নাফ নদীর উভয় পাড়ের আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে নির্যাতিত রোহিঙ্গা মসুলমানদের কান্নায়। স্বদেশের অসহনীয় জুলুমে বিপর্যস্ত হয়ে তারা মিয়ানমারের আরাকান প্রদেশ থেকে জল ও স্থলপথের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে অবৈধভাবে ঢুকে পড়ছে বাংলাদেশে। কিন্তু এপারে এসেও থামছে না তাদের কান্না। মিয়ানমারে সেদেশের সরকারি বাহিনী আর মঘ দস্যুদের নির্যাতন আর এদেশে মুসলিম নামক নরপিশাচদের থাবা যেন একই সূত্রে গাঁথা। মিয়ানমারে সর্বস্ব হারিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেও ছিনতাই, ডাকাতি, ধর্ষণ ও চাঁদাবাজির সম্মুখীন হচ্ছেন রোহিঙ্গারা।
গতকাল মিয়ানমারের সীমান্ত এলাকার টেকনাফ, নীলা, হোয়াইক্যং, জাদিমুরা, নয়াপাড়া, খরাংখালী, শাহপরীর দ্বীপ এবং উখিয়ার বালুখালী, নাইক্ষংছড়ির ঘংধুম এর বিভিন্ন পয়েন্ট ঘুরে জানা গেছে লোমহর্ষক যতসব ঘটনা। মিয়ানমারের নির্যাতিত রোহিঙ্গা মুসলিম নারী-পুরুষ ও শিশুরা এপারে এসেও নিরাপদ নয়। জানা গেছে, বাংলাদেশী দস্যুরা তাদের কাছ থেকে অর্থকড়ি ও সোনার গহনা কেড়ে নিচ্ছে। যুবতীদের ধর্ষণ করে হত্যা করে লাশ গুম করারও অভিযোগ পাওয়া গেছে। এমনকি মোটা অঙ্কের চাঁদা নিয়ে তাদের আশ্রয় দেয়ার কথা জানিয়েছেন রোহিঙ্গা নির্যাতিত ও স্থানীয়রা। নীলা জাদিমুরার একজন জনপ্রতিনিধি (মেম্বার) মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার কথা জানা গেছে। এমনকি সীমান্ত রক্ষীদের ব্যাপারেও এ ধরনের কথা জানা গেছে।
নীলা কম্বনও হোয়াইক্যং মিনাবাজার এলাকায় বখাটে সন্ত্রাসীরা কয়েকজন রোহিঙ্গা যুবতীকে ধর্ষণ করে লাশ গুম করার কথাও জানা গেছে। এ ছাড়া নীলা কম্বন এলাকায় কয়েকজন রোহিঙ্গা নারী থেকে স্বর্ণালঙ্কার ছিনিয়ে নেয়ার কথা জানিয়েছে স্থানীয়রা। প্রফেসর গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী এ ধরনের একটি ঘটনায় ছিনতাই করা মালামাল উদ্ধার করে দেয়ার কথা জানান।
এ অবস্থায় শুক্রবার ভোররাতে আরও ১০৭ রোহিঙ্গা নর-নারীকে আটক করে সে দেশে ফেরত পাঠিয়েছে বিজিবি। অনুপ্রবেশে সহায়তাকারী চার দালালকে সাজা দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। রাখাইন প্রদেশ জুড়ে বিশেষ করে উত্তর মংডুর রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় আতঙ্ক কাটছে না। সে দেশের সেনাবাহিনীসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর দমন-পীড়ন ও নির্যাতনে কোণঠাসা রোহিঙ্গারা নিজ ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটছে। নাফ নদী পেরিয়ে অনেকেই এরমধ্যে ঢুকেছে বাংলাদেশে। আবার নদী ও সাগর জলে ভাসছে নারী-পুরুষ ও নিরীহ মানুষ বোঝাই অনেক নৌকা। দেশি দালালদের সহযোগিতায় দুর্গম সীমান্ত পথে রাতের আঁধারে অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে।
এদিকে, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতনে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশ। ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ডেনমার্কের কূটনীতিকগণ অং সান সুচির সাথে দেখা করে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। জাতিসংঘ আশঙ্কা ব্যক্ত করে বলেছে, দ্রুততার সাথে সহায়তা করা না গেলে শিশুসহ অসুস্থ তিন হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গার মৃত্যু হতে পারে। তবে মিয়ানমার সরকারের তরফে দাবি করা হয়েছে, রোহিঙ্গা লবিস্টরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অসত্য সংবাদ ছড়াচ্ছে।
বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, সংখ্যালঘু রোহিঙ্গারা রাখাইন প্রদেশ ছাড়ার লক্ষে বিভিন্ন সীমান্তে ভিড় করে আছে। তবে তাদের প্রধান গন্তব্য বাংলাদেশ। কিন্তু বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনীও তৎপর রয়েছে অনুপ্রবেশ রোধে। মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে মোতায়েন রয়েছে সেনাবাহিনীর ইনফ্যান্ট্রি ও হেলিকপ্টার। এই প্রস্তুতি রোহিঙ্গাদের মাঝে ভীতি সঞ্চার করে রেখেছে। জাতিসংঘ, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ডেনমার্কসহ বিভিন্ন দেশের উদ্বেগের পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমার প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র দাবি করেছেন, রোহিঙ্গা বিষয়ে প্রচারিত সংবাদগুলো সত্য নয়। লবিস্টদের মাধ্যমে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার করা হচ্ছে। যে কারণে আন্তর্জাতিক মহল তাদের ভুল বুঝছে।
এদিকে, সীমান্তের ওপার থেকে বিভিন্ন সূত্রে এবং এ পারে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা নর-নারীরা যে তথ্য দিচ্ছেনÑ তা লোমহর্ষক। রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়ার পাশাপাশি হত্যার উৎসবে মেতে উঠেছে সে দেশের সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিপি ও রাখাইন মৌলবাদীরা।
কক্সবাজার জেলা বিএনপি সভাপতি সাবেক এমপি শামহজাহান চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক হলেও মিয়ানমার সরকার তাদের উপর নির্মম নির্যাতন চালিয়ে চরমভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। আর নির্যাতিত রোহিঙ্গা নারী শিশু পুরু বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে আমাদের সমস্যা বাড়াচ্ছে এটাও ঠিক। কিন্তু নিরুপায় নির্যাতিত মানুষগুলোকে জাতিসংঘ বাহিনীর মাধ্যমে নিরাপত্তা দেয়ার দাবি জানান কিরি। এই সমস্যা সমাধানে অবিলম্বে জাতিসংঘ নিরাপত্তাবাহিনী নিয়োগ দেয়ারও দাবি জানান শাহজাজহান চৌধূরী।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন