দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যার পানি কমলেও বান্যা কবলিতদের দুর্ভোগ কমছে না। বানের স্রোতে ঘরবাড়ি ভেসে যাওয়ায় অনেকে আশ্রয় কেন্দ্র ছেড়ে যেতে পারছেন না। বনাভাসীদের ত্রাণ সহায়তা করলেও তাদের পুর্নবাসনের কোন উদ্যোগ নেই। সিলেট ও সুনামগঞ্জের অনেকের বাড়ি ঘর ভেসে গেছে। ঘর নির্মাণের জন্য সহায়তা তাদের এখন জরুরি প্রয়োজন। কিন্তু সরকারি বা বেসরকারি কোন পক্ষ থেকে থেকেই বানভাসীদের পুর্নবাসনের কোন উদ্যোগ নেই।
সরকারি ভাবে বন্যায় সিলেট ও সুনামগঞ্জে ক্ষতিগ্রস্ত ১০ হাজার পরিবারকে ১০ হাজার টাকা করে প্রদান করা হবে। এ লক্ষ্যে দুই জেলায় প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে ৫ কোটি টাকা করে মোট ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ বরাদ্দ দুর্গত এলাকার জন্য খুবই অপ্রতুল।
বন্যার পানি কমতে শুরু করলেও হাওর পাড়ের মানুষ গবাদিপশু নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছে। দুর্গত এলাকায় ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত রোগও ছড়াচ্ছে। এ পর্যন্ত দেশে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে ৭ হাজার ৪৮৬ জন। সারাদেশে বন্যায় এখন পর্যন্ত ১০২ জন মারা গেছে। এর মধ্যে সিলেট বিভাগেই ৫৬ জন এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ৩৫ জন। বন্যার প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতির হিসাবে দেখা যায় সুনামগঞ্জে ৪৫ হাজার ঘরবাড়ির ক্ষতি হয়েছে। মৌলভীবাজারে বন্যায় ১৬ হাজার ৩৩৯ ঘরে ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া মৌলভীবাজারে বন্যায় ৪ হাজার ৬৮০ হেক্টর ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
এদিকে বন্যাকবলিত এলাকার জন্য আবহাওয়া অফিসের নতুন সতর্ক বার্তা রয়েছে। আবহাওয়া অফিস বলছে, আগামী তিনদিনের মধ্যে বৃষ্টিপাতের প্রবণতা বাড়তে পারে। মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের ওপর মোটামুটি সক্রিয়। একই সাথে ভারতের আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা এসব রাজ্যেও প্রবল বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা আছে। ফলে দেশর উত্তর-পূর্বাঞ্চলে তৃতীয়বারের মত বন্যা দেখা দিতে পারে। এ ছাড়া দেশের মধ্যাঞ্চলেও বন্যা বিস্তার লাভ করতে পারে।
এদিকে দেশের বিভিন্ন জেলায় নদ নদীর পানি কমলেও বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলায় যমুনা নদীতে আবারও বাড়ছে পানি। পানি বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভাঙছে দুর্গম চরের লোকালয়, ফসলি জমি, বসতি, জনপদ।
সিলেট ব্যুরো জানায়, বন্যায় মানবিক বিপর্যয়ের মুখে সিলেট। বন্যার পানিতে অসহায় বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা। স্বাভাবিক জীবনের ছন্দপতন। এরমধ্যে সিলেটের ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে জ¦র সর্দি। সেই সাথে করোনার প্রকোপ বাড়ছে। জ¦র-সর্দি থাকার পরও করোনা পরীক্ষায় মনোযোগী নেই সিলেটের মানুষ। বন্যার পানি ধীরে ধীরে কমলেও এরমধ্যে অঝোর ধারায় বৃষ্টির পাত ঘটছে মাঝে মধ্যে। সেই সাথে রোদের পরিবেশে তাপদাহের মাত্রাও কম নয়। একটানা ১৯ দিন ধরে পানিবন্দি রয়েছেন সিলেট দক্ষিণ সুরমা এলাকার বাসিন্দারা। কয়েকদিন ধরে জ্বর কাশি-সর্দির প্রকোপ বেড়েছে চিকিৎসকের ঔষধ সংগ্রহ করছেন আক্রান্তরা। ঔষধ সেবনে সুস্থ্যও হচ্ছেন অনেকে। স্বাস্থ্য অধিদফরের সিলেট বিভাগীয় পরিচালক ডা. হিমাংশু লাল রায় জানান, এখন অনেকে সর্দি জ¦রে আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের দ্রুত পরীক্ষা করা উচিত। সেই সাথে করোনার প্রকোপ বাড়ছে তাই সর্তক হওয়া দরকার। এদিকে, বিভিন্ন স্থান থেকে বন্যার পানি কমতে শুরু করলেও দক্ষিণ সুরমার বঙ্গবীর সড়ক, লাউয়াই সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের চন্ডীপুল সড়ক পর্যন্ত জলাবদ্ধতা এখনো আছে। সড়কের কোথাও হাঁটুপানি আবার কোথাও কোমরসমান পানি। সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী আসিফ আহমেদ ইনকিলাবকে জানান, সিলেটের নদ-নদীর পানি সুনামগঞ্জ দিয়ে নামছে। সুনামগঞ্জে পানি বেশি থাকায় পানি নামতে একটু সময় লাগছে।
সুনামগঞ্জ জেলা সংবাদদাতা জানান, সাম্প্রতিক কালের ভয়াবহ বন্যার কারণে জেলার প্রাণী সম্পদ বিভাগের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সেই সাথে গো-খাদ্যের চরম সংকট দেখা দিয়েছে। যার প্রভাব আসন্ন কোরবানির ঈদে পড়ার সম্ভবাবনা রয়েছে। মোট ৩ লাখ ৮৭ হাজার ৫২৮ টি প্রাণীর মৃত্যু হয়েছে। এছাড়াও আনুমানিক ২০ কোটি টাকার খড় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গোখাদ্য ও প্রচুর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সুনামগঞ্জ জেলা প্রাণী সম্পদ অফিস তথ্য মতে, সম্প্রতি বন্যায় প্রাণী সম্পদ বিভাগ সুনামগঞ্জের প্রাথমিক ভাবে গবাদি পশু ও হাঁস মুরগির মৃত্যু হয়েছে ৩ লাখ ৮৭ হাজার ৫২৮টি। এর মধ্যে গরু ৪২২টি, মহিষ ৩৭টি, ছাগল ৬৯৯টি, ভেড়া ৫১৪টি, মোট ১৬৪২টি। হাঁস ৯৭৮৩১টি, মুরগী ২ লাখ ৮৮ হাজার ০৫৫ টি। সর্বমোট ৩ লাখ ৮৭ হাজার ৫২৮টি। জেলার ১১ উপজেলায় আনুমানিক ২০ কোটি টাকার খড় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়াও প্রচুর গোখাদ্য বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। যার ক্ষতির পরিমাণ এখনও নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। তবে ধারনা করা হচ্ছে অন্তত ৫ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে স্থানীয়দের অভিমত। জেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ড. আসাদুজ্জামান ইনকিলাবকে জানান তার অধিদফতর ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে ৯০০ মেট্রিকটন গোখাদ্য বরাদ্দ চেয়ে চিঠি দিয়েছেন। সম্প্রতি ভয়াবহ বন্যার ফলে অনেক খামারীদের গরু ছাগল সহ অন্যান্য প্রাণীর ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যেগুলো বেঁচে আছে সেগুলোর খাদ্যের সংস্থান করতে হিমশিম খাচ্ছেন। কারণ এখনও গ্রামের পর গ্রাম বন্যার পানিতে প্লাবিত। এছাড়াও জমানো খড় ও পানিতে ভেসে গেছে।
কুড়িগ্রাম জেলা সংবাদদাতা জানান, জেলার নদনদীর পানি কমে বন্যা পরিস্থিতির সার্বিক উন্নতি হয়েছে। তবে বানভাসীদের কষ্ট রয়েই গেছে। বাড়িঘর থেকে পানি নেমে যেতে শুরু করলেও অনেকেই উঁচু স্থান ও আশ্রয়কেন্দ্র থেকে নিজ বাড়িতে ফিরতে পারছেন না। আরো বেশ কয়েকদিন সময় লাগতে পারে। কারন এখন কোন কোন বাড়িতে কাঁদা ও কেঁচোয় ভরপুর। আবার কোথাও কোথাও ভঙ্গুর বাড়িঘর। ফলে এসব মানুষ বাড়িতে ফিরতে দেরি করছেন। এদিকে,বন্যার পানি নেমে গেলেও দেখা দিয়েছে নানা পানিবাহিত রোগ। খাদ্য সংকট অনেক এলাকায় দেখা দিলেও সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে যে ত্রাণ সহায়তা দেয়া হচ্ছে তা পর্যাপ্ত নয় বলে জানায় বানভাসীরা। অনেকেই একবার ত্রাণ পেলেও আরো প্রয়োজন বলে জানান। অপরদিকে, গত এক সপ্তাহ ধরে জেলার সবকটি নদনদীতে দেখা দিয়েছে নদী ভাঙন। এ যেন মরার উপর খাঁড়ার ঘা। একদিকে বন্যার চাপ অন্যদিকে নদী ভাঙন। এতে বন্যার্ত ও নদী পাড়ের মানুষের মধ্যে মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। ভাঙনের মাত্রা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। গতকাল বিকেলে স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, তিস্তা, ধরলা, দুধকুমর ও ব্রহ্মপুত্র নদের ২২টি পয়েন্টে এখন দেখা দিয়েছে নদী ভাঙন।
ছাতক (সুনামগঞ্জ) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, ছাতক উপজেলার উত্তর খুরমা ইউনিয়নের মৈশাপুর বাজারে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। মৈশাপুর গ্রামের বাসিন্দা, সাবেক ছাত্রদল নেতা, ইতালী প্রবাসী আনোয়ার হোসেন রানা ও তার ছোট ভাই মাওলানা শামীম আহমদের যৌথ উদ্যোগে এলাকার ২৫০জন বন্যাদূর্গত মানুষের মধ্যে এসব ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হয়। গতকাল দুপুরে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণী পূর্ব আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন, বিএনপি জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য, ছাতক উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান চৌধুরী মিজান। উত্তর খুরমা ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জামাল উদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন, উত্তর খুরমা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান, সুনামগঞ্জ জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সুফিয়ান, উপজেলা যুবদলের আহবায়ক সদরুল আমীন সোহানসহ প্রমূখ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন