আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বাংলাদেশের পানি সম্পদমন্ত্রী, না ভারতের? এ প্রশ্ন উঠেছে জাতীয় সংসদে দেয়া তার একটি বক্তব্যের প্রেক্ষিতে। সংসদে আফম বাহাউদ্দীন নাসিমের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, ফারাক্কায় গঙ্গার পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশ বেশি পানি পায়। এরপর তিনি পানিচুক্তি অনুযায়ী পানি বাটোয়ার বিষয় উল্লেখ করেছেন। ফারাক্কা পয়েন্টে কি পরিমাণ পানি এলে বাংলাদেশ তার কতটা পাবে, ভারত পাবে কতটা, চুক্তিতেই তা নির্ধারণ করে দেয়া আছে। এটা সবাই জানে এবং এর উল্লেখ করার কোনো প্রয়োজন নেই। আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ‘ফারাক্কায় গঙ্গার পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশ বেশি পানি পায়’, এই বক্তব্য প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই পানি বাটোয়ার বিষয়টি তুলে ধরেছেন। তিনি আসলে সত্য গোপন করেছেন এবং ভারতের পানিসম্পদমন্ত্রীর পক্ষে যা বলা সম্ভবপর তাই তাই বলেছেন, যদিও ভারতের পানিসম্পদমন্ত্রীর মুখে এ ধরনের কথা আমরা শুনিনি। পানিচুক্তির পর থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ চুক্তি অনুযায়ী পানি পেয়েছে এমন নজির বিরল। চলতি বছরও পানি কম পেয়েছে। একথা বলার সৎ সাহস পানিসম্পদমন্ত্রী দেখাতে পারেননি। নিজ দেশ ও জাতির পক্ষে না দাঁড়িয়ে তিনি যা বলেছেন তাতে ভারতকে সন্তুষ্ট করার প্রবণতা স্পষ্ট হয়েছে। এর চেয়ে ‘মেরুদ-হীনতা’ ও ‘নতজানুতা’ আর কিছু হতে পারে না। আমাদের জানা মতে, ভারতও কখনো এ দাবি করেনি যে, ফারাক্কা পয়েন্টে বেশি পানি আসার সুবাদে বাংলাদেশ বেশি পানি পেয়েছে। কারণ, ওই পয়েন্টে বেশি পানি আসার মতো বাস্তবতা বিদ্যমান নেই। বাংলাদেশের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সূত্র মতে, ফারাক্কা পয়েন্টে পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ার প্রধান কারণ, ফারাক্কার উজানে ছোটবড় তিন শতাধিক খাল কেটে ভারত পানি সরিয়ে নিচ্ছে। এতে ফারাক্কা পয়েন্টে শুষ্ক মওসুমে যে পরিমাণ পানি আসার কথা, তার চেয়ে অনেক কম পানি আসছে। ফলে বাংলাদেশও কম পানি পাচ্ছে। যেখানে পানি বেশি আসারই সুযোগ নেই, সেখানে বাংলাদেশ বেশি পানি পায়, একথা বলার কোনো অবকাশ থাকে না।
পানি চুক্তির পর উভয় দেশ কি পরিমাণ পানি পাচ্ছে তা পর্যবেক্ষণের জন্য একটি কারিগরি কমিটি আছে। দু’দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত এই কমিটি প্রতি বছর শুষ্ক মওসুমে বাংলাদেশের হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে ও ভারতের ফারাক্কা পয়েন্টে সরজিমনে পানির প্রাপ্রতা পর্যবেক্ষণ করে। এই কমিটির সদস্যরা সম্প্রতি হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পরিদর্শন করেছেন। পর্যবেক্ষণ শেষে ঢাকায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে বাংলাদেশের তরফে জানানো হয়েছে, চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের সর্বনিম্ন ৩৫ হাজার কিউসেক পানি পাওয়ার কথা থাকলেও বাংলাদেশ প্রায় ১০ হাজার কিউসেক পানি কম পেয়েছে। আর চুক্তির ইন্ডিকেটিভ সিডিউল অনুযায়ী কম পেয়েছে প্রায় ৭৮ হাজার কিউসেক। বাংলাদেশের এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে ভারতীয় প্রতিনিধি দলের তরফে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ যাতে সর্বনিম্ন ৩৫ হাজার কিউসেক পানি পায় সেটি তারা দেখবে। প্রতিনিধি দল আরও বলেছে, উজানে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় ফারাক্কা পয়েন্টে পানি অনেক কমে গেছে। যে পরিমাণ পানি জমছে, তাই দু’দেশ ভাগাভাগি করে নিচ্ছে। লক্ষ্যনীয়, ভারতীয় প্রতিনিধি দল কিন্তু বলেনি ফারাক্কা পয়েন্টে বেশি পানি আসছে এবং বাংলাদেশ বেশি পানি পাচ্ছে। অথচ আমাদের পানিসম্পদমন্ত্রীর কথা থেকে মনে হয়, চুক্তি মোতাবেক কিংবা ফারাক্কা পয়েন্টে পানি বেশি আসা সাপেক্ষ বাংলাদেশ বেশি পানি পাচ্ছে। এ ধরনের কথা বলা বা ধারণা দেয়া বিভ্রান্তিকর ও জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করার শামিল।
দু’দেশের দু’পয়েন্টে পানিপ্রবাহ বা পানির প্রাপ্যতা পর্যবেক্ষণের জন্য কারিগরি কমিটি গঠিত হলেও এ কমিটির আসলে করার কিছুই নেই। যা কিছু করার করতে পারে যৌথনদী কমিশন। যৌথনদী কমিশনও কিছু করতে চাইলে প্রয়োজন হয় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও সদিচ্ছার। দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, ২০১০ সালের পরে যৌথনদী কমিশনের কোনো বৈঠক হয়নি। ভারতের অনীহা ও বিভিন্ন অজুহাতের কারণে বৈঠক হতে পারছে না। কবে হবে, বলার উপায় নেই। বাংলাদেশ যৌথনদী কমিশনের বৈঠকের ব্যাপারে বারবার তাগাদা দিলেও ভারত তাতে সাড়া দিচ্ছে না। ফলে বাংলাদেশের পানিবঞ্চনার ধারা অব্যাহত রয়েছে। ৩০ সালা পানি চুক্তিটি অসম। চুক্তিতে ভারতের পানিপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা হলেও বাংলাদেশের পানিপ্রাপ্তির কোনো নিশ্চয়তা নেই। ফারাক্কা পয়েন্টে প্রাপ্ত পানি বণ্টনের কথা চুক্তিতে থাকলেও ফারাক্কা পয়েন্টে পর্যাপ্ত পানি না আসায় বাংলাদেশ প্রাপ্য পানি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কেন ফারাক্কা পয়েন্টে পানির প্রাপ্ততা কমে গেছে, সে কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশের তরফে ফারাক্কা পয়েন্টে পানিপ্রবাহ বাড়ানোর তাকিদ দেয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো ফল পাওয়া যায়নি। যৌথনদী কমিশনের বৈঠক হলে বিষয়টি ব্যাপক আলোচনায় আসতো এবং এ ব্যাপারে ভারতের সুনির্দিষ্ট অভিমত জানা সম্ভব হতো। সেটিও সম্ভব হচ্ছে না যৌথনদী কমিশনের বৈঠক না হওয়ার কারণে। ভারত বৈঠকটি আটকে রেখেছে। গঙ্গার পানির ন্যায্য ও ন্যায়সঙ্গত হিস্যা না পাওয়ায় বাংলাদেশের প্রকৃতি, পরিবেশ, নদীব্যবস্থা, উৎপাদন, অর্থনীতি জনজীবনযাপন কতটা ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে তা বিশদ ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশের অস্তিতের স্বার্থেই গঙ্গার পানির ন্যায্য ও ন্যায়সঙ্গত হিস্যা নিশ্চিত করতে হবে। এই যখন জাতীয় প্রতিজ্ঞা তখন পানিসম্পদমন্ত্রী বলেন, ফারাক্কায় গঙ্গার পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশ বেশি পানি পায়। এর চেয়ে দুঃখজনক বক্তব্য আর কিছু হতে পারে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন