ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত রোগ, যা মূলত মশার মাধ্যমেই বিস্তার লাভ করে। কীটতত্ত্ববিদরা এ পর্যন্ত বাংলাদেশে ১২৩ প্রজাতির মশা চিহ্নিত করেছেন, যার মধ্যে ঢাকায় আছে ১৪ প্রজাতির মশা। তবে সকল মশাই ডেঙ্গুর বাহক নয়। একমাত্র এডিস মশার মাধ্যমেই ডেঙ্গু বিস্তার লাভ করে। ডেঙ্গুর কারণে শরীরে তীব্র ব্যথার সৃষ্টি হয় বলে একে ‘ব্রেকবোন ফিভার’ বলেও অভিহিত করা হয়।
প্রতি বছরই দেশে ডেঙ্গুর কম-বেশি প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। বিশেষ করে, ঢাকা শহরে এর প্রাদুর্ভাবটা একটু বেশি লক্ষ করা যায়। বিগত কয়েক বছরে ঢাকাসহ সারাদেশে ডেঙ্গুর মারাত্মক রূপ ধারণ করতে দেখা গেছে। তবে ডেঙ্গুর প্রকোপ কম বেশি হওয়ার পিছনে এর ভেরিয়েন্টের একটি দায় আছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বিসিএসআইআর’র উদ্যোগে পরিচালিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডেঙ্গুর চারটি সেরোটাইপ রয়েছে। এগুলো হলো: ডেনভি-১, ডেনভি-২, ডেনভি-৩ ও ডেনভি-৪। দেশে ডেনভি-৩ শনাক্ত হয় ২০১৭ সালে। ২০১৮ সালে ডেনভি-৩ আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে শুরু করে এবং সবশেষে ২০১৯ সালে মহামারি আকার ধারণ করে এটি। ডেঙ্গুর প্রকোপ দেশে বড় আকারে দেখা দেয় ২০০০ সালে। ওই বছরে ৫ হাজার ৫৫১ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় আর মৃত্যুবরণ করে ৯৩ জন। কিন্তু তার চেয়েও কয়েক গুণ ভয়াবহ আকার দেখা দেয় ২০১৯ সালে। সরকারি হিসাবে ওই বছরে ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন আক্রান্ত হয় এবং মৃত্যুবরণ করে ১৭৯ জন, যদিও বেসরকারি হিসাবে মৃত্যুর সংখ্যা ছিলো প্রায় ৩০০ জন। ইতিহাসের সর্বাধিক আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ওই বছর। আর আক্রান্ত ও মৃত্যুর অধিকাংশই ঘটে ঢাকায়। সারাদেশে যত মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল, তার অর্ধেকই ছিলো ঢাকায় এবং এখানে মৃত্যুর হার ছিল মোট মৃত্যুর ৭৭ শতাংশ।
করোনাকালীন ২০২০ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা কিছুটা কম থাকলেও ২০২১ আবারও দেখা দেয় ডেঙ্গুর প্রকোপ। ওই বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা ছিলো ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঘটনা। ২৮ হাজার ২৬৫ জন আক্রান্ত ও ১০৫ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ওই বছর। তবে এ বছর এখনও ডেঙ্গুর ভয়ংকর রূপ দেখা যায়নি সত্য, কিন্তু যদি বিগত বছরগুলোর ন্যায় মারাত্মকরূপ ধারণ করে তবে তা সামাল দেয়া যে কষ্টকর হবে, তা বলাই বাহুল্য। কারণ বিগত কয়েক বছর ডেঙ্গুতে বেসামাল অবস্থা তৈরি হলেও এখনো পর্যন্ত এডিস নির্মূলে সরকারের পক্ষ থেকে তেমন কোনো কার্যকর ও টেকসই উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য বলছে, এই মুহূর্তে বিশ্বের অর্ধেক মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। আর বছরে ৩০০ থেকে ৪০০ মিলিয়ন মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। ব্যাপারটি উদ্বেগজনক তো বটেই, বাংলাদেশের জন্য আরো বেশি। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, রক্তক্ষরা ডেঙ্গুর উৎপত্তির মূলে আছে নজিরবিহীন জনসংখ্যা বৃদ্ধি, ভ্রমণ বৃদ্ধি, মশক দমনের অভাব এবং জনস্বাস্থ্য কাঠামোর অবনতি। তাছাড়া অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ভালো কোনো পদ্ধতি না থাকা, অপরিচ্ছন্নতাও এডিস মশা বৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম কারণ। আবার জলবায়ু পরিবর্তনও বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়াচ্ছে বলে বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে। সংস্থাটি বলেছে, এক ঋতুর সঙ্গে আরেক ঋতুর যে তফাৎ, বাংলাদেশে তা মুছে যাচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কায়। ফলে ধীরে ধীরে লোপ পাচ্ছে ঋতুভেদে আবহাওয়ার বৈচিত্র্য। প্রতি বছর গ্রীষ্মের সময়টা একটু একটু করে বেড়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে বর্ষাকালের পরিধি। সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে গড় বৃষ্টিপাত বেড়ে যাওয়ায় দীর্ঘ হচ্ছে বর্ষাকাল। অথচ, যে সময়টায় সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হতো আগে, সেই জুন-আগস্ট মৌসুমে গড় বৃষ্টিপাত কমে যাচ্ছে। ২০১৯ সালে ডেঙ্গু যে ভয়াবহ রূপ করেছিলো তার মূলেও ছিলো বৃষ্টিপাত। বিশ্বব্যাংকের মতে, ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় ভারী বর্ষণ হয়েছিলো। ফলে এর পরের মাসগুলোর অনুকূল তাপমাত্রা আর আর্দ্রতা ডেঙ্গুর ব্যাপক বিস্তারে ভূমিকা রেখেছিল। ঢাকার অসংখ্য নির্মাণাধীন প্রকল্প এডিস মশা উৎপাদনের অন্যতম ক্ষেত্র বলে মনে করেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জ্যেষ্ঠ কীটতত্ত্ববিদ বি এন নাগপাল। তার মতে, নির্মাণ প্রকল্প এলাকায় মশা উৎপাদন ক্ষেত্র বিনাশ করা সম্ভব হলে ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ ৪০ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব। বিশেষজ্ঞদের মত যাই হোক, আমাদের সচেতনতার অভাব এবং অপরিচ্ছন্নতাই এডিস মশা বৃদ্ধির প্রধানতম কারণ। সেজন্য ডেঙ্গুর বিস্তার রোধে আমাদের সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। নেদারল্যান্ডের গবেষক ডি এ ব্লেইজিসের মতে, স্পানিস শব্দ ডিঙ্গা বা ডেঙ্গু মানেই হলো সতর্ক থাকা। প্রাচীনতম এই রোগের প্রধান প্রতিষেধকই তাই সচেতন ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা।
সাধারণত জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার প্রজনন মৌসুম ধরা হয়। কারণ, এ সময় বৃষ্টিপাতের কারণে পানি জমে। সে পানিতেই এডিস মশার প্রজনন ঘটে। এডিস মশার আঁতুড়ঘর যেহেতু পানি, তাই এ সময় আমাদের চারপাশে জমে থাকা পানিতে ডেঙ্গুর বংশ বিস্তার বেশি হয়। তবে এখানে স্মরণীয় যে, সব পানিতেই এডিস মশা জন্মায় না। নর্দমা, কূপ, পুকুর, লেক, নদী বা মাটির আধারে ডিম পাড়ে না এডিস মশা। এসব জায়গায় যে মশা দেখা যায়, তা এডিস নয়। এই মশা জনগণের আবাসস্থল নয়তো নির্জন ও পরিত্যক্ত জায়গায় জমে থাকা পরিষ্কার পানিতে জন্ম নেয়। তাই ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে মশার প্রজনন বন্ধ করা আর মশা নির্মূলের কোনো বিকল্প নাই। পানি জমতে পারে এমন কোনো অবস্থাই যেন না হয় সেটা খেয়াল রাখতে হবে। সকল প্রকারের ডাবের খোসা, নারিকেলের মালা, পুরাতন টায়ার, চিপসের খালি প্যাকেট, ছাদের উপরে জমে থাকা পানি ইত্যাদি সবই সরিয়ে ফেলতে হবে নিজ উদ্যোগে। কেননা কীটতত্ত্ববিদ বি এন নাগপালের তথ্য মতে, এডিস মশা ডিম পাড়ার পরে এক বছর পর্যন্ত সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে। কোনো পাত্রে এডিসের ডিম থাকলে তার অপসারণ না করলে এক বছরের মাথায় পানির স্পর্শ পেলে ডিম ফুটে বাচ্চা হতে পারে। পানি জমে মশার বংশবৃদ্ধি যাতে না ঘটে, সে ব্যাপারে নির্মাণের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের দায়িত্ব নিতে হবে। রাস্তাঘাটের আশপাশে, নালা ও নর্দমায় যাতে পানি জমতে না পারে, সেজন্য সিটি কর্পোরেশনকে আরো সজাগ ও সচেতন হতে হবে এবং ডেঙ্গু প্রতিরোধে টেকসই ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি ডেঙ্গু নির্মূলের জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খল পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তার যথাযথ বাস্তবায়ন। একসময় দেশে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ ছিল খুব বেশি, যার বাহকও মশা। সেই ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণে এসেছে সুষ্ঠু পরিকল্পনামাফিক কাজ করার জন্য। অন্য মশা ও মশাবাহিত রোগ যেমন কার্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে এসেছে, এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও তদ্রুপ পদক্ষেপ নিতে হবে।
লেখক: প্রভাষক, সমাজকর্ম বিভাগ, সাভার
সরকারি কলেজ, সাভার, ঢাকা
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন