শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

মহানবী (সা.) : অমুসলিম মনীষীদের চোখে

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ২০ জুন, ২০২২, ১২:০২ এএম

মানবজাতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা সেখানে নানা রকমের সংস্কারকদের দেখা পাই। পৃথিবীর বুকে আবির্ভূত হয়েছিলেন অনেক দার্শনিক, চিন্তাবিদ, বিশাল সাম্রাজ্যের অধিপতি, রাজা-মহারাজা, সম্রাট, দিগি¦জয়ী বীর, দল ও মতের প্রতিষ্ঠাতা, দোর্দণ্ড প্রতাপশালী বিপ্লবী, নিত্য নতুন ধর্মমতের প্রবর্তক এবং আইন প্রণেতাগণ। কিন্তু নবী-রসূলগণ ব্যতীত বাকীদের জীবনী, আদর্শ এবং সার্বিক কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করলে কোথাও কোনো পূর্ণাঙ্গ কল্যাণ এবং সুফল দেখা যায় না। যেটুকু কল্যাণ ও সুফল চোখে পড়ে তা নিতান্তই আংশিক, একপেশে এবং ক্ষণস্থায়ী। প্রকৃতপক্ষে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর মাধ্যমেই সাধিত হয়েছিল মানব সভ্যতার প্রকৃত উত্থান এবং উজ্জীবন। সত্য ও ন্যায়ের এক স্বর্ণোজ্জ্বল প্রভাতের অভ্যুদয় ঘটিয়ে তিনি সভ্যতার আকাশকে করেছিলেন মেঘমুক্ত। উদ্বোধন করেছিলেন সত্য ও ন্যায়ের এক ঐতিহাসিক যুগের। বিশ্ব ইতিহাসে এটা এত বড় কীর্তি ও কৃতিত্ব, যার উদাহরণ দ্বিতীয়টি আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। ইতিহাসের আলোকে তাই তিনি এক ক্ষণজন্মা, মহান, কর্মতৎপর, দূরদ্রষ্টা, সত্যানুসন্ধানী মহাপুরুষ হিসেবে প্রশংসিত, শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়-বরণীয়। এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকার মতো প্রকাশনা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় স্বীকৃতি প্রদান করেছে যে, ‘জীবজগতের সকল ধর্ম প্রবর্তক ও ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের মধ্যে হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর স্থান হচ্ছে সবার উপরে এবং তিনি সফল মহামানব।’
ইতিহাসে মহামানব হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর অবস্থান কতটা গৌরবদীপ্ত তা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। ফরাসী সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ঘোষণা করেছিলেন যে, মুহাম্মদ (সা.) এর ধর্মই আমার নিকট সর্বাপেক্ষা প্রিয়। অতঃপর মহানবী (সা.) এর অনুপম চরিত্র ও বহুমুখী প্রতিভায় আকৃষ্ট এবং অভিভূত হয়ে তিনি এই মর্মেও আশা প্রকাশ করেন যে, ‘সে সময় খুব দূরে নয়, যখন সকল দেশের বিজ্ঞ ও শিক্ষিত ব্যক্তিদের আমি একতাবদ্ধ করতে পারব এবং কুরআনের যে নীতিসমূহ একমাত্র সত্য এবং যে নীতিসমূহই মানুষকে সুখের পথে পরিচালিত করতে পারে সেসব নীতির উপর ভিত্তি করে এক সমরূপ শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবো।’ মহানবী (সা.) সম্পর্কে আরো একটি বলিষ্ঠ স্বীকৃতি উচ্চারিত হয় বিখ্যাত মনীষী টমাস কার্লাইলের কণ্ঠে। ১৮৪০ সালে এডিনবার্গে আয়োজিত একটি সভায় দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তিনি ষোষণা করেন, ‘শুধু সাধারণ মানুষের মধ্যেই নয়, সৃষ্টিকর্তা প্রেরিত দূত বা নবীদের মধ্যে নায়কের স্থান অধিকার করে রয়েছেন সুদূর আরবের হযরত মুহাম্মদ (সা.)।’ অতঃপর তিনি তাঁর প্রাঞ্জল অনুপম ভাষায় আরো বলেন, ‘জগতের আদিকাল হতে আরবরা মরুভূমির মধ্যে বিচরণ করে বেড়াত এক অজ্ঞাত, অখ্যাত মেষপালকের জাতি হিসেবে। অতঃপর তারা হৃদয়ঙ্গম করতে পারে এমন একটা বার্তাসহ সেখানে এক ধর্মবীর পয়গম্বর প্রেরিত হলেন, আর অমনি যাদুর মতো সেই অখ্যাত জাতি হয়ে উঠল জগদ্বিখ্যাত, দীনহীন জাতি হয়ে গেল জগতের শ্রেষ্ঠ জাতি। তারপর এক শতাব্দীর মধ্যে পশ্চিমে গ্রানাডা হতে পূর্ব দিল্লী পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হলো আরবদের আধিপত্য। সুদীর্ঘ কয়েক শতাব্দী ধরে পৃথিবীর এক বিশাল অংশের উপর আরবদেশে মহাসমারোহে এবং বিক্রমের সাথে তার দ্যুতি বিকিরণ করেছে।’ লা মারটিন লিখেছেন, ‘কার এমন ধৃষ্টতা আছে যে, ইতিহাসের অন্য কোনো মহামানবের সাথে হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর তুলনা করতে পারে? প্রায় সব বিখ্যাত মানুষ যদি কিছু অর্জন করেই থাকেন তা তো জাগতিক শক্তি সামর্থ্য বৈ কিছুই নয়, যা প্রায় ক্ষেত্রে তাদের সম্মুখেই টুকরো টুকরো হয়ে ধ্বংস হয়ে গেছে। এই মহামানব হযরত মুহাম্মদ (সা.) শুধুমাত্র সেনাবাহিনী পরিচালনা করেননি, আইনই কেবল প্রণয়ন করেননি, রাজ্যই কেবল প্রতিষ্ঠা করেননি, জনসাধারণকেই কেবল সুসংগঠিত করেননি, কেবল খিলাফতের ধারাবাহিকতাই স্থাপন করেননি বরং তিনি সেই সময়কার জানা দুনিয়ার তিন ভাগের এক ভাগ অথবা ততোধিক জনপদের লাখ লাখ অধিবাসীর জীবনে বৈপ্লাবিক পরিবর্তন এনেছেন। তাদের উদ্ধার করেছেন কল্পিত দেব-দেবীর খপ্পর থেকে। ধর্মীয় ধ্যান-ধারণা চিন্তা-চেতনা ও বিশ্বাসে এনেছেন পরিবর্তন। বিকশিত করেছেন তাদের আত্মা ও মননকে। একটি মহাগ্রন্থের ভিত্তিতে নির্মাণ করেছেন এক অনন্য আধ্যাত্মিক জাতীয়তা, যা প্রত্যেক ভাষার মানুষকে, প্রত্যেক গোত্রের মানুষকে এক অনন্য ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ করে। সেই মহাগ্রন্থের প্রতিটা অক্ষর পরিণত হয়েছে আইনে। দার্শনিক, সুবক্তা, রাসূল, আইন প্রণয়নকারী, বীরযোদ্ধা, নিরাকারের ইবাদত আনয়নকারী, কুড়িটা জাগতিক সাম্রাজ্যের এবং একটি আধ্যাত্মিক সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাকারী হচ্ছেন হযরত মুহাম্মদ (সা.)। মানুষের বিরাটত্ব ও মহত্ব পরিমাপের তাবৎ মানদণ্ড একত্র করে আমাদের শুধু একটি মাত্র প্রশ্ন, তাঁর চেয়ে শ্রেষ্ঠতর কোনো মানুষ কি আর কোথাও আছেন?’

মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) যে যুগে আরব দেশে জন্মগ্রহণ করেন সে যুগকে ঐতিহাসিকগণ আইয়ামে জাহিলিয়াত বা অন্ধকার যুগ নামে অভিহিত করে থাকেন। মানবতা সেখানে ছিল ভুলুষ্ঠিত, এমন কোনো অপকর্ম বাদ ছিল না, যেটা তখন আরবদেশে হতো না। পৃথিবীর অন্যান্য দেশ ও জাতির অবস্থাও তখন ভালো ছিল না। এ সময় মানবজাতি ও সভ্যতা রক্ষার ক্ষেত্রে মহানবী (সা.) যে অভূতপূর্ব ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন, সে ব্যাপারে মনীষীগণ অকপটে এ মহামানবের কৃতিত্ব স্বীকার করে তাঁর সম্পর্কে বিভিন্ন সময়ে অসংখ্যবার প্রশংসাসূচক মন্তব্য করেছেন। এক গ্রন্থে ঐতিহাসিক ড. গেসটাউলি বলেন, ‘ইসলামের সেই উম্মী নবীর ইতিবৃত্ত অতিশয় আশাব্যঞ্জক। তৎকালের কোনো বৃহৎ শক্তি যে জাতিকে নিজের আওতায় আনতে পারেনি, সেই উচ্ছৃংখল জাতিকে তিনি ঐক্যবদ্ধ করেন।’ অপর এক মনীষীর মন্তব্য, ‘তখন এমন শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল, যা কোনক্রমেই পূরণীয় ছিল না। এমন ধারণা করা হতো যে, দীর্ঘ চার হাজার বছর গড়ে উঠা মানব সভ্যতা ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। গোটা মানবজাতি আবার হিংস্রতা আর বর্বরতার দিকে ধাবিত হচ্ছিল। মানবতার ঐক্যে ফাটল দেখা দিয়েছিল। বিভিন্ন গোত্র ও সম্প্রদায় পরস্পরের প্রতি চরম শক্রতাভাবাপন্ন ছিল। আইনশৃংখলার অস্তিত্ব ছিল না। তখন খ্রিস্টধর্ম যেরূপে বিরাজমান ছিল তা মানবতার জন্য কল্যাণকর না হয়ে মানব ঐক্য ও শৃংখলা ধ্বংস করছিল। সে সময় আরবদের মাঝে এমন এক ব্যক্তি আবির্ভূত হলেন, যিনি পূর্ব ও দক্ষিণের সমগ্র অজানা পৃথিবীকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন- সেই মহামানবের নাম মুহাম্মদ (সা.)।’ (J.H. Denishon: Emotions as the Base of Civilization)

নারীরা যুগ যুগ ধরে নির্যাতন ও নিগ্রহ ভোগ করে আসছিল। সত্যিকার মানবিক মর্যাদা হতে তারা বঞ্চিত। মানব সভ্যতার ইতিহাসে নারীর মর্যাদা রক্ষার জন্য যিনি প্রথম সোচ্চার হয়ে উঠেন, মানব জীবনে নারীর অধিকার পূর্ণভাবে যিনি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তিনি হলেন মহানবী (সা.)। এ ব্যাপারে মনীষী পিয়েরে ক্রাবইট বলেন, ‘মুহাম্মদ (সা.) সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসে নারী অধিকারের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রবক্তা ছিলেন।’ ডব্লিউ ডব্লিউ কেশ লিখেছেন, ‘প্রথমবারের মতো ইসলামই নারীদের মানবাধিকার দিয়েছে। দেহ ব্যবসার জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করেছে। মদকে হারাম ও জুয়া খেলাকে মহাপাপ হিসেবে গণ্য করেছে।’

মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও মানবতার সুন্দরতম আদর্শ প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সা.) সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। এ সম্পর্কে জেনেভা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতনামা অধ্যাপক এডওয়ার্ড মান্টো বলেন, ‘চরিত্র গঠন ও সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে মুহাম্মদ (সা.) যে সাফল্য অর্জন করেছেন সেদিক থেকে তাঁকে বিশ্বমানবতার মহান দরদী নেতা বলে প্রতীয়মান হয়।’ প্রিয়নবীর (সা.) মহানুভবতার কথা বলতে যেয়ে মক্কা বিজয়কালীন ইতিহাস তুলে ধরে ঐতিহাসিক গীবন বলেন, ‘হযরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁর পদতলে দুশমনদের পেয়েও একে একে সব দুশমনকে মাফ করে দিয়ে যে দৃষ্টান্ত স্থপন করেন, অনুরূপ দৃষ্টান্ত পৃথিবীর সুদীর্ঘকালের ইতিহাসে দ্বিতীয়টি আর নেই। সেই ঔদার্য ও ক্ষমাশীলতার দ্বিতীয় কোনো দৃষ্টান্ত আর দেখা যায় না।’

মহানবী (সা.) এর আদর্শকে মহান আল্লাহপাক নিজেই বলেছেন, উসওয়াতুন হাসানা অর্থাৎ সুন্দরতম আদর্শ। তাঁকে আল্লাহপাক সিরাজাম মুনীরা বলেও অভিহিত করেছেন, যার অর্থ হলো উজ্জ্বল প্রদীপ। অন্যদিকে পৃথিবীর বড় বড় মনীষীরা মহানবী (সা.) এর কর্মবহুল বর্ণাঢ্য জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে বিস্তর গবেষণা করে তাঁকে সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম মহামানব হিসেবে মূল্যায়ন করেছেন। লিও টলস্টয় মহানবী (সা.) এর বিশাল কর্মজীবনে কতটা মুগ্ধ ছিলেন, তা তাঁর মন্তব্য থেকে বুঝা যায়। তিনি বলেন, ‘আমি মুহাম্মদের নিকট হতে অনেক কিছু শিখেছি। তাঁর আবির্ভাবের পূর্বে পৃথিবী অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। তিনি সেই অন্ধকারে দীপ্ত বহ্নির মতো প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠেছিলেন। আমি দৃঢ়তার সাথে বিশ্বাস করি যে, মুহাম্মদের শিক্ষা ও দ্বীন ছিল যথার্থ।’ খ্যাতনামা দার্শনিক ও হিন্দু ধর্মের নেতা স্বামী বিবেকানন্দ বলেন, ‘হযরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন সাম্যের, মানবতার ও সৌভ্রাতৃত্বের সুমহান দূত।’ ১৯৩৬ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে দেয়া এক শুভেচ্ছা বাণীতে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, ‘যিনি মহত্মমদের মধ্যে অন্যতম, সেই পবিত্র পয়গম্বর হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর উদ্দেশ্যে আমি আমার অন্তরের গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি। মানুষের ইতিহাসে এক নতুন সম্ভাবনাময় জীবনশক্তি সঞ্চার করেছিলেন হযরত মুহাম্মদ (সা.)। তিনি এনেছিলেন নিখাদ, শুদ্ধ ধর্মাচরণের আদর্শ।’ জর্জ বার্নাড শ বলেছেন, ‘আমি ভবিষ্যৎ বাণী করছি যে, আগামীতে মুহাম্মদ (সা.) এর বিশ্বাস (ধর্ম) ইউরোপের কাছে গ্রহণীয় হবে, যেমনটা ইতোমধ্যেই ইউরোপের কাছে গ্রহণীয় হতে শুরু করেছে।’ প্রখ্যাত মার্কিন মনীষী মাইকেল এইচ হার্ট বিশ্ব ইতিহাসের বিভিন্ন খ্যাতনামা ব্যক্তির জীবনচরিত পর্যালোচনা করে তাঁদের মধ্য থেকে সর্বকালের সর্বাধিক প্রভাব বিস্তারকারী একশত জন সেরা ব্যক্তিত্ব বাছাই করে তার ঞযব ঐঁহফৎবফ গ্রন্থে তাঁদের নাম, সংক্ষিপ্ত জীবনী এবং মানব সভ্যতায় তাঁদের সুদূরপ্রসারী প্রভাবের বিষয় আলোচনা করেছেন। এসব সেরা মানুষদের মধ্যে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, কবি-সাহিত্যিক, দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক, শিল্পী প্রভৃতি বিভিন্ন শ্রেণির খ্যাতনামা ব্যক্তি রয়েছেন। তার এই গ্রন্থে নির্বাচিত এসব সেরা মানুষদের তালিকায় সৃষ্টিকূলের সেরা ব্যক্তিত্ব হিসেবে শীর্ষে স্থান পেয়েছেন মহানবী (সা.)।

এভাবে আমরা আরো দেখতে পাই পি. কে. হিট্টি, জেমস এ মিসেনার, আর্থার গিলমান, মরিস গড ফ্রে, টি ডব্লিউ আরনল্ড, স্টেইলি লেনপোল, বসওয়ার্থ স্মিথ, মেজর আর্থার গ্লায়ন লিউনার্ড, বার্ট্রান্ড রাসেল, ড্রপার, ড. গাসটাভ উইল, অ্যানি বেসান্ত, স্যার গোকুল চন্দ্র, জোসেফ হেল, ড. গেসডটউলি, আলফ্রেড মার্টিন, রবার্ট বিফ্রো, এডন্ড বার্ক, ক্যাডফ্রে হেগেল, পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুসহ পৃথিবীর অসংখ্য মনীষী মহানবী (সা.) এর আদর্শ এবং জীবনের নানাবিধ কর্মাকান্ডের ব্যাপক বিচার-বিশ্লেষণ করে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান। তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, সুন্দরতম চরিত্র, অনুপম আদর্শ, নির্ভীকতা ও সহনশীলতার মাদুর্য দেখে তারা মুগ্ধ হয়ে যান। তাঁর সতাতা, কর্তব্যপরায়ণতা, ন্যায়নীতি, ক্ষমা, দয়া এবং নিষ্ঠা দেখে তাঁরা সশ্রদ্ধ সালাম জানান তাঁর প্রতি। সর্বোপরি তাঁরা এটাও অকপটে স্বীকার করেন যে, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর আদর্শই মানবতা মুক্তির একমাত্র পথ, যা বিশ্বশান্তিকে নিশ্চিত করতে পারে।
বর্তমান বিশ্ব প্রযুক্তি, সভ্যতা ও মানবতার শীর্ষলোকে উন্নীত হলেও সংঘাত-সংকট থেকে মুক্ত হতে পারেনি। ভিন্নতর সংকট অহরহ মানবতার টুঁটি চেপে ধরেছে। ধর্ম ক্রমে কক্ষচ্যুত হয়ে পড়ছে। এক ধর্মাবলম্বীরা অন্য ধর্মাবলম্বীদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, সামাজিক সদ্ভাব ও সম্প্রীতির জন্য যেমন পরস্পরের বোঝাপড়া প্রয়োজন, তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে বোঝাপড়া ও একে অন্যের ধর্ম সম্পর্কে সম্যক অধ্যয়ন। এই সম্যক অধ্যয়ন ভিন্নতার মধ্যে একতা ও সমন্বয়ের বীজ বপন করে মানবতাকে প্রসারিত করে তোলে। দূরকে নিকট বন্ধুতে, পরকে আপন ভাইয়ে পরিণত করে। তার বিপরীত হলে ধর্মীয় বিদ্বেষের ব্যথা বিষে সমাজ হয় কুলুষিত। ক্লীবত্বে ও স্থবিরতায় আক্রান্ত হয়ে রুগ্ন সমাজে অচলায়তনের সৃষ্টি হয়।
মুসলমান ও হিন্দু আমাদের এ উপমহাদেশে দুই প্রধান জাতি। এরা একে অন্যের পরিপূরক। এক বৃন্তে দুটি কুসুম। ধর্মহীনতা, রক্ষনশীলতা ও রাজনৈতিক দুরভিসন্ধির পঙ্কিল আবর্তে এই বৃন্তে ক্ষত সৃষ্টি করে দুটি জাতির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা হয়। কুরআন অখণ্ড মানবতার প্রবক্তা। যেখানে প্রতিজন আল্লাহর পরিবারের সদস্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ইসলামী দর্শনের মূল কথা, আল্লাহকে ভালোবাসতে হলে আগে মানুষকে ভালোবাসতে হবে। স্বয়ং আল্লাহ বলেন, ‘তুমি যদি আমার দয়া পেতে আগ্রহী হও, তাহলে আমার সৃষ্টির প্রতি দয়াশীল হও’। বিশ্বজনীন মানবিক ভালোবাসা ইসলামের মূলকথা। সেই কথা প্রকাশ করতে গিয়ে মহানামব্রত ব্রহ্মচারী ‘ইসলাম’ শব্দের ব্যাখ্যা করেছিলেন এভাবে: ISLAM: I shall love all mankind.’’

স্বামী বিবেকানন্দ বলেন, ‘ধর্ম সকলের বাধ্যকত্ব বা সহায়কত্ব বিশেষরূপে পরীক্ষিত হোক, দেখা যাবে ইসলাম যেথায় গিয়েছে, সেথায় আদিম নিবাসীদের রক্ষা করেছে। সেসব জাতি সেথায় বর্তমান। ...ইউরোপে যা কিছু উন্নত হয়েছে, তার প্রত্যেকটিই খ্রিস্টান ধর্মের বিপক্ষে বিদ্রোহ দ্বারা। আজ যদি ক্রিশ্চানীর শক্তি থাকত তা হলে ‘পাস্তের (pasteur) এবং ‘ককে’র (Kock) ন্যায় সকলকে জীবন্ত পোড়ানো হতো এবং ডারউইন-কল্পদের শূলে দিত।--- এর সঙ্গে ইসলামের তুলনা কর। মুসলমান দেশে যাবতীয় পদ্ধতি ইসলাম ধর্মের উপরে সংস্থাপিত এবং ইসলামের ধর্ম শিক্ষকেরা সমস্ত রাজ কর্মচারীরা বহু পুজিত এবং অন্য ধর্মের শিক্ষকেরাও সম্মানিত।’

স্বামীজির কথার সত্যতা চিন্তা করলেই দেখা যাবে, সাতশত বছরের কিছু বেশি সময় ধরে মুসলমানদের প্রশাসন চললেও ভারতের কোনো জাতি বা ধর্মের ব্যাপারে তারা হিংসা বা বিরূপ আচরণ করেননি। আজ যদি এই ধারণা হয়, ভারতবাসীকে সব এক ধর্মীয় জাতিতে পরিণত করতে হবে, তাতে ধর্মান্তকরণ, বিতাড়ন যেটি যেখানে প্রয়োজন, তাহলে নিঃসন্দেহে বলা যায়, এই সাংঘাতিক সংকল্পের সঙ্গে বিগত পৌনে এক হাজার বছর রাজত্ব করা মুসলমানদের মানসিকতার তুলনা করলে শ্রদ্ধায় হৃদয় হৃষ্ট ও নমনীয় হয়ে ওঠে। কই, প্রতিমাপূজকদের তো তাঁরা দেশ থেকে তাড়িয়ে দেননি, বন্দি করেননি কিংবা নির্যাতন বা হত্যা করেননি। যদি তারা তা চাইতেন তাহলে তো ভারতে অন্য কোনো ধর্ম বা অন্য ধর্মাবলম্বী লোকের অস্তিত্বই থাকত না। কুরআনের নির্দেশ: ‘যে অন্যায়ভাবে একজনকে হত্যা করল, সে যেন গোটা মানব জাতিকে হত্যা করল।’

নিরাকার ও একেশ্বরবাদী ইসলাম ধর্মের সঙ্গে বহু ঈশ্বরবাদের আঁতাত কোনোভাবে সম্ভব নয়। তবে ইসলাম ধর্ম যতটা সৌজন্য দেখাবার দরকার তা দেখায়। সৌজন্য দেখানোর নির্দেশ দিয়েছে কুরআন। কুরআনে বলা হয়েছে, ‘তারা আল্লাহর পাশাপাশি যাঁদের উপাসনা করে, তাঁদের গালি দিয়ো না।’ প্রকৃত মুসলমানরা কখনো প্রতিমা কিংবা প্রতিমাপূজকদের গালি দেয় না। হিংসা করে না, কারণ এতে পারস্পরিক বিরোধের সৃষ্টি এবং শান্তি ভঙ্গ হতে পারে। শান্তি স্থাপনের পর শান্তি ভঙ্গ না করার জন্য কুরআনের সুস্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে। এই হচ্ছে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি। বহু ঈশ্বরবাদ ইসলাম ধর্মের বিপরীত মেরুর বিষয়। তবুও কোনও মুসলামানকে বহু ঈশ্বরবাদীদের ভাবাবেগে আঘাত করতে ইসলাম অনুমোদন দেয় না। বস্তুত ইসলাম এমন এক ধর্ম, সে ধর্ম এই সত্য স্বীকার করে যে, সত্য যে কোনো আদর্শের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত। যে ধর্ম বিশ্বের সমস্ত বড় ধর্মের শ্রদ্ধার পাত্র, যে ধর্ম আশা করে যে, তার অনুগামীরা সকলের প্রতি সৌজন্য দেখাবে, এমন কী তাদের প্রতি সৌজন্য দেখাতে বলা হয়েছে, যাঁরা অসহিষ্ণুতার বীজ বপন করে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন