেশে এ নিয়ম খাটছে না। দেখা যায়, পণ্যের পর্যাপ্ত আমদানি ও সরবরাহ থাকলেও তা বেশি দামে বিক্রি হয়। দ্রব্যমূল্যের এই অযৌক্তিক বৃদ্ধির পেছনে কাজ করে বাজার সিন্ডিকেট বা চক্র। তারা যোগসাজশের মাধ্যমে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। কখনো কখনো তারা পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে। নানা অজুহাত তুলেও বাড়ানো হয় পণ্যের দাম। এ অবস্থায় বেশি দামে পণ্য ক্রয় করা ছাড়া ভোক্তাদের কোনো উপায় থাকে না।
এভাবে দ্রব্যমূল্য, বিশেষত নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি করা অপরাধ বটে। এজন্য সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের শাস্তি হওয়া উচিত; কিন্তু আমাদের দেশে এ ধরনের ঘটনা বিরল। ফলে কারসাজি করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিষয়টি যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। অসাধু ব্যবসায়ীদের এ প্রবণতা প্রতিরোধ করার দায়িত্ব সরকারের।
স্থানীয় বাজারে অনেক পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় বেশি। এর অর্থ হলো, ব্যবসায়ীরা আন্তর্জাতিক বাজারে বেশি দামের অজুহাতে মানুষের কাছ থেকে বেশি টাকা আদায় করছেন। সরকারের উচিত অবিলম্বে এই বিষয়ে নজর দেওয়া এবং যেসব ব্যবসায়ী সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি অর্থ আদায় করে ভোক্তাদের শোষণের চেষ্টা করছেন তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করা। পাশাপাশি, মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য ক্রমাগত কমে যাওয়া রোধ করা উচিত। কেননা, এতে করে বিভিন্ন পণ্যের আমদানি খরচ বেড়ে যাচ্ছে।
প্রধান প্রধান নিত্যপণ্যের জন্য বিদেশের বাজারের ওপর নির্ভরশীল থাকায় বাংলাদেশ সব সময় আমদানি-প্ররোচিত মূল্যস্ফীতির ঝুঁকিতে থাকে। ফলে এই দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসার জন্য বাংলাদেশের একমাত্র উপায় হচ্ছে কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের জন্য নিজস্ব সরবরাহ শৃঙ্খল তৈরি করা। প্রকৃতপক্ষে, এটি আগেই করা উচিত ছিল। নিদেনপক্ষে করার চেষ্টা করা উচিত ছিল।
যাই হোক, দাম কমিয়ে আনার জন্য তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা হিসেবে সরকারের কিছু নিত্যপয়োজনীয় পণ্য খোলা বাজারে বিক্রি করা উচিত। পাশাপাশি, দামের চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে, এমন লোকজনকে সরকারি সহায়তা হিসেবে নিজস্ব স্টক থেকে কিছু নিত্যপণ্য সরবরাহ করা উচিত বা ভর্তুকি দেওয়া উচিত এবং খুচরা বাজারে সরকারের মূল্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এসব পণ্য বিক্রির ব্যাপারে জরুরি ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
করোনা-দুর্যোগ শুরুর পর থেকে অনেকের আয়-রোজগার কমে গেছে, অনেকেই হয়েছেন কর্মহীন। তার উপর এখন মূল্যস্ফীতির কষাঘাত মানুষ নিতে পারছে না। বাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকার নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে। ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে যাতে বাজারকে অস্থিতিশীল করতে না পারে সেদিকে লক্ষ রাখার কথা জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করছেন কর্মকর্তারা। অবশ্য এসব তৎপরতায় তেমন কোনো সাফল্য আমরা দেখি না। চাল আমাদের প্রধান খাদ্যপণ্য। অথচ, এই চাল নিয়ে প্রায় ধারাবাহিকভাবে চলছে চালবাজি। চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে ইতোমধ্যে সরকার অনেকবার চাল আমদানি করেছে। আমদানি শুল্কও কমিয়েছে। কিন্তু ভোক্তারা, এর যথাযথ সুফল কখনই কাক্সিক্ষত মাত্রায় পাননি। তবে বাজার নিয়ন্ত্রণে টিসিবির মাধ্যমে খোলাবাজারে পণ্য বিপণন, বাজার মনিটরিং ইত্যাদি যেসব পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে, এগুলো যেন যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। পণ্য পরিবহন নির্বিঘ্ন রাখতে, বিশেষ করে, কৃষিপণ্যের সরবরাহে যাতে কোনো বাধার সৃষ্টি হতে না পারে, সেদিকে নজর রাখতে হবে সংশ্লিষ্টদের। এর বাইরে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসন থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে বাজার পরিস্থিতি তদারকি অব্যাহত রাখতে হবে। আমরা এও মনে করি, কেন্দ্র থেকে স্থানীয় উৎপাদন ক্ষেত্র পর্যন্ত ব্যবস্থাপনাও নজরদারির আওতায় আনা জরুরি। একই সঙ্গে আমদানিকৃত ও দেশজ উৎপাদিতÑ এই দুই ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন ও নির্বিঘ্ন রাখার ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক: কো-চেয়ারম্যান, জাতীয় পার্টি
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন