ভারী বর্ষণে শহরাঞ্চলে জলাবদ্ধতা এখন নিয়মিত ঘটনা। মে মাসের শেষ সপ্তাহে একটানা বৃষ্টিপাত এবং উজান থেকে আসা পানিতে সিলেটের জনজীবন অচল হয়ে পড়ার খবর প্রচার মাধ্যমে বিশেষভাবে উঠে আসে। এর আগে চট্টগ্রাম, ঢাকা ও কুমিল্লায়, অনুরূপ বর্ষণে শহরের উল্লেখযোগ্য অংশ পানিমগ্ন হয়ে পড়ার খবর প্রকাশিত হয়।
পদ্মা-মেঘনা-যমুনার সমুদ্রে এসে মেলার কাছাকাছি অঞ্চলে এ জনপদ গড়ে ওঠায় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সাধারণভাবে আমাদের দেশের ভূভাগ বেশি উঁচুতে অবস্থিত নয়। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে গেলে বা নদ-নদীর পানির প্রবাহ স্বাভাবিকের চেয়ে সামান্য বেশি হলেই আমাদের জনপদে বিপুল জনগোষ্ঠী পানিবন্দি, দুঃসহ জীবন-যাপনে বাধ্য হয়। তবে অপেক্ষাকৃত সমৃদ্ধ শহরাঞ্চলে পানিবদ্ধতা এবং বাড়িঘর-রাস্তাঘাট আজকাল ঘনঘন ঘটছে। নদী বা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির চেয়ে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনে অব্যবস্থার বিষয়টিই প্রধান কারণ হিসাবে চিহ্নিত। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্বহীন উন্নয়ন কর্মকান্ড অধিকাংশ ক্ষেত্রে দায়ী। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সাধারণ মানুষের অবর্ণনীয় দুর্ভোগের জন্য দায়িত্ব স্বাীকার করার কাউকে খুঁজে পাওয়ার নজির যেমন নেই, তেমনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর পরস্পরের মধ্যে দায়িত্ব ঠেলে দেওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়া নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
মৌসুমী আবহাওয়ার দেশ হিসাবে বর্ষাকালে ভারী বৃষ্টিপাত হবে, সেটি অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু খানিক বৃষ্টি হলেই পাহাড় ধসে প্রাণহানি, নগরীর ড্রেন-নর্দমা উপচে বাড়িঘর, দোকানপাটে পানি ঢুকে পড়ার নিয়মিত ঘটনা নিশ্চয়ই স্বাভাবিক নয়। গত বছর ২৪ জুন ছয়জন শিশুসহ ১১ জন অসহায় মানুষ চট্টগ্রামে পাহাড় ধসে পড়ায় মাটিচাপা পড়ে দুর্ভাগ্যের মৃত্যু বরণ করেছে। পাহাড় ধসে মানুষের প্রাণহানি চট্টগ্রামে নতুন নয়, তবে ২৪ জুনের ঘটনাটি রীতিমতো হৃদয়বিদারক। মৃত্যুর আপাতত কারণটি ভারী বর্ষণ এবং নরম হয়ে যাওয়া মাটির পাহাড় ধসে পড়া হলেও অনিয়ন্ত্রিতভাবে পাহাড় কাটা, পাহাড়ের সবুজ আচ্ছাদন উজাড় করা ও পাহাড়ের গা ঘেঁষে বসতবাড়ি তৈরি এর পেছনের কারণ। চট্টগ্রাম শহরেও দেশের অন্যান্য শহরাঞ্চলের মতোই দ্রুত জনবসতি বাড়ছে। প্রাকৃতিক কারণেই বাড়তি জনবসতির চাপ মোকাবিলার মতো পর্যাপ্ত জায়গা চট্টগ্রামে নেই। একদিকে বঙ্গোপসাগর এবং অপরদিকে পাহাড়ের সারির ভেতর বিকাশমান চট্টগ্রাম তাই সম্প্রসারণের চাহিদা পূরণ করছে-হয় পাহাড়ে বসবাসের কেন্দ্র বানিয়ে, নয়তো পাহাড় কেটে জমি বের করে। পাহাড়গুলো কেটে জমি বের করার কাজটি করা হচ্ছে অবৈধভাবে আর তাই সঙ্গতভাবেই, কোনো পরিকল্পনা এবং পরিবেশের বিবেচনা ছাড়া।
এদিকে গেল বর্ষার সময় ছাতকে এবং জৈন্তায় টিলা ধসে বেশ ক’জনের মৃত্যু সাধারণ মানুষের মধ্যে ভয়ের সূচনা করে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, ঘটনা ঘটার বা ক’জনের মৃত্যু হওয়ার পর কর্তৃপক্ষকে নড়েচড়ে বসতে দেখা যায়, পরিলক্ষিত হয় তৎপরতা। কিন্তু মূল কারণের প্রতিকারে এর আগে তৎপরতা পরিলক্ষিত হয় না, বরং কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা যায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী স্বীয় স্বার্থ উদ্ধারে থাকে তৎপর। এ কারণে টিলা-পাহাড় কেটে সাফ করা হচ্ছে নিধয়ভাবে।
একে একে কেটে ফেলা বা আংশিক কেটে নেওয়া পাহাড় যেভাবে ভূমিক্ষয় দ্রুততর করছে, তাতে ড্রেন-নর্দমায় বা স্বাভাবিক পানির চলার পথে প্রবাহ বাধ্যগ্রস্ত হচ্ছে। অপরদিকে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষাকারী টিলা, পাহাড় অপরিকল্পিতভাবে কেটে নেওয়ায় দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়ের অংশ ভারী বৃষ্টিতে ধসে পড়ছে কোনো সতর্ক বার্তা না দিয়েই। পাহাড়ের গা ঘেঁসে বসবাসে বাধ্য হওয়া মানুষগুলো তাই অসহায়ভাবে মাটিচাপা পড়ে মৃত্যুকে নিয়তি হিসাবে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে।
যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ আগের চেয়ে দ্রুত এবং বেশি সংখ্যক মানুষের মৃত্যু ও ধ্বংসের ঝুঁকির মুখে পড়ার একটি কারণ অবশ্যই, মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং যেখানে স্বাভাবিক বিবেচনায় মানুষের বসবাস করার কথা নয়, তেমন বিপদসঙ্কুল জায়গায় বসবাস গড়ে তোলার কারণে ঘটছে। পাহাড় ধসে মৃত্যুর ভয়াবহতা বৃদ্ধির পেছনে এটিও একটি কারণ। তবে এই যুক্তিতে নগরকর্তা এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দায়িত্ব এড়াতে পারে না।
বাংলাদেশের বিদ্যমান আইন (বাংলাদেশ গেজেট, অতিরিক্ত, জুলাই ১৮, ১৯৯৬) অনুযায়ী, ইমারত নির্মাণ, পুকুর খনন ও পাহাড় কর্তন ইত্যাদি অনুমোদনের জন্য নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক। কী কী শর্তসাপেক্ষে এ জাতীয় অনুমতি প্রদান আইনানুগ তাও আইনে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। কিন্তু সিলেট, চট্টগ্রাম বা দেশের অন্যান্য অঞ্চলে পাহাড় কাটা, পাহাড়ের সবুজ আচ্ছাদন অপসারণে যারা জড়িত সিংহভাগ ক্ষেত্রেই তারা কোনো অনুমোদনের ধার ধারছে না। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এক্ষেত্রে আইন অমান্যকারীদের খুঁজে পেতে ক্রমাগত ব্যর্থ হলেও তাদের পরিচয় অধিকাংশ মানুষেরই জানা এবং এমন নয় যে, পাহাড় কাটা, পাহাড়ের মাটি অপসারণ, পাহাড়ের সবুজ আচ্ছাদন ধ্বংস করার কাজ লোকচক্ষুর অন্তরালে রাতের আঁধারে লুকিয়ে করা হচ্ছে। বরং অধিকা!শ ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে ট্রাক ও ডজন ডজন শ্রমিক নিয়োগ করে দিনের আলোতেই পাহাড় কেটে জমি উদ্ধার সেই জমিতে বড় বড় নির্মাণ কাজ চলছে।
১৯৫২ সালের বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন অ্যাক্টের আর্টিকেল সি স্পষ্ট করে সংজ্ঞায়িত করেছে, পাহাড় কাটা বা পাহাড়ের সবুজ আচ্ছাদন অপসারণ কাজে কেউে কোনো পাহাড়ের গঠন, পার্শ্ববর্তী ভূমি, নিকটবর্তী পাহাড়ের ক্ষতি করতে পারবে না। একইভাবে পাহাড় কাটার কারণে নিকটবর্তী ড্রেন, ছড়া বা নদীতে পলি জমা বা ভরাট হয়ে যাওয়ার অবস্থা সৃষ্টি করা যাবে না, পাহাড় কাটা কেবল তখনি বিবেচনার বিষয় হতে পারে যখন সম্পত্তি ও জীবন রক্ষার প্রয়োজন দেখা দেয়, অথবা বৃহত্তর জনস্বার্থে জনবসতি গড়ার জন্য পাহাড় কাটা অবধারিত হয়ে পড়ে তবে উভয় ক্ষেত্রে পাহাড়ের অংশ কাটা বা তার আচ্ছাদন পরিস্কার করার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। আইনে বর্ণিত বিধিগুলো বাস্তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে পালিন হয় না বা উপেক্ষিত হয়। যারা সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি তারা বিষয়টি প্রয়োগ সিরিয়াস নয়-ঘটনার বিশ্লেষণ সে ইঙ্গিতই স্পষ্ট করে যারা পাহাড় কাটছে বা পাহাড়ের মাটি নিয়ে নিচু এলাকা ভরাট করছে এবং একই সঙ্গে পাহাড় কেটে জমি মুক্ত করছে, তাদের পরিচয় এলাকাবাসী জানে না এমন নয়। কিন্তু আইন প্রয়োগের দায়িত্ব যাদের ওপর তাদের নির্লিপ্ত আচরণ এক্ষেত্রে সাধারণ মানুষকে নাক না গলানোর ক্ষেত্রে স্বাভাবিক পরামর্শ দেয় ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। একে এক পাহাড় বিলুপ্ত হচ্ছে। দেশের পূর্বাঞ্চলে সামান্য ভৌগোলিক যে বৈচিত্র্য রয়েছে তাও বিপন্ন হচ্ছে।
সিলেট অঞ্চলের বিভিন্ন রাস্তা এবং চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার যাওয়ার পথে খেয়াল করলেই দেখা যায়, কেটে ফেলা বা অর্ধেক কাটা পাহাড় অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সবুজ আচ্ছাদন সরে যাওয়ায় বৃষ্টি এবং পানির ধারা মাটির পাহাড় ধরে পার্শ্ববর্তী ধানের জমি অনুর্বর, ভরাট করে তুলেছে। রাস্তায় প্রচুর কাদা নেমে এসে চলাচল বিপজ্জনক করে তুলেছে। কেবল সিলেট, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়ক নয়, অন্যান্য পাহাড়ি অঞ্চলেও মোটামুটি একই দৃশ্য।
পাহাড়গুলো অটুট রাখা হয়তো বর্তমান বাস্তবতায় সহজ নয়। কিন্তু উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে পরিবেশের ভাবনা না মেলাতে পারলে টেকসই উন্নয়ন সুদূর পরাহত থেকে যাবে। তাতে দুর্ঘটনা, পরিবেশগত বিপর্যয় নানা রূপে আঘাত হানবে। অসংখ্য ট্র্যাজেডি সংবাদ শিরোনাম হবে। সংকীর্ণ মুনাফার লোভ, জমির ক্ষুধা, ছোট্ট কোনো গোষ্ঠীর জন্য লাভজনক বার্তা নিশ্চিত করলেও অধিকাংশের জন্যই তা বিপদ ডেকে আনবে। পাহাড় নিধনের বিষয়টি সে আলোকেই দেখা দরকার। টেকসই উন্নয়নের সার কথাই হলো, আগামী প্রজন্মের অমিত সম্ভাবনার পথ রুদ্ধ না করেই দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন।
লেখকঃ প্রবীণ সাংবাদিক-কলামিস্ট। সদস্য বন ও পরিবেশ কমিটি, সিলেট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন