অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও শিল্পায়নের অপরপৃষ্ঠে রয়েছে দূষণসহ নানা রকম সামাজিক ও পরিবেশগত ঝুঁকি। অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এই ঝুঁকি বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। পদ্মাসেতু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পর্যটন ও শিল্পায়নে যে আকাশচুম্বী সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে তার প্রেক্ষাপটে উন্নয়ন পরিকল্পনার সমন্বিত রূপরেখা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। দেশের ওই অঞ্চলে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন, একইস্থান থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার অপূর্ব মনোরম সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটা, খানজাহান আলীর মাজার ও ষাটগম্বুজ মসজিদসহ অনেক দর্শনীয় স্থান ও পর্যটন স্পট রয়েছে, যা এতদিন উত্তাল পদ্মানদী পেরিয়ে যাতায়াতের অসুবিধার কারণে জমে ওঠেনি। পদ্মাসেতুর মেলবন্ধন দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষিতে যেমন নতুন অর্থনৈতিক সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে, একইভাবে সেখানে শিল্পায়নে নতুন নতুন বিনিয়োগের পাশাপাশি পর্যটন খাতেও অপার সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলেছে। পদ্মাসেতু প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের শুরু থেকেই ওই অঞ্চলের জেলাগুলোতে নতুন নতুন শিল্পদ্যোগ এবং উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছিল। এখন পদ্মাসেতু উদ্বোধনের পর স্বাভাবিকভাবেই সেখানে নতুন বাতাবরণ দেখা যাচ্ছে। তবে মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, পদ্মাসেতুর পর ওই অঞ্চলে যে নতুন অর্থনৈতিক উন্নয়ন তৎপরতা ও দেশের অপরাপর অংশের মানুষের যাতায়াতের নতুন প্রবাহ দেখা যাচ্ছে তার জন্য সেখানকার রাস্তা এবং রেল অবকাঠামোগুলো যখাযথভাবে প্রস্তুত নয়।
আগে যেখানে মাওয়া-জাজিরা ফেরিঘাটে পারাপারের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করতে হতো, এখন তা মাত্র ১০ মিনিটেই পার হওয়া যাচ্ছে। পদ্মাসেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় থেকে শরিয়তপুর, মাদারিপুর, ফরিদপুরসহ দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলাগুলোতে জমির মূল্য বেড়ে চলেছে। হাজার হাজার বেসরকারি ও কর্পোরেট উদ্যোক্তা বিভিন্ন সেক্টরে শত শত কোটি টাকার বিনিয়োগের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। সেই সাথে সরকার এবং বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) তত্ত্বাবধানে ১৭টি নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার প্রস্তুতি চলছে। এর মধ্যে বাগেরহাটে পরিকল্পিত ইকোট্যুরিজম পার্ক এবং মংলা অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতকেন্দ্রিক পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন পরিকল্পনা সেখানে লাখো মানুষের নতুন কর্মসংস্থান ও কর্মচাঞ্চল্যে ভরিয়ে তুলবে। বলা হচ্ছে, পদ্মাসেতু দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ২ শতাংশ অবদান রাখবে। তারই প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে পর্যটন ও শিল্পায়নে নতুন কর্মচাঞ্চল্য ও অর্থনৈতিক বাস্তবতায় মাদারিপুর, শরিয়তপুর, ফরিদপুরসহ আঞ্চলিক সড়কগুলোর প্রশস্তকরণ, উন্নয়ন ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়, পদ্মাসেতু চালুর পর ঢাকা-শরিয়তপুর রুটে গণপরিবহনের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেলেও অপ্রশ্বস্ত রাস্তার কারণে যানজটের ভোগান্তি ও নিরাপত্তাহীনতা বেড়ে গেছে।
পদ্মাসেতু চালু হলে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে টার্গেট করে যে সব নতুন নতুন শিল্পোদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, তার সাথে কোনো দীর্ঘমেয়াদি ও সমন্বিত পরিকল্পনা বা মাস্টারপ্ল্যান ছিল না। চলমান বৈশ্বিক বাস্তবতায় যেনতেন প্রকারে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণযোগ্য নয়। নানা ধরনের দূষণ, পরিবেশগত নিরাপত্তা এবং মানুষের স্বচ্ছন্দ যাতায়াতের ব্যবস্থা ছাড়া উন্নয়ন টেকসই হয় না। অপরিকল্পিত নগরায়ন, যত্রতত্র জমি ভরাট ও জলাভূমি দখলসহ পরিবেশগত নিরাপত্তার বিষয়গুলোতে বেখেয়াল হওয়ার কারণে রাজধানী ঢাকা শহর এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ে বসবাসের যোগ্যতা হারিয়েছে। সিলেটে চলমান বন্যায় সেখানকার অপরিতল্পিত রাস্তা ও অবকাঠামো নির্মাণের প্রতিক্রিয়া মূর্ত হয়ে উঠেছে। পদ্মাসেতু চালুর পর দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যে নতুন কর্মচাঞ্চল্য ও উন্নয়নের হাওয়া লেগেছে তা যথাযথ প্রক্রিয়া ও সমন্বিত মাস্টারপ্ল্যানের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হওয়া আবশ্যক। পদ্মাসেতুর সাথে নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং পর্যটনকেন্দ্রগুলোর সংযোগ সড়ক মহাসড়কগুলোর উন্নয়ন, প্রশস্তকরণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। বিশেষত বাগেরহাট, সুন্দরবন ও কুয়াকাটায় নতুন পর্যটন সম্ভাবনা শুধু দেশীয় দর্শনার্থীদেরই আকৃষ্ট করবে না, এখানে আন্তর্জাতিক পর্যটনেরও অপার সম্ভাবনা রয়েছে। সেই অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে সফলভাবে কাজে লাগাতে পারলে অন্য যে কোনো শিল্পোদ্যোগের চেয়ে অনেক বেশি কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটতে পারে। মানুষের নিরাপত্তা, সুলভে থাকা-খাওয়া, স্বচ্ছন্দ যাতায়াত ও পরিবেশগত বিষয়গুলো প্রাধান্য দিয়ে পদ্মার দুই পাড়ে উন্নয়ন ও বিনিয়োগ কাঠামো বাস্তবায়নে যথাশীঘ্র একটি মহাপরিকল্পনা ঘোষণা ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন