চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর নিচ দিয়ে নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধু ট্যানেলের কাজ দ্রুত শেষ করে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে উদ্বোধনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ট্যানেলের নির্মাণ কাজ ৮০ শতাংশেরও বেশি শেষ হয়েছে। বোরিং শেষে ট্যানেলের ভিতর এখন ফিনিশিং কাজ চলছে। ট্যানেলের দুই প্রান্তে সংযোগ সড়কের নির্মাণ কাজও অনেকটা শেষ পর্যায়ে। সবকিছু মিলে ট্যানেলের নির্মাণ কাজের অগ্রগতি অত্যন্ত সন্তোষজনক এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই তা স¤পন্ন হবার বিষয়ে আমরা আশাবাদী। ট্যানেল দিয়ে বের হওয়া গাড়িগুলোর সহজ চলাচলের জন্য ট্যানেলের দক্ষিণ চট্টগ্রাম প্রান্তের সড়কগুলি চার লাইন হওয়া খুবই জরুরি। বিশেষ করে, বাঁশখালীর বিদ্যমান বর্তমান সড়কটি চার লাইনে উন্নিত করা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। তা না হলে ট্যানেলের সুফল শতভাগ পাওয়া যাবে না।
এই ট্যানেলে মোট দুটি টিউব রয়েছে। প্রতিটি টিউবের ভিতর দিয়ে নির্মিত হচ্ছে দুই লাইনের সড়ক। ট্যানেলটি মোট চার লাইন বিশিষ্ট। সংযোগ সড়কসহ ট্যানেলটির মোট দৈর্ঘ্য ৯.৩৯ কিলোমিটার। এর মধ্যে নদীর তলদেশে বিদ্যমান ট্যানেলের দৈর্ঘ্য ৩.৩২ কিলোমিটার। ট্যানেলটির ভিতরের ডায়ামিটার ১০.৮০ মিটার আর বাইরের ডায়ামিটার ১১.৮০ মিটার। ট্যানেলটি নদীর তলদেশের ১৮-৪৩ মিটার নিচ দিয়ে গেছে। ট্যানেল নির্মাণের মোট বাজেট ১.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এক্সিম ব্যাংক অব চায়না অর্ধেক অর্থ যোগান দিচ্ছে আর বাকিটা বাংলাদেশ সরকার যোগান দিচ্ছে। চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্র্যাকশন কো¤পানি এই ট্যানেল নির্মাণ করছে।
দীর্ঘ কর্মযজ্ঞ শেষে বঙ্গবন্ধু ট্যানেলের মূল অবকাঠামো দাঁড়িয়ে গেছে। এখন চলছে ফিনিশিং কাজ, যা আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই শেষ হবে। এর পর ট্যানেল উদ্বোধন হবে এবং যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হবে। ট্যানেল খুলে দেয়ার সাথে সাথেই ট্যানেল দিয়ে ব্যাপক সংখ্যক যানবাহন চলাচল শুরু হবে এবং প্রতিদিন কয়েক হাজার গাড়ি ট্যানেল পাড়ি দেবে। সারাদেশ হতে কক্সবাজারগামী গাড়িসমূহ পতেঙ্গা হয়ে ট্যানেল পাড়ি দিয়ে দক্ষিণ চট্টগ্রামের একাধিক সড়ক দিয়ে কক্সবাজার যাবে। ট্যানেল থেকে বের হয়ে আনোয়ারা প্রান্তের সংযোগ সড়কটি পটিয়া-আনোয়ারা-বাঁশখালী (পিএবি) সড়কের সাথে চাতরী চৌমহনী এলাকায় সংযুক্ত হয়েছে। ট্যানেল পাড়ি দিয়ে কক্সবাজারগামী যানবাহনসমূহ পিএবি সড়কের সংযুক্ত স্থান হতে তিনটি রাস্তা দিয়ে কক্সবাজার অভিমুখে যাত্রা করবে। প্রথম রাস্তাটি হচ্ছে সংযুক্ত স্থান থেকে উত্তরে কর্ণফুলি থানাধীন শিকলবাহা ক্রসিং হয়ে, পটিয়া হয়ে আরাকান সড়ক দিয়ে কক্সবাজার। দ্বিতীয় রাস্তাটি হচ্ছে, পিএবি সড়কের সংযুক্ত স্থান হতে কালাবিবির দীঘির মোড় হয়ে পূর্বে আনোয়ারা উপজেলা হয়ে চন্দনাইশে আরাকান সড়কে ওঠে কক্সবাজার। তৃত্বীয় রাস্তাটি হচ্ছে পিএবি সড়কের সংযুক্ত স্থান হতে দক্ষিণে বাঁশখালী হয়ে পেকুয়া হয়ে চকরিয়া হয়ে কক্সবাজার। ইতোমধ্যে সরকার পিএবি সড়কের আনোয়ারা থানার কালাবিবির মোড় হতে কর্ণফুলি থানার শিকলবাহা মোড় পর্যন্ত সড়কটি ছয় লেনে উন্নিতকরণের কাজ হাতে নিয়েছে এবং এই সড়কটির নির্মাণ কাজ এখন শেষ পর্যায়ে রয়েছে। কিন্তু আনোয়ারা প্রান্ত হতে তিনটি রোড হয়ে যানবাহনসমূহ কক্সবাজার যাওয়ার সুযোগ থাকলেও অধিকাংশ যানবাহনই কিন্তু এক্ষেত্রে বাঁশখালীর সড়কটিকেই বেছে নেবে। বেশির ভাগ যানবাহন, বিশেষ করে প্রাইভেট কার, মাইক্রো এবং জীপসমূহ বাঁশখালী হয়েই কক্সবাজার যাবে। কারণ, বাঁশখালী এবং কক্সবাজার দুটোই ট্যানেলের দক্ষিণে অবস্থিত এবং ট্যানেল হতে বাঁশখালী হয়ে কক্সবাজারের দূরত্ব অন্য দুটি পথের চেয়ে অনেক কম। কিন্তু বাঁশখালীতে বিদ্যমান বর্তমান সড়কটি হচ্ছে দুই লাইন বিশিষ্ট, যা এত বেশি সংখ্যক গাড়ির চাপ সামলানোর জন্য উপযুক্ত নয়। ফলে এই সড়ক দিয়ে নিরবিচ্ছিন্ন এবং বিরামহীনভাবে যানবাহন চলাচল করতে পারবে না এবং বাঁশখালী সড়কটিতে যানজট লেগেই থাকবে। তাই বাঁশখালী সড়কটি চার লেনে উন্নিত করা অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে ।
কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানের কারণে বাঁশখালী সড়কটি ইতোমধ্যে একটি আঞ্চলিক মহাসড়কে পরিণত হয়েছে। পুরো বাঁশখালীর সব মানুষই এই একটি সড়ক হয়ে চট্টগ্রাম শহরে যাতায়াত করে থাকে। পেকুয়া, মহেশখালী এবং কুতুবদিয়া উপজেলার অধিকাংশ মানুষই এখন বাঁশখালী সড়ক হয়েই চট্টগ্রাম শহরে যাতাযাত করে। সাতকানিয়া এবং চকরিয়া উপজেলার প্রায় অর্ধেক মানুষ ও বাঁশখালী সড়ক হয়েই চট্টগ্রাম শহরে যাতাযাত করে। তাছাড়া অনেকেই বহু দিন ধরেই কক্সবাজার যাতায়াতের জন্য আরাকান সড়কের বিকল্প পথ হিসেবে বাঁশখালী সড়কটিকে ব্যবহার করে আসছে। এসব কারণে ইতোমধ্যে বাঁশখালী সড়কটি একটি অত্যন্ত ব্যস্ত সড়কে পরিণত হয়েছে। এ অবস্থায় বঙ্গবন্ধু ট্যানেল চালু হবার সাথে সাথেই বাঁশখালী সড়কটি দিয়ে চলাচলকারী যানবাহনের সংখ্যা কয়েক গুণ বৃদ্ধি পাবে। ফলে বাঁশখালী সড়কটিতে যানজটের সৃষ্টি হবে, যা ফলে দূর দুরান্ত হতে কক্সবাজারগামী মানুষসহ সবারই কষ্ট হবে এবং নষ্ট হবে মূল্যবান সময়। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে এখনই বাঁশখালী সড়কটি সংস্কার করতে হবে এবং একই সাথে চার লাইনে উন্নিত করতে হবে। তা না হলে যানবাহনের বিরামহীন এবং নিরবিচ্ছিন্ন চলাচল সম্ভব হবে না।
চট্টগ্রাম শহরের দক্ষিণে অবস্থিত বাঁশখালী উপজেলাটি উত্তর-দক্ষিণ লম্বালম্বি, অনেকটা আয়তকার বিশিষ্ট। বঙ্গোপসাগরের তীর জুড়েই এর অবস্থান। অর্থাৎ বাঁশখালীর পুরো পশ্চিম পার্শ্বে রয়েছে বঙ্গোপসাগর। এখানে রয়েছে দীর্য সমুদ্র সৈকত। সরকার ইতোমধ্যে এই সমুদ্র সৈকতকে উন্নয়নের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। সরকার আনোয়ারা-বাঁশখালী-পেকুয়া হয়ে বঙ্গোপসাগরের তীর দিয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত একটি মেরিন ড্রাইভ সড়ক নির্মাণেরও উদ্যোগ নিয়েছে। প্রস্তাবিত এই মেরিন সড়কটি নির্মিত হলে এই কয়েকটি উপজেলার উপকূলবর্তী এলাকাসমূহ অনেক উন্নত হবে এবং সারাদেশের মানুষ ট্যানেল হয়ে এই মেরিন ড্রাইভ দিয়েই কক্সবাজার যাতায়াত করবে। তবে এই মেরিন ড্রাইভ নির্মাণের কাজ এখনো শুরু হয়নি এবং এটির ফিজিবিলিটি স্টাডি চলছে। স্বাভাবিকভাবেই এই মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ একটি সময় সাপেক্ষ বিষয় এবং অল্প সময়ের মধ্যে এই মেরিন ড্রাইভ নির্মাণের কাজ শুরু হলেও তা স¤পন্ন হতে অনেক সময় লাগবে। অথচ, বঙ্গবন্ধু ট্যানেল ২০২২ সালের মধ্যেই চালু হবে। এ অবস্থায় জরুরি ভিত্তিতে বাঁশখালীর বিদ্যমান সড়কটির সংস্কার এবং একে চার লাইনে উন্নিতকরণ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
সরকার কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের কারণে বাঁশখালী উপজেলা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে দিন দিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ এস আলম গ্রুপ বাঁশখালীর গন্ডামারায় নির্মাণ করছে ১৩২০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎপ্রকল্প। এই বিদ্যুৎ প্রকল্পের নির্মাণ কাজ খুব দ্রুত এগিয়ে চলছে এবং ২০২৩ সালে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করবে বলে আশা করা যাচ্ছে। এছাড়া এই শিল্প গ্রুপটি বিদ্যুৎকেন্দ্র এলাকায় একটি বৃহত অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যা এখন প্রক্রিয়াধীন। আগামীতে এই অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপিত হলে এখানে বিদেশি বিনিয়োগে অনেক শিল্প কারখানা স্থাপিত হবে। এদিকে মহেশখালীর মাতারবাড়িতে সরকার নির্মাণ করছে ১৩২০ মেগাওয়াটের কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, যার নির্মাণ কাজও খুব দ্রুত এগিয়ে চলছে এবং আগামী ২০২৪ সালেই এটি বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করবে বলে আশা করা হচ্ছে। এছাড়া সরকার মহেশখালীর অদুরে বঙ্গোপসাগরে নির্মাণ করছে দেশের একমাত্র গভীর সমুদ্র বন্দর , যা হবে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিবর্তনের নায়ক। মহেশখালীতে আরো স্থাপিত হচ্ছে একাধিক অর্থনৈতিক অঞ্চল, যেখানে দেশি বিদেশি বিনিয়োগে অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে এবং ব্যাপক কর্মসংস্থান হবে। ইতোমধ্যে মহেশখালীতে এলএনজি টার্মিনাল স্থাপিত হয়েছে, যার মাধ্যমে বিদেশ হতে আমদানিকৃত এলএনজি খালাস হয়। আর মহেশখালীতে আগামীতে যে বিশাল অর্থনৈতিক কর্মকান্ড শুরু হতে যাচ্ছে, তার জন্য চট্টগ্রাম শহরের সাথে যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে বাঁশখালীর বিদ্যমান সড়কটিই হবে প্রধান অবলম্বন। সুতরাং এতদাঞ্চলের যাতায়াতকে নিরবিচ্ছিন্ন করে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে গতিশীল করার জন্য বাঁশখালীর সড়কটিকে চার লাইনে উন্নিতকরণের কোনো বিকল্প নেই।
লেখক: প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক ।
omar_ctg123@yahoo.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন