শীত মৌসুম শুরু হতে না হতেই রাজধানীতে গ্যাস সংকট তীব্র হয়ে উঠেছে। এটা একটা নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান তিতাসের বক্তব্যও প্রতি বছরের মতো একই থাকে। এ সময়ে তার নিয়মিত বক্তব্য হচ্ছে, শীতে গ্যাসের চাপ কম থাকায় সংকট দেখা দেয়। তবে সংকট মোকাবেলায় যেসব সমস্যা রয়েছে, সেগুলোর সমাধানে উদ্যোগ নেই বললেই চলে। তিতাসই বলে অবৈধ সংযোগের মাধ্যমে গ্যাস টেনে নেয়ায় সংকট তীব্র হয়ে উঠে। প্রশ্ন হচ্ছে, সমস্যা জানা সত্ত্বেও গ্যাসের এসব অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয় না কেন? অবৈধ সংযোগের কারণে বৈধদের কেন দুর্ভোগে পড়তে হবে? এসব প্রশ্নের জবাব পাওয়া যায় না। দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ রয়েছে, তিতাসের একশ্রেণীর কর্মকর্তা ও কর্মচারী এসব অবৈধ গ্যাস সংযোগের সাথে জড়িত। তারা সেখান থেকে বিপুল অংকের মাসোহারা পায়। অবৈধ সংযোগ যেন তাদের জন্য একটা স্থায়ী ব্যবসায়ে পরিণত হয়েছে। গতকাল একটি দৈনিকের খবরে বলা হয়েছে, রাজধানীর অভিজাত এলাকা থেকে শুরু করে পুরনো ঢাকায় গ্যাস সংকট তীব্র হয়ে উঠেছে। কোথাও কোথাও ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আধা ঘণ্টাও গ্যাস থাকে না। যেসব এলাকায় থাকে সেখানে টিমটিম করে চুলা জ্বলে। এ দিয়ে রান্না-বান্না করা প্রায় অসম্ভব। ফলে বাধ্য হয়ে অনেককে গ্যাস সিলিন্ডার, কেরোসিনের স্টোভ এমনকি লাকড়ির চুলা ব্যবহার করতে হচ্ছে। তবে মাস শেষে গ্যাসের বিল তাদের দিতেই হচ্ছে। এতে উভয় দিক থেকেই গ্রাহকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। গ্যাস সংকটে যে শুধু সাধারণ গ্রাহকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা নয়, শিল্প-কারখানার উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে। বেশিরভাগ শিল্প-কারখানা গ্যাসভিত্তিক হওয়ায় গ্যাসের সংকট শুরুর পর থেকে তাদের উৎপাদন তিন ভাগের একভাগ কমে গেছে বলে মালিকরা জানিয়েছেন। অন্যদিকে গ্যাসের উৎপাদন স্বাভাবিক রয়েছে বলে দাবি করেছেন পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা। তাহলে এই সংকট দেখা দিল কেন?
শীত মৌসুমে গ্যাসের চাপ কমবে এবং গ্যাস সংকট দেখা দেবে তা জানা সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আগাম কেন ব্যবস্থা নেয় না, তা বোধগম্য নয়। এটাকে উদাসীনতা এবং দুর্নীতিগ্রস্ত কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে প্রশ্রয় দেয়ার ফল ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে! এক সময় বলা হতো, বাংলাদেশ গ্যাসের উপর ভাসছে। পরবর্তীতে দেখা গেল, তা এক ভ্রান্ত ধারণা মাত্র। বাংলাদেশে কী পরিমাণ গ্যাস রয়েছে, তার সঠিক হিসাব পাওয়াও মুশকিল। কেবল অনুমানের উপর ভিত্তি করে হিসাব দেয়া হয়। যে হিসাবটি দেয়া হয়, তা হলো যে পরিমাণ গ্যাস মজুদ রয়েছে, তা দিয়ে আগামী ৫০ বছর পর্যন্ত চলবে। বর্তমানে দেশে ২১টি গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। এগুলোর দৈনিক উৎপাদনক্ষমতা ২ হাজার ৭৪০ মিলিয়ন ঘনফুট। এর বিপরীতে উত্তোলন করা হচ্ছে ২ হাজার ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট, যা উৎপাদনসক্ষমতার ৯৯ শতাংশ। গ্যাসক্ষেত্রগুলোর মধ্যে ৯টি থেকে সক্ষমতার অতিরিক্ত উত্তোলন করা হচ্ছে। এর ফলে গ্যাসক্ষেত্রগুলো যে কোনো সময় পরিত্যক্ত হয়ে পড়তে পারে। এতে গ্যাস সংকট আরও তীব্র হয়ে উঠবে। এই প্রেক্ষিতে বিশেষজ্ঞরা নতুন নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান এবং তা থেকে দ্রুত গ্যাস উত্তোলনের কাজ শুরু করার উপর জোর দিচ্ছেন। ইতোমধ্যে কুমিল্লার শ্রীকাইল, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জসহ দেশের কয়েকটি স্থানে নতুন গ্যাসক্ষেত্রের সন্ধান পাওয়া গেলেও তা থেকে উত্তোলন ও সরবরাহ শুরু করা যায়নি। বিশেষ করে রূপগঞ্জের গ্যাসক্ষেত্রটির সব কাজ হয়ে গেলেও গ্যাস লাইন নির্মাণ নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হওয়ায় সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে লিজিং প্রতিষ্ঠানগুলোও গ্যাস উত্তোলনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম অস্বাভাবিক পড়তির দিকে থাকায় তারা আগ্রহ হারাচ্ছে। বাংলাদেশে মোট গ্যাসের অর্ধেকেরও বেশি যে কোম্পানিটি উত্তোলন ও সরবরাহ করে, সেই মার্কিন প্রতিষ্ঠান শেভরন তার স্বার্থ বিক্রি করে এদেশ থেকে চলে যেতে চাচ্ছে। যদি তাই হয়, তবে বিদেশি প্রতিষ্ঠান নির্ভর গ্যাস ক্ষেত্র অচল হয়ে সংকটকে আরও তীব্র করে তুলবে। এমনিতেই দৈনিক গ্যাসের চাহিদা রয়েছে ৩ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট, যা উৎপাদন সক্ষমতার চেয়ে বেশি। তার উপর যদি বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো গ্যাস উত্তোলনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, তবে তা মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়াবে। এমতাবস্থায় বিদেশি প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভরতা কমিয়ে নিজেদের সক্ষমতা দিয়ে গ্যাস ক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলন জরুরি। পাশাপাশি যেসব গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে, সেগুলো অবিলম্বে চালু করা এবং নতুন গ্যাস ক্ষেত্র অনুসন্ধান জোরদার করা অপরিহার্য। তারপরও যেটুক গ্যাস উৎপাদন ও সরবরাহ করা হচ্ছে, তার সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে গ্যাস সংকট এতটা তীব্র হতো না। দুঃখের বিষয়, অব্যবস্থাপনা ও অবৈধ সংযোগের কারণে গ্যাসের যেমন অপচয় হচ্ছে, তেমনি বৈধ গ্রাহকরা চরম ভোগান্তিতে পড়ছে। শিল্প-কারখানায় উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটার পাশাপাশি গ্যাস সংযোগের অভাবে অনেক নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠানও চালু করা যাচ্ছে না।
উৎপাদিত গ্যাসের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ যদি সরবরাহজনিত ত্রুটি, অবৈধ সংযোগের মাধ্যমে অপচয় হয়, তবে গ্যাসের সংকট কোনো দিনই কাটানো যাবে না। আমাদের দেশে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি উৎপাদন ও সরবরাহের ক্ষেত্রে যে অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা দেখা যায়, তা বিশ্বের খুব কম দেশেই রয়েছে। উৎপাদিত জ্বালানির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে না পারা খুবই দুঃখজনক। এর মূলে থাকা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর একশ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারীর দুর্নীতি সমূলে উৎসাদন করা যাচ্ছে না। এ যেন সর্ষের ভেতর ভূতের বসবাস। বলা বাহুল্য, এ ভূত তাড়াতে এবং সরবরাহ ব্যবস্থা মসৃণ ও নিখুঁত করতে না পারলে গ্যাস সংকট কোনোভাবেই সহনীয় পর্যায়ে আনা যাবে না। বছরের পর বছর ধরে শীত মৌসুমে গ্যাসের সংকটে জনজীবন বিপর্যস্ত হওয়া ও শিল্পোৎপাদন বিঘিœত হওয়া কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। তার উপর রয়েছে, চুলায় গ্যাস থাকুক না থাকুক বছর ওয়ারি দাম বৃদ্ধি করে দুর্ভোগ আরও চরমে নিয়ে যাওয়া। সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ সৃষ্টির এই অপতৎপরতা কাম্য না হলেও তা করা হচ্ছে। আমরা মনে করি, গ্যাসের সংকট নিরসনে যেসব অনিয়ম, দুর্নীতি রয়েছে, তা অবিলম্বে দূর করতে হবে। বছরের যে সময়ে গ্যাস সংকট দেখা দিতে পারে, সে সময়কে সামনে রেখে স্বাভাবিক সরবরাহ ঠিক রাখতে আগাম ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন