অবশেষে স্বপ্নের দেশ মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক নোটভারবালের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে কর্মী প্রেরণে এফডব্লিউসিএমএস প্লাটফর্ম ব্যবহৃত হবার ঘোষণা দেয়ায় জনশক্তি রফতানি কার্যক্রম দৃশ্যমান হতে যাচ্ছে। রোববার প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব গাজী মো. শাহেদ আনোয়ার বিএমইটির মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এক চিঠিতে বাংলাদেশ থেকে কর্মী প্রেরণের লক্ষ্যে চাহিদাপত্র সত্যায়নের প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করার জন্য প্রবাসী মন্ত্রণালয় ও বিএমইটিতে এফডব্লিউসিএমএস প্লাটফর্ম স্থাপনের কার্যক্রম শুরুর নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
গত ১ জুলাই ও ২ জুলাই মালাক্কায় বিভিন্ন কোম্পানি পরিদর্শন করেন মালয়েশিয়াস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনের শ্রম কল্যাণ উইং এর কর্মকর্তারা। মালয়েশিয়ার নিয়োগদাতা কোম্পানীগুলোর কর্মী নিয়োগের সক্ষমতা আছি কিনা, কর্মীদের থাকার ব্যবস্থা কেমন ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা যাচাই করা হচ্ছে। পরিদর্শন শেষে সব ঠিকঠাক থাকলে নিয়োগদাতার চাহিদাপত্র বা মূল ভিসায় সত্যায়ন করবেন শ্রমকল্যাণ উইং এর কর্মকর্তারা। বাংলাদেশ হাই কমিশনের নির্ভরযোগ্য সূত্র এতথ্য জানিয়েছে।
ঢাকায় কারিগরি বিষয়গুলো চূড়ান্তকরণে বিলম্ব হওয়ায় গত মাসে কর্মী প্রেরণ শুরু করা সম্ভব হয়নি। মালয়েশিয়া সরকার গত ৮ জুন বাংলাদেশের ৩৪টি মেডিকেল সেন্টারকে অনুমোদন দিয়েছে। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী ইমরান আহমদ ঘোষণা দিয়েছিলেন, জুন মাসেই মালয়েশিয়ায় কর্মী যাওয়া শুরু হবে। কিন্ত কর্মীদের বাংলাদেশ অংশে খরচ নির্ধারণ করার মতো বড় একটি কাজ বাকি রয়েছে।
বায়রার সাবেক যুগ্ম মহাসচিব ও একটি রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, কর্মী সঙ্কটের দরুণ মালয়েশিয়ার শিল্প কারখানায় ব্যাপক উৎপাদন ঘাটতি দেখা দিয়েছে। দেশটির সরকার বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে আগ্রহী। অন্যদিকে নেপাল থেকে প্রতিদিন হাজারের বেশি কর্মী দেশটিতে প্রবেশ করছে। আবার বাংলাদেশি কর্মীরা যাওয়ার অপেক্ষায় আছেন। এই অবস্থায় দেশের স্বার্থেই কর্মী পাঠানোর বিষয়ে দ্রুত কাজ করতে হবে। এজন্য মালয়েশিয়ার সরকারের সাথে সমন্বয় করে সম্ভাব্য যেকোন বিকল্প পদ্ধতিতে কর্মী পাঠাতে চান রিক্রুটিং এজেন্সি মালিকরা।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানো হয়েছে, এখন পর্যন্ত কর্মীদের মেডিকেল ও মালয়েশিয়া যাওয়ার খরচ বিষয়ে কোন ঘোষণা দেয়া হয়নি। মন্ত্রণালয়ের আনুষ্ঠানিক ঘোষণার আগে কর্মীদের কোন পদক্ষে না নিতে অনুরোধ করা হয়েছে ঐ বিজ্ঞপ্তিতে।
জানা গেছে, কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়ায় যুক্ত করার জন্য দুই রিক্রুটিং এজেন্সির নাম পাঠিয়ে গত ২৯ জুন মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছে কুয়ালালামপুরের বাংলাদেশ হাইকমিশন। এর মধ্যে একটি এজেন্সি হলো সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেড বা বোয়েসেল। হাইকমিশনের চিঠিতে মনোনীত রিক্রটিং এজেন্সিগুলোর সঙ্গে সরকারি এই সংস্থাকেও দ্রুত অন্তর্ভুক্ত করতে অনুরোধ জানানো হয়। এই চিঠি পেয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছে মালয়েশিয়ার মন্ত্রণালয়। চুক্তির বাইরে এ ধরনের অনুরোধকে ভালো চোখে দেখছেন না তারা। আবার হাইকমিশন থেকে এমন চিঠি দেওয়ার এখতিয়ার আছে কি না তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে অনেকে। জনশক্তি রফতানিকারকদের প্রশ্ন, এত দিন সিন্ডিকেট সিন্ডিকেট করে সেখানেই সরকারি সংস্থাকে অন্তর্ভুক্তির চেষ্টা কেন। যেখানে মালয়েশিয়ার নিয়োগকর্তারা কর্মী নেয়ার জন্য মুখিয়ে আছেন সেখানে কোন স্বার্থে বারবার পিছিয়ে দেয়া হচ্ছে। আর চুক্তি মোতাবেক যেখানে রিক্রুটিং এজেন্সি পছন্দ করার এখতিয়ার পুরোটাই মালয়েশিয়ার সেখানেই বা কেন নতুন করে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করছে কুয়ালালামপুরের বাংলাদেশ হাইকমিশন। মন্ত্রণালয় ও হাইকমিশনের এসব কর্মকান্ডে দীর্ঘসূত্রতা হওয়ায় নেপাল থেকে কর্মী নেওয়ার দিকে মালয়েশিয়ার নিয়োগ কর্মকর্তা ঝুঁকছেন বলেও অভিযোগ রপ্তানিকারকদের।
মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খুললেও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের শর্তারোপের কারণে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানো প্রক্রিয়া বিলম্বিত হচ্ছে। গত ২ জুন জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের মিটিংয়ে মালয়েশিয়া বাংলাদেশ উভয় দেশের প্রতিনিধি দল মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর বিষয়ে একমত হয়।
প্রবাসী মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, দেশটিতে জনশক্তি রফতানি শুরু হলে এবার মালয়েশিয়ায় প্রায় ৫ লাখ বাংলাদেশি কর্মী যেতে পারবে। বর্তমানে দেশটিতে প্রায় ৬ লাখ বাংলাদেশি কর্মী কঠোর পরিশ্রম করে প্রচুর রেমিট্যান্স দেশে পাঠাচ্ছে।
গত ২ জুন ঢাকায় উভয় দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রী দাতুক সেরি এম সারাভানানের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধি দল অংশ নেয়। বৈঠকে মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রী এম সারাভানান সীমিত সংখ্যক রিক্রুটিং এজেন্সির (২৫ এজেন্সি) মাধ্যমেই দেশটিতে কর্মী নেয়ার বিষয়ে অটল থাকেন। পরে মানবসম্পদ মন্ত্রী এম সারাভানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা করেও বাংলাদেশ থেকে জিরো কস্টে কর্মী নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন।
সম্প্রতি মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এফ ডব্লিউ সি এম এস (অভিবাসী কর্মী নিয়োগের অনলাইন সিস্টেম) এক বিজ্ঞপ্তিতে দেশটির নিয়োগকর্তা ও রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে অভিবাসী কর্মী নিয়োগের আবেদনপত্র জমা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিক প্রচেষ্টা এবং ব্যাপক কূটনৈতিক উদ্যোগের পর ২০২১ সালের ১৯ ডিসেম্বর কুয়ালালামপুরে দেশটিতে বাংলাদেশি কর্মী প্রেরণের লক্ষ্যে উভয় দেশের মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিতে মালয়েশিয়ার নিয়োগকারী কোম্পানীগুলো বাংলাদেশি কর্মীদের যাতায়াতের বিমান ভাড়া বহন করার শর্ত রয়েছে।
বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্সি হাজরে আসওয়াতের পরিচালক মো. দেলোয়ার হোসাইন গতকাল সোমবার ইনকিলাবকে বলেন, মালয়েশিয়ার সুপ্রিম উড এন্টারপ্রাইজ গত ২১ ফেব্রুয়ারি এবং স্কাই উড এসডিএন বিএইচডি’ গত ২৪ এপ্রিল তাদের এজেন্সির মাধ্যমে ১৫ জন সাধারণ কর্মী নিয়োগের চাহিদাপত্র ইস্যু করেছে। মালয়েশিয়ার আরো একাধিক নিয়োগকর্তা সাধারণ কর্মী নেয়ার জন্য একাধিক চাহিদাপত্র ইস্যু করেছে। তিনি বলেন, মালয়েশিয়ার নিয়োগকর্তারা বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে। দেশটিতে অভিবাসী কর্মীর চরম সঙ্কট বিরাজ করছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মালয়েশিয়ার এফডব্লিউসিএমএস প্লাটফর্ম এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের কেডিএন এর ম্যানুয়াল পদ্ধতিতেও দেশটিতে কর্মী প্রেরণ করা যাবে।
মালয়েমিয়ায় কর্মী প্রেরণের সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের পর হাজার হাজার মালয়েশিয়া গমনেচ্ছু কর্মী বিভিন্ন রিক্রুটিং এজেন্সিতে প্রতিনিয়ত ধরণা দিচ্ছেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন