শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ক্যারিয়ার

৩৭তম বিসিএস প্রিলির প্রস্তুতি

শামসুল আলম | প্রকাশের সময় : ২৭ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম


বাংলা সাহিত্য
শামসুল আলম
চেয়ারম্যান
ক্যারিয়ার গাইডলাইন

প্রাচীন যুগ
চর্যাপদ
প্রশ্ন :    চর্যাপদের পরিচয় প্রদান করুন।
উত্তর :    চর্যাপদ হচ্ছে বাংলা সাহিত্যের এ পর্যন্ত পাওয়া একমাত্র প্রাচীন নিদর্শন। এগুলো বৌদ্ধ সহজিয়া ধর্মের সাধনতন্ত্র হলেও এখন তা কবিতা বা গানের সংকলন হিসেবে পরিচিত। এই পদগুলো হাজার বছর ধরে রচিত। আমরা তা পেয়েছি বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশক ১৯০৭ সালে।
প্রশ্ন :    চর্যাপদের বিষয়বস্তু বা ধর্মতত্ত্ব লিখুন।
উত্তর : চর্যাপদ হচ্ছে বৌদ্ধ সহজিয়া ধর্মের সাধনতন্ত্র। কীভাবে সাধনা করলে সিদ্ধি লাভ করা যায় সে কথা লিখিত হয়েছে চর্যাপদে। বৌদ্ধ সহজিয়া ধর্ম বৌদ্ধ ধর্মের একটি শাখা। সহজিয়া মানে সহজ করণ। চর্যাপদের সাধকরা এ ধর্মটিকে সহজ করেছিলেন বলেই এরূপ নামকরণ করা হয়েছে।
প্রশ্ন :    চর্যাপদ আবিষ্কারের প্রেক্ষাপট লিখুন।
উত্তর : ১৮৮২ সালে প্রকাশিত ঞযব ঝধহংশৎরঃ ইঁফফযরংঃ খরঃবৎধঃঁৎব রহ ঘবঢ়ধষ গ্রন্থে রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্র সর্বপ্রথম নেপালের বৌদ্ধ তান্ত্রিক সাহিত্যের কথা প্রকাশ করেন। তাতে উদ্দীপ্ত হয়ে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রয়েল লাইব্রেরি থেকে ১৯০৭ সালে ঐ সাহিত্যের কতগুলো পদ আবিষ্কার করেন। তিনি নিজের সম্পাদনায় ১৯১৬ সালে এটি কলকাতার ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’ থেকে প্রকাশ করেন।
প্রশ্ন :    চর্যাপদের দুজন গবেষকের গবেষণা সম্পর্কে লিখুন।
উত্তর : চর্যাপদ নিয়ে অনেক গবেষকই গবেষণা করেছেন। চর্যাপদের দুজন বিখ্যাত গবেষক হলেন ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় ও ভাষা বিজ্ঞানী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। ১৯২৬ সালে ড. সুনীতি কুমার চট্টোপধ্যায় তাঁর ঞযব ঙৎরমরহ ্ উবাবষড়ঢ়সবহঃ ড়ভ ইবহমধষর খধহমঁধমব (ঙউইখ) গ্রন্থে চর্যাপদের ভাষাতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করেন এবং প্রমাণ করেন চর্যাপদ বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন।
১৯২৭ সালে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ চর্যাপদের ধর্মতত্ত্ব ও এর আনুষঙ্গিক বিষয় নিয়ে গবেষণা করেন এবং তিনিও প্রমাণ করেন যে, চর্যাপদ বাংলা সাহিত্যেরই আদি নিদর্শন।
প্রশ্ন : চর্যাপদের নামকরণ সম্পর্কে লিখুন।
উত্তর : চর্যাপদের নামকরণ সম্পর্কে বিভিন্ন মত পাওয়া যায়। কারো মতে গ্রন্থটির নাম, ‘আশ্চর্য চর্যাচয়’, সুকুমার সেনের মতে ‘চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয়, আধুনিক প-িতদের মতে এর নাম ‘চর্যাগীতিকোষ’ আর হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে ‘চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়’। তবে ‘চর্যাপদ’ সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নাম।
প্রশ্ন :    চর্যাপদ কবে, কোথা থেকে, কার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়?
উত্তর : মহামহোপাধ্যায় হর প্রসাদ শাস্ত্রী ১৯০৭ সালে নেপালের রয়েল লাইব্রেরি থেকে চর্যাপদ আবিষ্কার করেন। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে (১৩২৩) কলকাতার ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’ থেকে চর্যাপদ আধুনিক লিপিতে প্রকাশিত হয়। এর সম্পাদনা করেন মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। চর্যাপদ প্রকাশিত হয় ‘হাজার বছরের পুরানো বাংলাভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোহা’ নামে।
প্রশ্ন : চর্যাপদের ভাষা সম্পর্কে লিখুন।
উত্তর : চর্যাপদ প্রাচীন বাংলায় রচিত এ বিষয়ে সকল গবেষক একমত। তবে হাজার বছর আগে এই ভাষার মধ্যে কিছুটা অস্পষ্টতা ও জটিলতা রয়েছে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী চর্যাপদের ভাষা সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, ‘আলো আঁধারি ভাষা, কতক আলো, কতক অন্ধকার, খানিক বুঝা যায়, খানিক বুঝা যায় না।’ এ কারণেই চর্যার ভাষা সান্ধ্যভাষা নামে পরিচিত।
প্রশ্ন :    চর্যাপদের সমাজচিত্র লিখুন।
উত্তর : চর্যাপদ বৌদ্ধ সহজিয়া ধর্মের সাধনতন্ত্র হলেও পদকর্তাগণ তৎকালীন সমাজ চিত্রকে এড়াতে পারেননি। চর্যাপদে রয়েছে তৎকালীন সমাজে গ্রাম বাংলার নদী, নৌকার চিত্র, বেদে দলের কথা, হাটের পরিচয়, মাদল বাজিয়ে বিয়ে করতে যাওয়ার উৎসব, নববধূর নাকের নথ ও কানের দুল চোরে চুরি করার কথা। সর্বোপরি বাঙালির চিরন্তন ভাতের অভাবের কথাও চিত্রিত হয়েছে চর্যাপদে। ঢেন্ডন পা রচিত একটি পদ-
“টালত মোর ঘর নাহি পড়বেসী।
হাঁড়ীত ভাত নাহি নিতি আবেশী॥”
প্রশ্ন :    চর্যাপদের ছন্দ সম্পর্কে লিখুন।
উত্তর : পদকর্তাগণ আধুনিক ছন্দ বিচার করে চর্যার পদ লেখেননি। চর্যাপদের ছন্দ বিষয় নিয়ে আধুনিক ছান্দসিকগণ বহু গবেষণা করেছেন। অধিকাংশ ছান্দসিক মনে করেন, আধুনিক বাংলার কোন ছন্দে ফেলতে হলে চর্যাপদকে মাত্রাবৃত্ত ছন্দে ফেলতে হয়। যেমন-
“টালত মোর ঘর/নাহি পড়বেসী।
হাঁড়ীত ভাত নাহি/নিতি আবেশী॥”
প্রশ্ন :    চর্যাপদের কবিদের মধ্যে বাঙালি কবি কারা?
উত্তর : চর্যাপদের কবিদের মধ্যে বাঙালি বলে যাদের ধারণা করা হয়, তারা হচ্ছেন লুইপা, কুক্কুরী পা, বিরূপ পা, শবর পা, ধাম পা ও জয়ানন্দ।
প্রশ্ন :    চর্যাপদের কবিদের নামের শেষে পা যুক্ত করার কারণ কী?
উত্তর : ‘পা’ শব্দটি মূলত এসেছে পা >পাদ>পদ অর্থাৎ পদকর্তা। যিনি বা যারা পদ রচনা করতেন তিনি বা তারাই পদকর্তা বা কবি। আবার তারা সিদ্ধাচার্য হিসেবে পরিচিত ছিলেন বলে তাঁরা তাঁদের নামের শেষে সম্মান সূচক পা শব্দটি ব্যবহার করে গর্বিত বোধ করতেন।
প্রশ্ন :    চর্যাপদের কবি লুইপার পরিচয় প্রদান করুন।
উত্তর : চর্যাপাদের আদি কবি হলেন লুইপা। চর্যাপদের প্রথম কবিতা লুইপার লেখা।
কবিতাটি এরকম-“কাআ তরুবর পঞ্চবি ডাল।
চঞ্চল চীত্র পইঠা কাল॥”
তাঁকে বাংলা সাহিত্যের প্রথম কবি বলা হয়। তাঁর রচিত দুটি পদ পাওয়া গেছে।
প্রশ্ন :    কাহ্নপার পরিচয় প্রদান করুন।
উত্তর : চর্যাপদের কবিগণের মধ্যে সর্বাধিক পদরচয়িতার গৌরবের অধিকারী কাহ্নপা। তার তেরটি পদ চর্যাপদ গ্রন্থে গৃহীত হয়েছে। এ সংখ্যাধিক্যের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে কবি ও সিদ্ধাচর্যদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে অভিহিত করা যায়। কানুপা, কৃষ্ণপাদ ইত্যাদি নামেও তিনি পরিচিত। বিভিন্ন পদে কাহ্ন, কাহ্নু, কাহ্নি, কাহ্নিলা, কাহ্নিল্য প্রভৃতি ভনিতা লক্ষ্য করা যায়। খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে কানুপার আবির্ভাব হয়েছিল বলে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ মনে করেন। কানুপার বাড়ি ছিল উড়িষ্যায়, তিনি সোমপুর বিহারে বাস করতেন।
প্রশ্ন :    ভুসুকুপার পরিচয় প্রদান করুন।
উত্তর : চর্যাগীতি রচনার সংখ্যাধিক্যে দ্বিতীয় স্থানের অধিকারী হলেন ভুসুকুপা। তার রচিত আটটি পদ চর্যাপদ গ্রন্থে সংগৃহীত হয়েছে। নানা কিংবদন্তি বিচারে ভুসুকু নামটিকে ছদ্মনাম বলে মনে করা হয়। তার প্রকৃত নাম শান্তিদেব। তিনি মহারাষ্ট্রের রাজপুত্র ছিলেন এবং শেষ জীবনে নালন্দায় বৌদ্ধ ভিক্ষু হিসেবে নিঃসঙ্গভাবে অবস্থান করেন। ড. মুহম্মদ শহীদুলাহ্র মতে, শান্তিদেব ভুসুকু সাত শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বর্তমান ছিলেন।
প্রশ্ন :    চর্যাপদের ভাষাকে সান্ধ্য ভাষা বলা হয়েছে কেন?
উত্তর : সন্ধ্যায় থাকে আলো আঁধারের খেলা। সন্ধ্যার সময় কোন কিছু স্পষ্টরূপে দেখা যায় না। তেমনিভাবে হাজার বছর আগে লেখা চর্যাপদের ভাষাতেও অস্পষ্টতা থাকার কারণে এই ভাষাকে সন্ধ্যা বা সান্ধ্য ভাষা বলা হয়েছে। কেউ কেউ এ ভাষাকে আলো আঁধারের ভাষা বলেছেন।
প্রশ্ন :    চর্যাপদের রচনাকাল সম্পর্কে লিখুন।
উত্তর : চর্যাপদের রচনাকাল নিয়ে যথেষ্ট মত পার্থক্য রয়েছে। ভাষা বিজ্ঞানী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে ৬৫০-১২০০ সাল পর্যন্ত ৫৫০ বছরের মধ্যে রচিত। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপধ্যায়ের মতে, চর্যাপদ ৯৫০-১২০০ পর্যন্ত ২৫০ বছরের মধ্যে রচিত। মূল কথা, চর্যাপদ পাল ও সেন আমলে রচিত।
বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ
অন্ধকারযুগ/বন্ধ্যাযুগ/সান্ধ্যযুগ
প্রশ্ন : বাংলা সাহিত্যের কোন সময়কে অন্ধকার যুগ বলে অভিহিত করা হয়?
উত্তর : ১২০১ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময় বাংলা সাহিত্যে মধ্যযুগ বলে বিবেচিত। কিন্তু ১২০১ থেকে ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ এই ১৫০ বছরকে কেউ কেউ অন্ধকার যুগ বলে অভিহিত করেন। এ যুগের স্বপক্ষে বলা হয় যে, তুর্কি বিজয়ের ফলে মুসলিম শাসনামলে সূচনার পটভূমিতে নানা অস্থিরতার কারণে এ সময়ে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য সাহিত্য সৃষ্টি হয়নি। তবে এ সময়ে সামান্য কিছু সাহিত্যিক নিদর্শন পাওয়ায় কেউ কেউ এ যুগকে পুরোপুরি অন্ধকার যুগ বলতে নারাজ।
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য
প্রশ্ন : মধ্যযুগের আদি নিদর্শন কোনটি?
উত্তর : মধ্যযুগের সাহিত্যের আদি নিদর্শন ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’। এটি বড়– চ-ীদাস রচিত একটি কাব্য নাট্য। চর্যাপদের পর ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম। এজন্য ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কে মধ্যযুগের প্রথম কাব্য এবং বড়ু চ-ীদাসকে মধ্যযুগের আদি কবি বলা হয়।
প্রশ্ন : শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য কে, কীভাবে আবিষ্কার করেন?
উত্তর : ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে (১৩১৬ বঙ্গাব্দ) কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং পুঁথিশালার অধ্যক্ষ বসন্তরঞ্জন রায় সংবাদ পান যে, পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার বনবিষ্ণুপুরের কাছে কাকিল্যা গ্রামে দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় নামক এক ব্রাহ্মণের বাড়িতে কিছু পুরাতন, হাতে লেখা পুঁথি আছে। সে বছরই তিনি সেখানে যান এবং ওই ব্রাহ্মণের গোয়াল ঘরে অযতেœ রক্ষিত একরাশ পুঁথির সাথে তিনি এ গ্রন্থটি পান। অযতেœ থাকায় এ পুঁথি অর্থাৎ হাতে লেখা গ্রন্থটির সম্মুখ ও শেষ ভাগ অসম্পূর্ণ ছিল।
প্রশ্ন : শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের রচনাকাল লিখুন।
উত্তর : বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের প্রথম সাহিত্য শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন। এ কাব্যটি কখন রচিত হয় তা নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে গবেষকদের মধ্যে। অধিকাংশ গবেষকদের মতে, এ কাব্যটি চতুর্দশ শতাব্দীর শেষ দিকে অথবা পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে রচিত হয়।
প্রশ্ন : ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের ভাব ও ভাষা কীরূপ?
উত্তর : শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন কাব্য হচ্ছে এ পর্যন্ত প্রাপ্ত মধ্যযুগের প্রথম অখ- কাব্য। এ কাব্যের মোট ১৩টি খ- রয়েছে। দীর্ঘকাল ধরে লোকমুখে প্রচলিত গল্প-কাহিনী, পুরাণ এবং জয়দেবের গীতগোবিন্দের সমন্বিত প্রভাবে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্য রচিত হয়। এর মূল কাহিনী ভাগবত থেকে সংকলিত। রাধা কৃষ্ণের প্রেম বিরহই এ কাব্যের মূল উপজীব্য। এ কাব্যের কাহিনী বাহ্যিক দিক থেকে পৌরাণিক রাধা-কৃষ্ণের অনুসারী হলেও এটি মূলত লোকজীবনের প্রতিচ্ছবি। অনেকে যুক্তি দেখান, রাধা-কৃষ্ণের মাধ্যমে জীবাত্মা-পরামাত্মার প্রেম এখানে ফুটে উঠেছে। তবে কোন প্রকার আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা ব্যতিরেকে পার্থিব জীবনের আলোকেও এ কাব্যের অর্থ ও রস উপভোগ করা যায়।
প্রশ্ন : শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের প্রধান চরিত্র কয়টি? চরিত্রগুলোর পরিচয় প্রদান করুন।
উত্তর : শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন কাব্যের প্রধান চরিত্র ৩টি। যথা : রাধা, কৃষ্ণ ও বড়াই।
রাধা : পৌরাণিক কাহিনী মতে রাধা মানব আত্মার প্রতীক। এই মানব আত্মা ভগবানকে পাওয়ার জন্য সবসময় ব্যাকুল থাকে কিন্তু। বড়– চ-ীদাস রচিত ‘শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন’ কাব্যে রাধা রক্তে মাংসে গড়া এবং অপূর্ব সুন্দরী নারী যার মধ্যে প্রেম আছে এবং দৈহিক কামনা বাসনা চরিতার্থ করার বাসনা আছে। খুব কম বয়সে তার বিয়ে হয়ে যায়। আয়েন ঘোষ বা অভিমুন্য বা আইহন ঘোষ এর সাথে। তাকে দেখা শোনার দায়িত্ব অর্পণ করা হয় পিসিমা বড়াইকে।
কৃষ্ণ : পৌরাণিক কাহিনী মতে কৃষ্ণ হচ্ছে পরমাত্মা বা ভগবান অর্থাৎ তাঁকে পাবার জন্য মত সারা মানবকুল ব্যাকুল থাকে। বড়– চ-ীদাস রচিত ‘শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন’ কাব্যে কৃষ্ণ হচ্ছে রক্ত মাংসে গড়া সুদর্শন এক রাখাল বালক। যার মাঝে প্রেম আছে আবার তার মাঝে দৈহিক কামনা বাসনা চরিতার্থ করার আকাক্সক্ষা আছে। এখানে কৃষ্ণের মৌলিক পরিচয় হলো রাধার প্রেমিক হিসাবে।
বড়াই : এ কাব্যের তৃতীয় চরিত্র হচ্ছে বড়াই। যে বড়াইকে রাধার দেখা শোনার ভার অর্পণ করা হয়েছিল। সেই বড়াই রাধা কৃষ্ণের প্রেমের সম্পর্ক সৃষ্টিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে অর্থাৎ বড়াই হলেন রাধা কৃষ্ণের প্রেমের দূতি।
প্রশ্ন : শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের নামকরণ সম্বন্ধে লিখুন।
উত্তর : শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য যখন আবিষ্কার হবার পর দেখা গেল উপরের কিছু পাতা ছেঁড়া। এ কারণে গ্রন্থটির নাম জানা গেল না। গ্রন্থটির প্রাপ্ত চিরকুটে নাম লিখা ছিল শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ। এ নামে গ্রন্থটির নামকরণ করা হয় এবং ১৯১৬ সালে তা প্রকাশিত হলো। পরবর্তীকালে প-িতরা এ গ্রন্থটির নামকরণ করলেন শ্রীকৃষ্ণকীর্তন। গ্রন্থটি এখন এ নামে পরিচিত।
প্রশ্ন : শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের কবির পরিচয় প্রদান করুন।
উত্তর : এ কাব্যের কবি হলেন বড়– চ-ীদাস। এটি তাঁর ছদ্মনাম বা উপাধি। তার প্রকৃত নাম হচ্ছে অনন্ত বড়–য়া বা অনন্ত বড়াই। তাঁর জন্ম তারিখ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। তবে তিনি চ-ীমূর্তি বাসুলীর ভক্ত ছিলেন। তিনি বাংলার সাহিত্যের মধ্যযুগের প্রথম কবি। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য তিনি রচনা করেন। কবি যাত্রা পালার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন বলেই এমন চমৎকার নাটকীয় ভঙ্গিতে এটি রচনা করেন।
বৈষ্ণব পদাবলী
প্রশ্ন : বৈষ্ণব পদাবলীর পরিচয় প্রদান করুন।
উত্তর : পদ বা পদাবলী বলতে বোঝায় বৌদ্ধ বা বৈষ্ণবীয় ধর্মের গুঢ় বিষয়ের বিশেষ সৃষ্টি। মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ফসল হচ্ছে বৈষ্ণব পদাবলী। বৈষ্ণব পদাবলী মূলত রাধা কৃষ্ণের প্রেমলীলা সম্বলিত পদাবলী সাহিত্য। বাংলা সাহিত্য মধ্যযুগে একজন মহামানবের আগমন ঘটে তাঁর নাম শ্রীচৈতন্যদেব। তাঁর প্রবর্তিত ধর্মের নাম বৈষ্ণব ধর্ম। শ্রী চৈতন্য দেব ও তাঁর প্রবর্তিত ধর্ম নিয়ে মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যে যে পদাবলী সাহিত্যের সৃষ্টি হয়, তাই বৈষ্ণব পদাবলী নামে পরিচিত।
প্রশ্ন : বৈষ্ণবপদাবলীর শ্রেষ্ঠ কবির কারা?
উত্তর : বৈষ্ণবপদাবলীর কয়েকজন শ্রেষ্ঠ কবি হলেন বিদ্যাপতী, চ-ীদাস, জ্ঞানদাস ও গোবিন্দ দাস। বৈষ্ণব কবিতার তারা চার মহাকবি।
ক. বিদ্যাবতী : বিদ্যাবতী বৈষ্ণব পদাবলীর শ্রেষ্ঠ কবি। তিনি সবচেয়ে বেশি পদাবলী রচনা করেন। তবে তিনি বাঙালি ছিলেন না। আবার বাংলায় কোন পদ রচনা করেননি। তাঁর অধিকাংশ রচনাই সংস্কৃত এবং ব্রজবুলি ভাষায়। তারপরও তিনি বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে আছেন তার সহজ-সরল ও সুমধুর ধ্বনিময় উপস্থাপনার কারণে। তাঁর পদাবলীর কয়েকটি লাইন-
সখি, হামারি দুখক নাহি ওর।
এ ভরা বাদর মাহ ভাদর
শূন্য মন্দির মোর॥
খ. চ-ীদাস : বাংলা ভাষায় বৈষ্ণব পদাবলীর আদি কবি হলেন চ-ীদাস। তাঁর পদের বিখ্যাত লাইন-
“সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।”
গ. জ্ঞানদাস : সম্ভবত ষোড়শ শতাব্দীতে বর্ধমান জেলায় কবি জ্ঞানদাসের জন্ম। জ্ঞানদাসের একটি পদের দুটি লাইন-
রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর।
প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর।
ঘ. গোবিন্দ দাস : বিদ্যাপতির ভাবাদর্শে তিনি বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন, বিদ্যাপাতির অলঙ্কার এবং চিত্রকল্প তাকে মুগ্ধ করেছিল। তাঁর কয়েকটি পঙ্ক্তি :
যাহাঁ যাহাঁ নিকসয়ে তনু তনু জ্যোতি
তাহাঁ তাহাঁ বিজুরি চমকময় হোতি।
প্রশ্ন : বাংলা সাহিত্যে মধ্যযুগে চ-ীদাস সমস্যা নামে একটি সমস্যা রয়েছে। -সে সম্পর্কে লিখুন।
উত্তর : বাংলা সাহিত্যে মধ্যযুগে একাধিক কবি নিজেদের চ-ীদাস পরিচয় দিয়ে যে সমস্যার সৃষ্টি করেছেন তা হলো চ-ীদাস সমস্যা। গবেষকগণ একজন চ-ীদাসের কথা উলেখ করলেও কোন কোন গবেষক একাধিক চ-ীদাসের কথা উলেখ করেছেন। কমপক্ষে চারজন চ-ীদাসের নাম পাওয়া যায়। তারা হলো-
১. বড়– চ-ীদাস, ২. দ্বিজ চ-ীদাস, ৩. দীন চ-ীদাস, ৪. চ-ীদাস
তবে বড়– চ-ীদাস যে শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন রচনা করেছেন সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই।
প্রশ্ন : ব্রজবুলি ভাষা কী?
উত্তর : বৈষ্ণব পদাবলীর অধিকাংশই রচিত হয়েছে ‘ব্রজবুলি’ নামে এক কৃত্রিম মিশ্র ভাষায়। মূলত এটা মৈথিলি ও বাংলা মিশ্রণে এক মধুর সাহিত্যিক ভাষা। এতে কিছু হিন্দি শব্দও আছে। ব্রজলীলা সম্পর্কিত পদাবলীর ভাষা- এ অর্থে ভাষাটি ব্রজবুলি নামে পরিচিত। ব্রজবুলি কখনো মুখের ভাষা ছিল না; সাহিত্যকর্ম ব্যতীত অন্যত্র এর ব্যবহারও নেই। মিথিলার কবি বিদ্যাপাতি এ ভাষার স্রষ্টা। বিদ্যাপতি ও জয়দেব এ ভাষার দুজন শ্রেষ্ঠ কবি।
প্রশ্ন : মধ্যযুগে যিনি বাংলায় কোন পদ রচনা না করেও বাংলা সাহিত্য অমর হয়ে আছেন তার পরিচয় প্রদান করুন।
উত্তর : বিদ্যাপতি হলেন বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের প্রধান কবি যিনি বাংলায় কোন পদ রচনা না করেও বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। বিদ্যাপতিকে মিথিলার কোকিল বলা হয়। কারণ তার জন্ম মিথিলায়। তাঁর উপাধিগুলো ছিল মৈথিল কোকিল, অভিনব জয়দেব, নব কবি শেখর, কবি রঞ্জন, কবি কণ্ঠহার, প-িত ঠাকুর, সাদুপাধ্যায়, রাজপ-িত প্রভৃতি। তিনি ব্রজবুলি নামক একটি কৃত্রিম ভাষায় পদ রচনা করেন।
প্রশ্ন : বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে চৈতন্যদেব কেন স্মরণীয়?
উত্তর : নবদ্বীপে জন্মগ্রহণকারী শ্রীচৈতন্যদেব ভগবত প্রেমে উম্মত্ত হয়ে ওঠেন। মুসলমান শাসন ও ইসলাম ধর্মের সম্প্রসারণে হিন্দু সমাজের যে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছিল তাকে প্রতিরোধ করার মন্ত্র প্রচার করেন চৈতন্যদেব তাঁর বৈষ্ণব মতবাদের মাধ্যমে। তিনি প্রচার করলেন ‘জীবে দয়া ঈশ্বরে ভক্তি, বিশেষ করে নাম-ধর্ম, নাম-সংকীর্তন’। চৈতন্যদেবের আবির্ভাবে প্রভাব লক্ষ করা যায় তা হচ্ছে, ঐতিহাসিক ও সামাজিক দিক থেকে দেশ জাতীয় মুক্তির পথের সন্ধান পায়। মানব প্রেমাদর্শে সমৃদ্ধ বৈষ্ণব দর্শন ও ধর্ম সম্প্রদায় গড়ে ওঠে এবং অধ্যাত্মভাব, চিত্র সৌন্দর্য ও মধুর প্রেমরসে সমৃদ্ধ বৈষ্ণব সাহিত্য সৃষ্টি হয়।
মঙ্গল কাব্য
প্রশ্ন: মঙ্গলকাব্য রচনার সামাজিক কারণ কী?
উত্তর: মঙ্গলকাব্য রচনার মূলে রয়েছে বাংলাদেশের আদি অধিবাসীদের আধিভৌতিক ভয়Ñভাবনা। তারপর এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক উত্থান-পতনের ইতিহাস। বাংলাদেশ নদীনালা, খালবিল, অরণ্য-জলাভূমিতে ভরা। প্রাকৃতিক উপদ্রবও এদেশে লেগে আছে সর্বদা। ঝড়ঝঞ্ঝা, বন্যা ইত্যাদি দুর্যোগ বাঘ, কুমীর-সর্প ইত্যাদি হিংস্র জন্তু, ওলাউঠা-বসন্ত ইত্যাদি ভয়ঙ্কর আধিব্যাধি এদেশের অধিবাসীকে প্রায়ই মৃত্যুকবলিত করত। এই সমস্ত প্রতিকারহীন অদৃশ্য উপদ্রব্যের কাছে তারা নিজেদের বড় অসহায়বোধ করতে লাগল। এ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তারা বিভিন্ন কাল্পনিক দেব-দেবীর পূজা-অর্চনা করতে লাগল। কখনও কখনও তারা এগুলো লিখে রাখার প্রয়োজনও উপলব্ধি করতে লাগল। আর এভাবেই মঙ্গল কাব্যের উদ্ভব।
প্রশ্ন: মঙ্গলকাব্য কাকে বলে?
উত্তর: যে কাব্যের কাহিনী শ্রবণ করলে সর্ববিধ অকল্যাণ নাশ হয় এবং পূর্ণাঙ্গ মঙ্গল লাভ ঘটে, তাকেই মঙ্গলকাব্য বলে। এটি বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে বিশেষ এক শ্রেণীর ধর্মবিষয়ক আখ্যান কাব্য। বিভিন্ন দেবদেবীর গুণগান মঙ্গলকাব্যের উপজীব্য। তন্মধ্যে স্ত্রী দেবতাদের প্রাধান্যই বেশি এবং মনসা ও চ-ীই এদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশ্ন: মঙ্গলকাব্যের প্রধান শাখা কয়টি ও কী কী?
উত্তর: মঙ্গলকাব্যের প্রধান শাখা দুটি : যথা : ১. পৌরাণিক মঙ্গলকাব্য ও ২. লৌকিক মঙ্গলকাব্য। পৌরাণিক শাখার মধ্যে রয়েছে- গৌরীমঙ্গল, ভবানীমঙ্গল, দুর্গামঙ্গল, অন্নদামঙ্গল, কমলামঙ্গল, গঙ্গামঙ্গল, চ-িকামঙ্গল ইত্যাদি। লৌকিক মঙ্গলকাব্য হলো শিবমঙ্গল, মনসামঙ্গল, চ-ীমঙ্গল, কালিকামঙ্গল, শীতলামঙ্গল, রায়মঙ্গল, ষষ্ঠীমঙ্গল, সারদামঙ্গল, সূর্যমঙ্গল প্রভৃতি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন