শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

সেই দুই অস্ত্রধারীর জামিন লাভ

| প্রকাশের সময় : ২৪ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

গত ২৭ অক্টোবর গুলিস্তানে ডিএসসিসি’র হকার উচ্ছেদ অভিযানের সময় প্রকাশ্য আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলার ঘটনার ছবি প্রায় সব গণমাধ্যমেই প্রকাশিত হয়। সেই ঘটনায় চিহ্নিত দুই ছাত্রলীগ নেতার সংগঠন থেকে বহিষ্কারের খবরও ছাপা হয়েছে এবং ঘটনার পর পর পুলিশ ও হকারদের পক্ষ থেকে দু’টি পৃথক মামলাও হয়েছে। তিন সপ্তাহ ধরে অস্ত্রধারীদের পুলিশ খুঁজে পাচ্ছেনা বলেও খবর প্রকাশিত হয়েছে। এরই মধ্যে গতকাল প্রথম জানা গেল, প্রকাশ্য অবৈধ অস্ত্রধারী ও জনসমক্ষে ত্রাস সৃষ্টিকারী দুই ছাত্রলীগ নেতা সিএমএম আদালত থেকে জামিন পেয়েছে। গত বৃহস্পতিবার এই জামিন লাভের ঘটনা ঘটলেও পুলিশসহ সংশ্লিষ্টরা অন্তত ৫ দিন তা গোপন রেখেছিল। ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের গুরুত্বপূর্ণ পদ এবং সন্ত্রাস-চাঁদাবাজিতে লিপ্ত থাকায় তাদের এমনিতেই পুলিশের কাছে পরিচিত মুখ হওয়ার কথা। ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে প্রকাশ্য অস্ত্র নিয়ে হামলার সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর এরা নিশ্চয়ই সারাদেশেও পরিচিতি পেয়েছে। এমন মোস্ট ওয়ানটেড আসামীরা কি করে জনবহুল আদালত পাড়ায় পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে জামিন নিয়ে নিরাপদে ফিরে যেতে পারল তা’ জনমনে বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে। যেখানে বিরোধীদলের হাজার হাজার কর্মীকে রাজনৈতিক মামলায় হয়রানি করা হচ্ছে, একের পর এক মামলা দিয়ে জামিন ঠেকিয়ে দেয়া হচ্ছে, অথবা জামিন পাওয়ার পরও ভিন্ন কোন মামলায় শ্যোন অ্যারেস্ট দেখিয়ে বছরের পর বছর ধরে আটক রাখা হচ্ছেÑ সেখানে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে প্রকাশ্য গোলাগুলি ও ত্রাস সৃষ্টিকারী ছাত্রলীগ নেতাদের দীর্ঘদিনেও আটক না করা এবং তাদের জামিন নেয়ার সুযোগ পাওয়া দেশবাসীর কাছে ভিন্ন বার্তা দিচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের সিনিয়র মন্ত্রীরা প্রায়শ সন্ত্রাসের প্রতি জিরো টলারেন্স নীতির কথা বলেন। সেই সাথে সরকারী দলের অংগ সংগঠনের নানা ধরনের সন্ত্রাস ও অপরাধমূলক কর্মকা-ের প্রতিক্রিয়ায় ‘সন্ত্রাসীর কোন দল নেই’ বলে উল্লেখ করেন, এই সঙ্গে অপরাধী দুর্ধর্ষ দলীয় ক্যাডারদের দল থেকে বহিষ্কারও করা হয়। তবে দল থেকে বহিষ্কারের পরও সন্ত্রাসী অস্ত্রধারীদের শাস্তি না হওয়া এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখকে ফাঁকি দিয়ে আদালত থেকে জামিন নেয়ার ঘটনাকে সহজভাবে মেনে নেয়া যায়না। পল্টন থানার ওসি’র বরাত দিয়ে প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, বহিষ্কৃত ছাত্রলীগ নেতা সাব্বির ও আশিকুরের কোন অস্ত্রের লাইসেন্স নেই। অতএব, সহজেই অনুমিত হয়, ২৭ অক্টোবর গুলিস্তানে ত্রাস সৃষ্টি করতে যে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হয় তা তার সবই অবৈধ। প্রকাশ্য গোলাগুলি করার পর দীর্ঘদিন পুলিশের ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা এবং সিএমএম কোর্ট থেকে জামিন লাভের পর জানা গেছে তাদের বিরুদ্ধে কোন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই এবং পুলিশের মামলাও হয়েছিল জামিনযোগ্য ধারায়। বহুল আলোচিত মামলার প্রধান দুই আসামীর জামিন পাওয়া নিশ্চিত করতে পুলিশ সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে বলে প্রতীয়মান হয়। জামিনযোগ্য মামলা দিয়ে গোপনে জামিন নিশ্চিত করা হলেও অবৈধ অস্ত্রগুলো কোথায় গেল, সে সব কি উদ্ধার বা জব্দ করা হয়েছে? তাছাড়া তাদের হাতে আরো অস্ত্র আছে কিনা সে কথাই বা কে বলবে। দেশ যখন অবৈধ অস্ত্রধারীদের অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে, ছাত্রলীগ-যুবলীগের পদাধিকারীরা সারাদেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে সরকারের উন্নয়নের সব অর্জনকে মøান করে দিচ্ছে, তখন সন্ত্রাসের দায়ে বহিষ্কৃৃত ছাত্রলীগ নেতারা আইনের ফাঁক-ফোকর ও পুলিশের ব্যর্থতায় ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকার এমন জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত সমাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এ ধরনের ঘটনা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি সাধারণ মানুষের অনাস্থা আরো বাড়িয়ে দেবে।
যুব সমাজের একটি অংশের বখাটেপনা ও সন্ত্রাসী কর্মকা-ে গোটা সমাজে নিরাপত্তাহীনতা প্রকট হয়ে উঠেছে। মূলত, সরকারের দলীয় লোকদের অপরাধমূলক কর্মকা-ের সাথে একশ্রেণীর পুলিশ কর্মকর্তার যোগসাজশ সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে নিরাপত্তাহীন করে তুলেছে। সমাজ বিজ্ঞানী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা এ অবস্থাকে বিচারহীনতার সংস্কৃতি বলে আখ্যায়িত করছেন। অপরাধীরা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রভাবশালীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় পেলে তারা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠবে, এটাই বাস্তব। অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার ও প্রকাশ্য চাঁদাবাজির মাধ্যমে রাতারাতি কোটিপতি বনে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে ছাত্রলীগ-যুবলীগের একশ্রেণীর নেতাকর্মী দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রতিটি জনপদে প্রতিনিয়ত ন্যক্কারজনক ঘটনার জন্ম দিচ্ছে। সিলেটে খাদিজা আক্তারের উপর ছাত্রলীগ নেতা বদরুলের নৃশংস হামলার ঘটনা থেকে সাম্প্রতিক ঝিনাইদহের কালিগঞ্জে শাহানুর বিশ্বাসকে পিটিয়ে জখম করে পঙ্গু করে দেয়ার মত অসংখ্য ঘটনার সাথে ছাত্রলীগ-যুবলীগ কর্মীরা জড়িত। তাদেরকে সারাদেশ ধিক্কার দেয়, প্রতিবাদের ঝড় ওঠে অথচ পুলিশ এদেরকে খুঁজে পায়না। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের বিরুদ্ধে কেউ মামলা দিতে সাহস পায়না। মামলার বাদীদের জীবন সংশয় দেখা দেয়। বহু অপরাধের পরও আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে, পুলিশের সহায়তায় তারা জামিনে বেরিয়ে এসে আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এ অবস্থা উত্তরণের কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছেনা। সারাদেশে লাখ লাখ অবৈধ অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী শুধুমাত্র তথাকথিত জঙ্গি দমন ও সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনেই ব্যস্ত থাকছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নিরপেক্ষ ও পেশাদার ভূমিকা, আইনের শাসন, সর্বোপরি সুশাসন ছাড়া বিচারহীনতার এই সংস্কৃতি থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া সম্ভব নয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন