দেশ এখন ভয়াবহ বন্যার কবলে। প্রবল বর্ষণ ও ভারত থেকে আসা পাহাড়ি ঢল বন্যার কারণ। বলা হচ্ছে, সিলেট-সুনামগঞ্জে এমন বন্যা শত বছরেও দেখা যায়নি। উত্তরাঞ্চলীয় জেলাগুলো একের পর তলিয়ে যাচ্ছে। মধ্যাঞ্চলীয় জেলাগুলোও বন্যা থেকে খুব দূরে নেই। বর্ষার শুরুতে সর্বগ্রাসী বন্যার এমন তাণ্ডব বিরল। মাসখানেক আগে সিলেট-সুনামগঞ্জ ও উত্তরাঞ্চলীয় কয়েকটি জেলা আকস্মিক বন্যার শিকার হয়। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। তার জের থাকতে থাকতেই দ্বিতীয় দফা বন্যা দেখা দিয়েছে। কল্পনাকেও হার মানিয়ে দ্রুত বন্যা ছড়িয়ে পড়ায় মানবিক বিপর্যয় চরম আকার ধারণ করেছে। লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তাদের উদ্ধার করে আশ্রয় শিবিরে আনা এবং প্রয়োজনীয় খাদ্য, পানি, ওষুধপত্র ও অন্যান্য জরুরি সমগ্রী দেয়া কঠিন, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে অসম্ভব হয়ে পড়েছে। অনেক জায়গায় ত্রাণসামগ্রী পৌঁছানো যাচ্ছে না। বন্যাকবলিত অসংখ্য মানুষ দিনের পর দিন না খেয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। মানুষের অসহায়ত্ব ও বিষণ্নতার এমন নজির দেখা যায় না। সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা উদ্ধার কাজে নিয়োজিত হয়েছেন। দুর্গত এলাকায় ত্রাণ দেয়ার কাজও তারা করছেন। মূলত প্রশাসনই ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ত্রাণ প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। সেকারণে সর্বত্রই ত্রাণের জন্য হাহাকার চলছে। লোকবল, সম্পদসামর্থ্য এবং ব্যবস্থাপনাগত দক্ষতা এ মুর্হূতে সবচেয়ে বেশি দরকার। অতীতে যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ-বিপর্যয়ে রাজনৈতিক দল, বেসরকারি সংস্থা, স্বেচ্ছসেবী সংগঠন, সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী প্রভৃতি উদ্ধার ও ত্রাণকার্যক্রমে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিতো। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এদের অংশগ্রহণ তেমন একটা দেখা যায় না। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বিশেষ করে বন্যা মোকাবিলা করা সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে সমর্থ্যবান ব্যক্তি থেকে শুরু করে রাজনৈতিক দল, সংস্থা, সংগঠন ও গোষ্ঠীর এগিয়ে আসা আবশ্যকই শুধু নয়, জরুরিও বটে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সবাইকে আশ্বস্ত করে বলেছেন, বন্যা মোকাবিলায় সরকারের সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। জানা গেছে, তিনি সর্বক্ষণ বন্যা পরিস্থিতি মনিটর করছেন এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিচ্ছেন। আজ তিনি বন্যাকবলিত সিলেট ও সুনামগঞ্জ পরিদর্শনে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যেই জানানো হয়েছে, সরকারি দল ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের তিনি দুর্গত-উদ্ধারে ও ত্রাণকাজে নিয়োজিত হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। ওদিকে বিএনপির তরফে সকল রাজনৈতিক কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছে এবং দলীয় নেতাকর্মীদের বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অন্যান্য রাজনৈতিক দলও দুর্গতত্রাণে এগিয়ে আসতে শুরু করেছে। ইসলামী দল ও সংগঠনগুলোও এর মধ্যে রয়েছে। বলা বাহুল্য, মানুষের বিপদ ও দুর্গতি মোচনে শ্রম ও অর্থ-সম্পদ ব্যয় করার চেয়ে উত্তম কোনো কাজ নেই। এবাদত হিসেবে এর মূল্য অপরিসীম। দেশব্যাপী বন্যা মানে দেশব্যাপী দুর্বিপাক। এ ধরনের জাতীয় দুর্যোগ জাতীয়ভাবেই মোকাবিলা করতে হবে। দল-মত নির্বিশেষে সবাইকে সাহায্য-সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, সাংস্কৃতিক অঙ্গনের, বিশেষত চলচিত্রশিল্পীদের অনেকে বন্যার্তদের সাহায্য-সহায়তায় এগিয়ে এসেছেন। এদের মধ্যে মনোয়ার হোসেন ডিপজল ও অনন্ত জলিলের কথা উল্লেখ করা যায়। তারা দুর্গত এলাকায় ত্রাণসামগ্রী পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছেন। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হানিফ সংকেতও ত্রাণসামগ্রী পাঠানোর প্রস্তুতি নিয়েছেন। তিনি অন্যদেরও ত্রাণসহায়তা দেয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। অনন্ত জলিল আসন্ন ঈদে কোরবানির সংখ্যা কমিয়ে সেই অর্থ এবং এর সঙ্গে অন্যান্য অর্থ যোগ করে বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানোর কথা বলেছেন। প্রসঙ্গত তিনি বলেছেন, আমাদের যাদের অর্থকড়ি আছে, তারা কেউ তা কবরে নিয়ে যেতে পারবো না। কাজেই, সে অর্থ মানুষের কাজে খরচ করতে হবে। মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। তার এ চিন্তা ও বক্তব্য অত্যন্ত সঠিক ও অনুপ্রেরণাদায়ক। যারা সামর্থ্যবান, বিত্তশালী, ধনী তারা যদি সবাই এভাবে চিন্তা করেন এবং বন্যা দুর্গতদের কল্যাণে হাত বাড়িয়ে দেন তবে জাতীয় এই দুর্যোগ মোকাবিলা সহজ হবে। মানুষের দুঃখ-কষ্ট লাঘব হবে। কোটিপতির সংখ্যা আমাদের দেশে কম নয়। প্রতিবছর তাদের সংখ্যা বাড়ছে। অথচ, জনকল্যাণ ও মানুষের দুঃখ-দুর্ভোগ মোচনে তাদের এগিয়ে আসতে কমই দেখা যায়। তাদের এই মনোবৃত্তির পরিবর্তন হওয়া কি আবশ্যক না?
ত্রাণকর্মে প্রশাসনের ভূমিকা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য। অথচ, প্রতিটি দুর্যোগে, প্রতিটি ত্রাণকর্ম পরিচালনায় নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি, অসঙ্গতি ও অনিয়মের অভিযোগ শোনা যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ত্রাণে কোনো সুষমতা থাকে না। কেউ বেশি পায়, কেউ কম পায়, কেউ পায়ই না। সরকারি দলের হস্তক্ষেপের অভিযোগ তো অতি পুরোনো। ত্রাণের টাকা, চাল, গম কীভাবে সরকারি দলের লোকেরা লোপাট বা আত্মসাৎ করে, সেটা আমাদের কারো অজানা নেই। করোনাকালে সরকারের দেয়া সহায়তা লুট করার রীতিমত উৎসব হয়ে গেছে। ২০ লাখ টাকা বিতরণের জন্য ১০ লাখ টাকা খরচের অভিযোগও পাওয়া গেছে। এবার যেন ত্রাণ বিতরণে দুর্নীতি, অপারগতা ও ব্যর্থতা না ঘটে, সরকারি দলের লোকরা যেন তা না খেয়ে ফেলে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। সব ত্রাণ-প্রচেষ্টাকে সমন্বিত করে জাতীয় পর্যায়ে ও কর্তৃত্বে ত্রাণকার্যক্রম পরিচালনা করা হলে দুর্নীতি-দুষ্কৃতি যেমন কম হতে পারে, তেমনি দুর্গত মানুষের অধিকতর কল্যাণ হতে পারে। বিষয়টি সদয় সক্রিয় বিবেচনার দাবি রাখে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন