প্রবল বর্ষণে তলিয়ে যাওয়া চট্টগ্রাম মহানগরের আকবর শাহ থানার ১ নম্বর ঝিল, বরিশালঘোনা ও ফয়’স লেকের লেকভিউ এলাকার পৃথক দুটি পাহাড় ধসের ঘটনায় চারজন প্রাণ হারিয়েছে। আহত হয়েছে ১১ জন। বরিশালঘোনায় নিহতদের মধ্যে একই পরিবারের দু’ বোন রয়েছে। এক বোনের যমজ দুই শিশু সন্তান রক্ষা পেয়েছে। মা শিশু দুটিকে বুকে আগলে রেখেছিল। অপর ঘটনায় নিহত হয়েছে এক যুবক ও এক কিশোর। চট্টগ্রামে পাহাড় ধসে মৃত্যু, বলা বাহুল্য, কোনো নতুন ঘটনা নয়। প্রতি বছরই বর্ষার সময় পাহাড় ধসের ঘটনায় মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটছে। গত বছরও ছয় শিশুসহ ১১ জনের মৃত্যু হয়। চট্টগ্রামে পাহাড় ধসে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ২০১৭ সালের ১১ জুন। নগরের বিভিন্ন এলাকায় সংঘটিত পাহাড়ধসে ১২৭ জন নিহত হয়। এই ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনার পর জেলা প্রশাসনের তরফ থেকে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি নামে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি গত ১৫ বছরে অন্তত ২১টি সভা করে ৩৬ দফা সুপারিশ করেছে। দুঃখজনক হলো, এ যাবৎ একটি সুপারিশও বাস্তবায়ন করা হয়নি। পাহাড়ে বসবাসকারীদের উচ্ছেদ, পাহাড় কাটা রোধ এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি কথিত কমিটি গঠনের উদ্দেশ্য হলেও আজ পর্যন্ত কোনো উদ্দেশ্যই সাধিত হয়নি। না হয়েছে উচ্ছেদ, না হয়েছে পাহাড় কাটা বন্ধ, আর না হয়েছে সচেতনতা বৃদ্ধি। মহানগরের ফিরোজশাহ, আকবর শাহ, পাহাড়তলি, আম বাগান, ঝাউতলা, ফয়’স লেক, কৈবল্যধাম, শেরশাহ, মাতঝর্ণা লালখানবাজার, বাঘঘোনা বাটালিহিল ইত্যাদি পাহাড়সহ অন্তত ৩০টি এলাকায় হাজার হাজার মানুষ অবৈধভাবে বসবাস করছে। পাহাড় কেটে কিংবা পাহাড়ের পাদদেশে ভঙ্গুর মাটিতে ঘর তুলে তারা বসবাস করছে। সাধারণত নিম্ন আয়ের, বিশেষ করে কর্মজীবী মানুষই পাহাড়ীবসতির বাসিন্দা। ধারণা করা হয়, চট্টগ্রাম মহানগরে এমন অন্তত ২০ হাজারের মতো মানুষ আছে, যারা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় পাহাড়ে অবস্থান করছে। এদের উচ্ছেদ করা বা সরিয়ে নেয়া মোটেই কোনো কঠিন কাজ নয়। তা সত্ত্বেও তারা সেখানে রয়েছে এবং তাদের অনেকের জীবনপ্রদীপ নির্বাপিত হচ্ছে ধসে পড়া মাটির নিচে চাপা পড়ে।
শুধু চট্টগ্রাম মহানগর নয়, চট্টগ্রামের অন্যান্য পাহাড়ি এলাকা, কক্সবাজার, তিন পার্বত্য জেলা এবং সিলেটে প্রায়ই পাহাড়ধস প্রাণহানির ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। এসব এলাকার ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে কিংবা তার পাদদেশে মানুষ বসতি গড়ে তুলেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, পাহাড় আর এখন আগের মতো নেই। পাহাড়খেকোরা ইতোমধ্যে অনেক পাহাড় সাবাড় করে দিয়েছে। অবশিষ্ট পাহাড়ও তাদের নিশানার বাইরে নেই। পাহাড় কেটে ঘরবাড়ি, আবাসিক এলাকা, শিল্পকারখানা দোকানপাট, বাজারহাট গড়ে তোলা হচ্ছে। পাহাড় কেটে মাটি বেচা হচ্ছে। অধিকাংশ পাহাড়ে গাছগাছালি নেই বললেই চলে। গাছগাছালি আগেই কেটে ফেলা হয়েছে। পাহাড় প্রকৃতি ও পরিবেশের অপরিহার্য উপাদান। মাটির স্থিতিস্থাপকতা রক্ষায় পাহাড়ের ভূমিকা বিশদ ও ব্যাপক। পাহাড় কাটার কারণে প্রকৃতির ভারসাম্য যেমন বিনষ্ট হচ্ছে তেমনি পরিবেশ ও বিপন্ন হচ্ছে। মাটি আলগা হয়ে যাচ্ছে এবং তার স্থানান্তর ঘটছে দ্রুত। পাহাড়ে গাছগাছালি কম থাকা বা না থাকায় বৃক্ষ ও প্রাণবৈচিত্র্যের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে বা হচ্ছে। ওদিকে আবহাওয়ার পরিবর্তন ও ভূমি, নদী, পাহাড়, ধ্বংসের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় বন্যা, ঝড়- জলোচ্ছ্বাস, ভূমিধস, ভূমিকম্প ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে। ভারী বর্ষণ তো বটেই, মাঝারি বর্ষণেও ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বড় শহরগুলোতে বন্যা ও জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে। প্রতি বছর এই বন্যা ও জলাবদ্ধতায় মানুষের যেমন অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হতে হচ্ছে তেমনি সহায়-সম্পদের বেশুমার ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। এবার বর্ষা আসার আগেই সিলেট, চট্টগ্রাম এবং উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় বন্যা হয়ে গেছে। এখন দ্বিতীয় দফা বন্যা শুরু হয়েছে। সিলেট-সুনামগঞ্জে এখন বন্যার যে তাণ্ডব চলছে, তাকে ভয়ংকর বললেও কম বলা হয়। ১২২ বছরের মধ্যে এরকম বন্যা হয়নি। চট্টগ্রাম মহানগর ইতোমধ্যে পানির নিচে চলে গেছে। উত্তরাঞ্চলে প্রায় সব নদী বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যার তোড়ে দিশাহারা হয়ে পড়েছে মানুষ। দেশের মধ্যাঞ্চলও বন্যা কবলিত হওয়ার আশংকার মধ্যে রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবারের বন্যা ’৮৮ বা ’৯৮ সালের বন্যাকে ও ছাড়িয়ে যেতে পারে। বলা যায়, গোটা দেশই এখন দীর্ঘস্থায়ী ও ভয়ংকর বন্যার ঝুঁকির সম্মুখীন।
এমন প্রেক্ষাপটে পাহাড়ি জেলাগুলোতে, বিশেষ শহর এলাকায় পাহাড় ধসের ঘটনা মারাত্মক রূপ নিতে পারে। এখনই প্রয়োজনীয় উদ্যোগ না নিলে পাহাড়ধসে মৃত্যুর সংখ্যা অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়ে যেতে পারে। চট্টগ্রাম মহানগর, কক্সবাজার, তিন পার্বত্য জেলাসদর ও সিলেট শহরে যারা পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে, অবিলম্বে তাদের সরিয়ে দিতে হবে। প্রশাসনকে এব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, রাজনৈতিক পোষকতা, প্রশাসনিক দুর্বলতা ও এক শ্রেণির কর্মকর্তার অনৈতিক অর্থ-স্বার্থের কারণে পাহাড়ে অবৈধ বসতি উচ্ছেদ করা সম্ভব হচ্ছে না। বিভিন্ন সময় উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয় বটে, তবে তা লোকদেখানো ছাড়া আর কিছুই নয়। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আবার উচ্ছেদ করা জায়গায় বসতি গড়ে ওঠে। উচ্ছেদ করার পর ফের বসতি গড়ে ওঠা কিংবা বিদ্যুত-গ্যাস-পানির লাইন কেটে দেওয়ার পরও পুনরায় এসব লাইন লেগে যাওয়া বন্ধ করা না হলে পাহাড়ে বসতি স্থাপন রোধ করার অন্য উপায় নেই। অতএব, প্রশাসনকে সেটাই করতে হবে, যাতে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস চিরতরে বন্ধ হয়। সরকার এদিকে অবিলম্বে এদিকে নজর দেবে বলে আমরা আশা করি। আমরা এও আশা করি, যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাহাড়ে বসবাস করছে তাদের মধ্যে যথাযথ সচেতনতার উদয় হবে এবং যতদ্রুত সম্ভব তারা পাহাড় ছেড়ে যাবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন