রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

সক্ষমতার প্রতীক পদ্মাসেতুু

সরদার সিরাজ | প্রকাশের সময় : ২৫ জুন, ২০২২, ১২:০১ এএম

নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত পদ্মা বহুমুখী সেতুর আজ শুভ উদ্বোধন। এই সেতু নির্মাণের ফলে দেশের অবহেলিত ও দারিদ্রপীড়িত দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজতর হয়েছে। ফলে ওই অঞ্চলের উন্নতির নব দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। মানুষ ও পণ্য চলাচলের ব্যাপক সুবিধা হয়েছে। আর লাইন ধরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেরির জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। ফেরি পার হতে কয়েক ঘণ্টা লাগবে না। এখন ৬ মিনিটেই পার হওয়া যাবে পদ্মা। এডিবির সমীক্ষা রিপোর্ট মতে, ২০২২ সালে পদ্মাসেতু দিয়ে প্রতিদিন যানবাহন চলাচল করবে প্রায় ২৪ হাজার। সংখ্যাটি প্রতিবছর বৃদ্ধি পেয়ে ২০৫০ সালে দাঁড়াবে প্রায় ৬৭ হাজার। এতে ২১ জেলায় যেতে বাসের ক্ষেত্রে গড়ে দুই ঘণ্টা এবং ট্রাকের ক্ষেত্রে ১০ ঘণ্টা সময় সাশ্রয় হবে। জাইকার সমীক্ষা অনুসারে, পদ্মাসেতুতে ইকোনমিক রেট অব রিটার্ন হবে বছরে ১৮-২২%, যা পরবর্তী সময়ে বাড়তে পারে।

তথ্য মতে, বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বাধিক খরস্রোতা নদী পদ্মা (প্রথমটি আমাজন নদী)। তাতে সেতু নির্মাণের ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজতর হওয়ায় সমগ্র অঞ্চলে ব্যাপক উন্নয়ন হবে। ইতোমধ্যেই সংশ্লিষ্ট এলাকায় শিল্প-কারখানা, ব্যাংক, বীমা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সেতুর দুইপাশে গড়ে তোলা হবে অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্ক। তাতে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে বছরে দুই লাখ মানুষের নতুন করে কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে। আর দশ বছর পর এ সংখ্যা তিনগুণ হবে বলে এক গবেষণা রিপোর্টে বলা হয়েছে। অপরদিকে, পদ্মাসেতুর কারণে মংলা বন্দর, পায়রা বন্দর ও চট্টগ্রাম বন্দরেরও পণ্য আনা-নেওয়া সহজতর হবে, যার প্রভাব পড়বে সমগ্র দেশের উন্নতিতে। ফলে মোট জিডিপির পরিমাণ ১.২৩% বাড়বে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। অন্যদিকে, পদ্মাসেতুর কারণে ভারতেরও, বিশেষ করে পশ্চিম বাংলার মানুষের বিশেষ সুবিধা হবে বলে আনন্দবাজারে প্রকাশ। উক্ত খবরে বলা হয়েছে, কলকাতা থেকে ঢাকার দূরত্ব দেড়শ’ কিলোমিটার কমছে! আগে কলকাতা থেকে ঢাকায় পৌঁছতে ৪০০ কিলোমিটার রাস্তা পেরোতে হতো। জুন মাসের শেষদিকে ২৫০ কিলোমিটার গেলেই চলবে। তাতে সময় লাগবে বড়জোর ৬-৬.৫ ঘণ্টা। এখন কলকাতা-ঢাকা মৈত্রী এক্সপ্রেস কলকাতা স্টেশন থেকে নদীয়া পেরিয়ে যায় গেদে। সেখান থেকে বাংলাদেশের সীমান্ত স্টেশন দর্শনা পার করে ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে পৌঁছায় ১০ ঘণ্টায়। আর পদ্মাসেতুর রেললাইন ধরে ঢাকা পৌঁছাতে হলে কলকাতা থেকে বনগাঁ জংশন হয়ে হরিদাসপুর সীমান্ত দিয়ে বেনিয়াপোল, যশোর, নড়াইল, ফরিদপুরের ভাঙ্গা হয়ে শুধু ২৫১ কিলোমিটার পথ যেতে হবে।

অবশ্য পদ্মাসেতু নির্মাণের সঙ্গে অনেক মর্মবেদনা ও দুঃখ কাহিনী জড়িয়ে আছে। দেশের প্রখ্যাত লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ গত ৮ জুন এক নিবন্ধে জানিয়েছেন, পদ্মাসেতুর প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শুরু হয় ১৯৯৯ সালে, আওয়ামী লীগ তখন ক্ষমতায়। ২০০১ সালের ৪ জুলাই সেতুটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শুরু হয় ২০০৩ সালে বিএনপির আমলে। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকার এটি হাতে নেয়। বিএনপির এমপি ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা গত ২ জুন এক নিবন্ধে বলেছেন, ‘পদ্মা বহুমুখী সেতুর’ নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল ২০১১ সালে। শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৩ সালে। মূল প্রকল্পের পরিকল্পনা করে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৭ সালের ২৮ আগস্ট। সে সময় ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকার বহুল আলোচিত পদ্মাসেতু প্রকল্প পাস করা হয়।’ অবশ্য, এ সময় শুধুমাত্র সড়কসেতু নির্মাণের নকশা অনুমোদন করা হয়েছিল। পরবর্তীতে শেখ হাসিনার সরকার এই নকশা পরিবর্তন করে রেল, সড়ক, গ্যাস, পানি, নদী শাসন, অ্যাপ্রোচ রোড ইত্যাদি সম্বলিত পরিকল্পনা গ্রহণ করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর, ড. আতিউর রহমান গত ৬ জুন এক নিবন্ধে লিখেছেন, ‘২০০১ সালের ৪ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে মাওয়া ফেরিঘাটের কাছেই পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু সেতুটির নির্মাণকাজ থমকে যায় রাজনৈতিক হীনম্মন্যতার কারণে। ২০০৯ সালে ফের ক্ষমতায় ফিরে এসে তিনি পদ্মাসেতু নির্মাণকে অগ্রাধিকার তালিকায় নিয়ে আসেন। শুরুতে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাইকা, আইডিবি এই সেতুর অর্থায়নের অংশীদার হয়। পরবর্তী পর্যায়ে প্রস্তাবিত ১.২ বিলিয়ন ডলারের এই প্রকল্পের অর্থায়নে বিশ্বব্যাংক যুক্ত হয়। কিন্তু অযথাই একটি নোংরা বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল মনগড়া দুর্নীতির অভিযোগ তুলে। বেলা শেষে সেই অভিযোগ কানাডার আদালতসহ কোথাও টেকেনি।’ অর্থাৎ নির্মাণ কাজের তদারকির পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ কানাডিয়ান আদালতে প্রমাণিত হয়নি। কিন্তু ততদিনে বিশ্ব ব্যাংক উক্ত প্রকল্প থেকে সরে যায়। তার দেখাদেখি অন্য সংস্থাগুলোও সরে যায়! এর জেরে তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনসহ কয়েকজন আমলা পদত্যাগ করেন। এর পর এ প্রকল্পে যুক্ত হওয়ার প্রস্তাব দেয় মালয়েশিয়ার সরকার। এ নিয়ে কিছুদিন আলোচনা চলার পর তা আর এগোয়নি। এরূপ পরিস্থিতিতে পদ্মাসেতু নির্মাণ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এমনি দুর্দিনে চরম সাহসী ভূমিকা পালন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি নিজস্ব অর্থেই এই সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এ ব্যাপারে অনেক বিশেষজ্ঞ পর্যন্ত সফলতা নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। তথাপিও তিনি অসীম সাহস ও বিচক্ষণতার সাথে সামনের দিকে অগ্রসর হন। কাজ শুরু করেন ২০১৪ সালের ডিসেম্বর। তাতে দেশবাসী পূর্ণভাবে সমর্থন জানায়। ফলে সেতুটির নির্মাণ কাজ সফলভাবে শেষ হয়ে আজ উদ্বোধন হচ্ছে। তাই প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য যথার্থ। তিনি বলেছেন, ‘দেশবাসীর অভূতপূর্ব সাড়া না পেলে পদ্মাসেতু হতো না।’ যা’হোক, পদ্মাসেতু নির্মাণ করেছে চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি) ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করেছে কোরিয়া এক্সপ্রেস কর্পোরেশন (কেইসি) এবং তদারকি ও নিরাপত্তা দেখা-শুনা করেছে দেশের সেনাবাহিনী।

পদ্মাসেতুর (মূল সেতু) দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিলোমিটার ও প্রস্থ ১৮.১০ মিটার। দুই প্রান্তের উড়াল পথ (ভায়াডাক্ট) ৩.৬৮ কিলোমিটার। সব মিলিয়ে সেতুর দৈর্ঘ্য ৯.৮৩ কিলোমিটার। পদ্মাসেতুটি দোতলা। এর একতলায় চলবে ট্রেন। সামান্য উপরে চার লেনের চওড়া রাস্তায় চলবে সব রকম গাড়ি। রেল ব্রিজ থেকে পানির দূরত্ব থাকবে অন্তত ১৮ মিটারের। পানির স্তর বাড়লেও ব্রিজের তলা দিয়ে পাঁচতলা সমান জাহাজের যাতায়াতে অসুবিধা হবে না। এই সেতুতে রয়েছে ৪১টি পিলার । প্রত্যেকটিই তৈরি হয়েছে মজবুত পাইল ইস্পাত দিয়ে। পানির নিচে ১২২ মিটার পর্যন্ত গভীরে গেছে এ পিলারের ভিত। উপরন্তু পদ্মাসেতুর ভূমিকম্প প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা ‘ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিং’ প্রায় ১০ হাজার টন, যা রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পেও অনায়াসে টিকে যাবে।

উদ্বোধনের পরের দিন সকাল থেকে যান চলাচল শুরু হলেও রেল পথ চালু হবে না। এটা শেষ হতে আরও সময় লাগবে। এই সেতুর উপর দিয়ে রেল পথ নির্মাণ হবে ঢাকা-যশোর পর্যন্ত (১৭২ কিমি)। তাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২১ হাজার ৩৬ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে এক্সিম ব্যাংক অব চায়না। বাকি টাকা দেশের। আগামী বছরে ঢাকা-ভাঙ্গা পর্যন্ত রেল পথ চালু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই রেল লাইন স্থাপন শেষ হলে সমগ্র দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের নেট ওয়ার্কের আওতায় চলে আসবে।

শত বাধা-বিপত্তি মোকাবেলা করে নিজস্ব অর্থে দেশের বৃহৎ, ব্যয়বহুল ও বহুমুখী পদ্মাসেতু নির্মাণ করায় দেশ ও জাতির মান-মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে। সেতুটি গৌরবের ও সক্ষমতার প্রতীকে পরিণত হয়েছে। জাতির মধ্যে এ আশা সঞ্চারিত হয়েছে যে, আমরা উদ্যোগ নিলে, আন্তরিক হলে ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করলে যে কোনো বড় ও কঠিন কাজ করতে সক্ষম।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
sardarsiraj1955@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন