দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে, নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয় না, নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের নমিনেশন পাওয়া মানেই বিজয় নিশ্চিত, নির্বাচনে সাধারণ মানুষের আগ্রহ নেই, এমনকি ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক ও নেতা-কর্মীরাও অনেক সময় বিজয় নিশ্চিত জেনে ভোট দিতে যায় নাÑ এমন অভিযোগ বিগত এক দশকের বেশি সময় ধরে প্রচলিত। বিরোধীদলগুলো তো বটেই নির্বাচন বিশেষজ্ঞরাও এ নিয়ে অনেক কথা বলেছেন এবং বলছেন। তবে নির্বাচন কীভাবে সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক করা যায়, এ প্রক্রিয়ার কথা প্রায়ই বলা হয়ে থাকে। সচেতন মহলের অনেকেই বছরের পর বছর ধরে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করার কথা বলছেন। তারা নির্দলীয় সরকারের অধীন ছাড়া নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয় বলে মতামত দিচ্ছেন। এর অর্থ হচ্ছে, বিগত এক যুগ ধরে জাতীয় ও স্থানীয় যেসব নির্বাচন হয়েছে, তা সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হয়নি। যদি হতো, তাহলে এ ধরনের কথাবার্তা, আলোচনা এবং সভা-সেমিনারের প্রয়োজন হতো না। বৃহত্তম বিরোধীদল বিএনপি তো ক্ষমতাসীন দলের অধীনে আগামী জাতীয় নির্বাচনে যাবে না বলে ঘোষণাই করেছে। শুধু জাতীয় নির্বাচন নয়, স্থানীয় কোনো নির্বাচনেই যাবে না। বিগত কয়েকটি স্থানীয় নির্বাচনে দলটি অংশগ্রহণ করেনি। সদ্য সমাপ্ত কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনেও অংশগ্রহণ করেনি। দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে মনিরুল হক সাক্কু ও নিজামউদ্দিন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করায় তাদের দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এ হিসেবে বিএনপি এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। তবে অংশগ্রহণ না করলেও বিএনপি’র নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা যে ভোট দেয়নি তা নয়, দিয়েছে। না দিলে সাক্কু মাত্র ৩৪৩ ভোটে হারতেন না, আর নিজাম ২৯ হাজার ৯৯ ভোট পেতেন না। অনেকে বলেন, যদি এই দুইজনের মধ্যে একজন প্রার্থী হতেন, তাহলে বিপুল ভোটে বিজয়ী হতেন। কারণ, দুজনের প্রাপ্ত ভোট নির্বাচিত মেয়র আরফানুল হকের চেয়ে প্রায় ৩০ হাজার বেশি। আবার আরফানুল হকের বিজয়ের পেছনে স্থানীয় সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিনের মুখ্য ভূমিকা ছিল বলে কুমিল্লাবাসী মনে করে। নির্বাচন কমিশন তাকে নির্বাচনী এলাকা ত্যাগ করতে বললেও তিনি তা ‘থোড়াই কেয়ার’ করে থেকে যান। নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণার একেবারে শেষ মুহূর্তে তিনি গিয়ে হাজির হন। এর প্রভাবে ফলাফল উল্টে গেছে বলে অনেকে মনে করছেন। কারণ, সাক্কু শুরু থেকেই এগিয়ে ছিলেন। কৌতূহলবশত একটি টেলিভিশনের ফলাফল স্ক্রলে দৃষ্টি রেখেছিলাম। সেখানে দেখেছি, ঘোষিত ১০৫ কেন্দ্রের ৫৩ আসনের ফলাফলে সাক্কু এগিয়ে। তবে ঘণ্টাখানেক পার হওয়ার পরও স্ক্রলের ফলাফল স্থিরই থেকে যায়। নতুন কোনো কেন্দ্রের ফলাফল যুক্ত হয়নি। অথচ, কিছুক্ষণ পরপর ফলাফল আসার কথা। আর ইভিএমের ফলাফল তো আরও দ্রুত হওয়ার কথা। তা হয়নি। তখনই কেমন যেন একটু খটকা লেগেছিল।
দুই.
কেউ কেউ বলেন, বিএনপি এ নির্বাচনে গেলে হয়তো জিতে যেত। বিএনপি যেহেতু দলীয়ভাবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ক্ষমতাসীন দলের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না, সেহেতু তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেয়া হয়, সে অংশগ্রহণ করেছে, তখন কি ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর সাথে ফলাফলের এই পার্থক্য থাকত? থাকত না। বরং বিএনপি’র প্রার্থীকে আরও বড় ব্যবধানের হার দেখিয়ে হয়তো বলত, দলটির জনসমর্থন নেই। বিএনপি যখন, এরকম আরও অনেক স্থানীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল, তখন তার নজির দেখা গেছে। দলটির অনেক প্রার্থী তৃতীয়-চতুর্থ হয়েছে। কোনো কোনো জায়গায় জামানতও হারিয়েছে। এর মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দল দেখিয়েছে, তৃণমূলে বিএনপি’র জনসমর্থন তলানিতে। তবে এ ধারণা যে সঠিক নয়, তা বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত দুই প্রার্থীর কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনী ফলাফল থেকে কিছুটা হলেও বোঝা যায়। বলা যায়, ক্ষমতাসীন দলের এমপি’র আধিপত্য এবং শেষ মুহূর্তে ফলাফল ঘোষণার নাটকীয়তা সত্ত্বেও বিএনপি’র ছায়ায় থাকা প্রার্থীর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে গিয়ে ক্ষমতাসীন প্রার্থীর ঘাম ছুটেছে। ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী নানা প্রভাবে বিজয়ী হলেও, বড় ধরনের একটা ঝাকুনি যে লেগেছে, তাতে সন্দেহ নেই। ক্ষমতাসীনরা যে হারতে চায় না এবং যেকোনো মূল্যে জিততে চায়, নির্বাচনে প্রভাব-প্রতিপত্তি খাটানোর মাধ্যমে এ মনোভাব বহুবার প্রকাশিত হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় পর্যায়ের মোটামুটি একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে যদি তার পরাজয় হতো, তাহলে তার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ত। মনোবলেও চিড় ধরত। এমন পরিস্থিতি দেখা গিয়েছিল, ২০১৩ সালের নির্বাচনের আগে যখন চারটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে বিএনপি’র প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছিল। সে বিজয় এমনই ছিল যে, জনমনে এমন একটা ধারণা হয়েছিল, বিএনপি ক্ষমতায় আসছে। এ ধারণাই বিএনপি’র জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অন্যদিকে, ক্ষমতাসীন দলকে পরাজয়ের আতঙ্ক পেয়ে বসেছিল। জাতীয় নির্বাচনের আগে এমন ফেল এবং ক্ষমতা হারানোর ভয়েই হয়তো যেকোনো মূল্যে ৫ জানুয়ারি বিনাভোটের নির্বাচনটি সে করেছিল। এর পরে স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল কি হয়েছে, তা সকলেরই জানা। কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের পরের দিন একটি টেলিভিশনের টক শোতে দেখেছি, জাতীয় পার্টির এক প্রেসিডিয়াম সদস্য ক্ষমতাসীন দলের সাফাই গাইতে গিয়ে বলেছেন, সাক্কু যদি জিতে যেত, তাহলে বিএনপি তাকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নিত। কাজেই বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি, এটা বলা ঠিক না। তার এ কথার জবাবে বলা যায়, বিএনপি তাকে ফিরিয়ে নিত কি নিত না, সেটা বড় কথা নয়, দলটি যে ক্ষমতাসীন দলের অধীনে নির্বাচনে যায়নি, এটাই তত্ত্বগত এবং দৃশ্যমান বাস্তবতা। উক্ত নেতা বহিষ্কৃতদের বিজয়ী হওয়া এবং তাদের পুনরায় দলে ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়টি নিয়ে বিএনপিকে অনেকটা তিরস্কার করেন। তিনি কি জানেন না, বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটি একটি অতি পুরনো সংস্কৃতি বা অপসংস্কৃতি? আওয়ামী লীগ কি বহিষ্কৃত কিংবা দলত্যাগী নেতাদের ফিরিয়ে নেয়নি? বিগত স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে আওয়ামী লীগের যেসব বিদ্রোহী নেতা পাস করেছে, তাদের কাউকে কি দলে ফিরায়নি? আর আমাদের রাজনীতির সংস্কৃতিই তো এই, কেউ দলত্যাগ করলে কিংবা বহিষ্কৃত হলে পুনরায় যখন তাকে দলে নেয়া হয়, তখন এ যুক্তি দেয়া হয়, ‘সে তার ভুল বুঝতে পেরেছে’ কিংবা ‘ঘরের ছেলে ঘরে ফিরেছে’। আর জাতীয় পার্টি তো কয়েক ভাগে ভাগ হয়ে আছে। তিনি যে অংশের প্রতিনিধিত্ব করেন, সেখানে নেতাই বা কয়জন, আর যাবেই বা কোথায়? তাদের যাওয়া কিংবা ফিরে আসা জাতীয় রাজনীতিতে কি খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু? বরং তার অংশের কেউ যদি যায়, তবে দল ভেঙ্গে ব্রেকেটবন্দী করে আরেকটি দল করবে। ফিরে আসবে না। এমন নজির তো দলটির রয়েছে। এখন কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে যদি সাক্কু বিজয়ী হতো, তাহলে তাকে ফিরিয়ে নেয়া হতো কিনা, তা অনিশ্চিত ছিল। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে মঞ্জুরুল আলম যখন বিএনপির নমিনেশন নিয়ে জিতেছিলেন, তখন তিনি দলের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন না। তিনি বিএনপি করতেন এবং সক্রিয় এমন কথাও খুব বেশি শোনা যায়নি। বিএনপি শুধু আওয়ামী লীগের বাইরে বিজয়ী হওয়ার মতো একজন প্রার্থীকে সমর্থন দিয়েছিল। পরবর্তীতে এই মঞ্জুরুল আলমই কিন্তু আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। যদিও তিনি একসময় আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথেই জড়িত ছিলেন। কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর এক নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, ইভিএমে ফলাফল পরিবর্তন করার সুযোগ নেই। প্রত্যেক কেন্দ্রে ফলাফল ঘোষণা করা হয় এবং তা তাদের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়। তারা শুধু কমপাইল বা যোগ করে ফলাফল ঘোষণা করেন। এখানে ফল পরিবর্তনের সুযোগ নেই। তার এ কথার সূত্র ধরে বলা যায়, মূল কেন্দ্রেই ফলাফল পরিবর্তনের বড় সুযোগ থাকে। সব কেন্দ্রের ফলাফল যোগ করে ঘোষণা করার যে কথা তিনি বলেছেন, সে যোগের ফলাফল পরিবর্তন সবচেয়ে সহজ। সব কেন্দ্রের ভোট সংখ্যা যে মূল কেন্দ্রে গিয়ে ঠিক থাকবে এ গ্যারান্টি কি দেয়া যায়? কিংবা যোগের ফলাফলের একটি-দুটি ডিজিট পরিবর্তন করা কি অসম্ভব? অসম্ভব নয়। এমন ঘটনা ঘটার কথা বিগত অনেক নির্বাচনে শোনা গেছে। ইচ্ছামতো যোগ-বিয়োগ করে ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সেগুলো যাচাই করার কোনো সুযোগ ছিল না। তাছাড়া ইভিএম একটি প্রোগ্রামড করা মেশিন। এতে যেভাবে প্রোগ্রাম করা হবে, সেভাবেই তা কাজ করবে। যে ভোটার যে মার্কায় ভোট দিতে চান, সে বাটনে টিপ দিলেও তা কেবল একটি মার্কায় গিয়েই পড়বে এমন প্রোগ্রামড করা অসম্ভব কিছু নয়। এমন অভিযোগ ইতোমধ্যে উঠেছে। তবে এসব কোনো কিছুই পরিবর্তন করা সম্ভব নয়, যদি ইভিএমের সঠিক প্রোগ্রাম, যোগ-বিয়োগ বা ফলাফল পরিবর্তন না করা এবং ঘোষণার ক্ষেত্রে যারা জড়িত তারা নিরপেক্ষ, নির্মোহ, স্বাধীন ও সৎ থাকেন।
তিন.
দেশ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বীতামূলক ও সুষ্ঠু নির্বাচনের সংস্কৃতি যে নির্বাসিত, তা অনেকেই স্বীকার করবেন। এখন কোনো নির্বাচনই সচেতন তো বটেই সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষকেও আকর্ষণ করে না। তাদের আগ্রহ নেই বললেই চলে। এমনকি নির্বাচন কমিশন কখন কোন আসন বা এলাকায় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে, তা নিয়েও কারো তেমন কোনো আগ্রহ পরিলক্ষিত হয় না। আলোচনাও হয় না। এমন ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, নির্বাচন মানেই নিশ্চিতভাবেই ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর বিজয়। প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে সেমসাইডে। ক্ষমতাসীন দল মনোনীত প্রার্থী ও দলের বিদ্রোহী প্রার্থীর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। ক্ষমতাসীন দলও তাই চায়। সে চায় না, বিরোধীদলের বিশেষ করে প্রধান বিরোধীদল অংশগ্রহণ করুক। তার স্পষ্ট বক্তব্য, বিরোধীদল নির্বাচনে না এলে তাদের কিছু করার নেই। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে কি করবে না, সেটা যার যার ইচ্ছা। কেউ না এলেও নির্বাচন হবে। ক্ষমতাসীন দলের এ ধরনের মনোভাব যেমন অগণতান্ত্রিক এবং সুষ্ঠু রাজনীতির অন্তরায়, তেমনি নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার সুপ্ত বাসনাও বটে। আর প্রধান বিরোধীদল যদি নির্বাচনে আসে, তাহলে তাকে কীভাবে ফেল করাতে হয়, তার ম্যাকানিজম তৈরি করা আছে। এখন ক্ষমতাসীন দলের জন্য কিছুটা চ্যালেঞ্জ হয়ে আছে, আগামী জাতীয় নির্বাচনে বিএনপিকে অংশগ্রহণ করানো। এর কারণ হচ্ছে, বিশ্ব রাজনীতি এখন অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। ভারত তার আভ্যন্তরীণ নানা সমস্যায় জর্জড়িত। এক চীনের চাপে কোনঠাসা অবস্থা। প্রতিবেশী নেপাল, ভুটানের মতো দেশও এখন তাকে খুব একটা পাত্তা দিচ্ছে না। উপমহাদেশ তো বটেই বিশ্বরাজনীতিতেও তার অবস্থান নাজুক হয়ে পড়েছে। ফলে তাকে এক কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। অন্যদিকে, পশ্চিমাবিশ্ব বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রও ইদানিং ঘন ঘন আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক করার তাকিদ দিচ্ছে। মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা, সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র সংকোচনের বিষয়গুলো নিয়েও নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশ ও কথা বলছে। বিএনপিসহ বিরোধীদলগুলো নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জোরালো করে তুলছে। ফলে ক্ষমতাসীন দল বেশ চাপের মুখে আছে। আগের মতো একতরফা বা ম্যাকানিজম করে নির্বাচনী বৈতরণী পার বা ক্ষমতায় থাকা তার জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও সে এখন পর্যন্ত সংবিধানের বাইরে গিয়ে নির্বাচন করতে নারাজ। এর কারণ হচ্ছে, সে আদালতের রায়ের উছিলা দিয়ে এবং একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে তার সুবিধামতো সংবিধান পরিবর্তন করে নিয়েছে, যাতে সংবিধানের অজুহাত দেখিয়ে নিজের অধীনেই নির্বাচন করতে পারে। অথচ, সংবিধান কোনো অপরিবর্তনীয় কিছু নয়। এ পর্যন্ত ১৬ বার পরিবর্তন করা হয়েছে। এই সংবিধান পরিবর্তন করেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ’৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন বিএনপি করেছিল শুধু সংবিধান পরিবর্তন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি অন্তর্ভুক্ত করতে, তা করেছিলও। বিএনপি যদি সে সময় সংবিধানের দোহাই দিয়ে ক্ষমতায় থেকে যেত এবং বিরোধীদলকে বর্তমান সরকারের মতো কঠোর হস্তে দমন-নিপীড়ন, নির্যাতন, জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনের জন্য মামলা-মোকদ্দমার পন্থা অবলম্বন করত, মাঠে নামতে না দিত, তাহলে কি কিছু করার থাকত? আওয়ামী লীগ বলতে পারে, সে সময় তারা গণআন্দোলন গড়ে তুলেছিল। তার এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, সে সময় বিএনপি যদি সংবিধানের দোহাই দিয়ে পুরো প্রশাসন যন্ত্র ব্যবহার করে ২০১৩ সালে তারা যেভাবে দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দিয়ে, গ্রেফতার করে আন্দোলন দমন করেছিল, তেমন করত, তাহলে কি তারা টিকতে পারত?
চার.
দেশে এখন প্রাকৃতিক ও রাজনৈতিকভাবে এক অস্থির পরিবেশ বিরাজমান। সিলেট বিভিাগের ৮০ শতাংশ এলাকা ডুবে গেছে। স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলাও বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। লাখ লাখ মানুষ বান্যার পানিতে ভাসছে। এর মধ্যেই পদ্মাসেতু উদ্বোধন নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের ব্যাপক তোড়জোড় চলছে। আনন্দ মিছিল হয়েছে। এ এক বিপরীতধর্মী চিত্র। অবশ্য পদ্মাসেতু উদ্বোধনের আয়োজন আগেই শুরু হয়েছিল। এর মধ্যে হঠাৎ বন্যা শুরু হয়েছে। তাতে পদ্মাসেতু উদ্বোধনে বিশেষ কোনো পরিবর্তন হবে না বলে মনে হচ্ছে। তবে আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বছরের শুরু থেকেই রাজনৈতিক অঙ্গনে এক ধরনের অস্বস্তি সৃষ্টি হয়েছে। ক্ষমতাসীন জোট বাদে বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধীদলগুলো আগামী নির্বাচন নির্দলীয় সরকারের অধীনে করার দাবিতে একমত হয়েছে। তাদের এ দাবি না মানলে গণআন্দোলন গড়ে তোলার কথা বলছে। ইতোমধ্যে দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক মতবিনিময়ের মাধ্যমে এ দাবিতে ঐকমত্য সৃষ্টি হয়েছে। সুশীল সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী বিভিন্ন সংগঠনও আগামী জাতীয় নির্বাচন নির্দলীয় সরকারের অধীনে করার কথা বলছে। সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেখে বোঝা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীন দল ও জোট এবং বিরোধীদলগুলো মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। এ মুখোমুখি অবস্থান, নির্দলীয় সরকারের অধীনে ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচন না করা এবং বিরোধীদলগুলোর এ দাবি আদায়ে একাট্টা হওয়া। ক্ষমতাসীন দল বিরোধীদলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে নতুন করে ‘ষড়যন্ত্র’ তত্ত্ব হাজির করেছে। বিরোধীদলও বলছে, কে বা কারা ষড়যন্ত্র করছে তা প্রকাশ করা হোক। এ প্রেক্ষিতে, নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসবে রাজনৈতিক পরিস্থিতিও ততই উত্তপ্ত হয়ে উঠবে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। এ কথা অস্বীকার কারার উপায় নেই, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়। এটা কেবলমাত্র সম্ভব একটি নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই।
darpan.journalist@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন