কাবা শরীফ বা বায়তুল্লাহ শরীফের ঘরই আল্লাহ তায়ালার ঘর। হযরত আদম আলাইহিস সালামের সময় থেকে এই পবিত্র ঘর এখন পর্যন্ত বিদ্যমান রয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে। আকাশের ফেরেশতা যেমন বায়তুল মামুর তাওয়াফ করেন, দুনিয়ার ফেরেশতাও তদ্রুপ বায়তুল মামুর সাদৃশ্য দুনিয়ার বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করতেন। আদম (আ.)-ও এই ঘর তাওয়াফ করতেন। তারপর সমস্ত পয়গম্বরই এই ঘর দর্শন ও তাওয়াফ করেছেন। তাই আল্লাহ তায়ালার সর্বাধিক পেয়ারা, সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ পয়গম্বর হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামকে এই ঘরের কাছে প্রেরণ করেছেন, এই মহান ঘরের জিয়ারত ও তাওয়াফের জন্য সমগ্র বিশ্বের মুসলমানকে হুকুম করেছেন এবং পাপমুক্তির স্থান নির্বাচিত করেছেন। বিবেকের বিচারে এবং মহব্বতের আইনে প্রত্যেক মুসলমানের এই কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে হজ করা প্রয়োজন ছিল। আল্লাহর রহমতে শরীয়তের হুকুম সহজ করে দেয়া হয়েছে। আল্লাহপাক বলেছেন, আল্লাহর উদ্দেশ্যে আল্লাহর ঘর জিয়ারত করা সেই সমস্ত মানুয়ের উপর ফরজ, যাদের সেখানে পৌঁছানোর মতো সঙ্গতি রয়েছে। এ কারণেই সমস্ত ফিকহের কিতাবে হজ ফরজ হওয়ার জন্য শর্ত লাগোনো হয়েছে।
হজের সফরের কদমে কদমে আধ্যাত্মিক ও নৈতিক উন্নতি সাধনের অভ্যাস হয়। আল্লাহর অবারিত রহমতের স্থান কেন্দ্রীয় দরবার বাইতুল্লায় গিয়ে যেন মানুষ নিজেকে সঁপে দিতে পারে। তাই আত্মশুদ্ধির জন্য এই সফর অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। মানুষ যদি একটু খেয়াল করে, তবে এই সফরে অনেক কিছু অর্জন করতে সক্ষম হয়। ‘সবর ঈমানের অর্ধেক’। এই সফরে মানুষের সবরের অভ্যাস খুব ভালোভাবে হয়। সবর অর্থ নফসের মতের বিরুদ্ধে নফসকে বাধ্য করা। খাওয়া-দাওয়া, ওঠা-বসা, কথাবার্তা সবক্ষেত্রেই নফসকে তার মতের বিরুদ্ধে শক্তিশালী করা। ফলকথা এই যে, বিভিন্ন অসহনীয় কাজকে সহনীয় করে নফসকে পরিমার্জিত ও পরিশুদ্ধ করে নেয়ার এক সুবর্ণ সুযোগ। মুজাহাদাই মুশাহাদা অর্জন করার সোপান যেহেতু বাড়ির চিন্তা, বিষয়-সম্পত্তির চিন্তা ইত্যাদি সাংসারিক সমস্ত বিষয়াদি পরিত্যাগ করেই মানুষ হজে গমন করার ইচ্ছা করে। বাকি থাকে শুধু এক নফসের বিষয়। তা দমন করার উত্তম সুযোগ এই সফরে পাওয়া যায়। অবশ্য বান্দার কোনো কাজই ইরাদা ও চেষ্টা ছাড়া হাসিল হয় না। কাজেই আত্মশুদ্ধির ইচ্ছা ও চেষ্টা করা দরকার। শরীয়তের যাবতীয় হুকুম-আহকামের মধ্যে আল্লাহর হুকুম পালন করে, আল্লাহর রেজামন্দি ও সন্তুষ্টি হাসিল করে আখেরাতের মুক্তি লাভ করাই হজের প্রধান ও মুখ্য উদ্দেশ্য। হজের মধ্যে হযরত আদম (আ.) হতে শুরু করে যত পয়গম্বর, গাউস, কুতুব, আবদাল, সিদ্দীকীন, শুহাদা, সালেহীন ঐ পবিত্র স্থানসমূহে তাশরীফ রেখেছেন তাদের মাজার এবং স্মৃতি-চিহ্ন রয়েছে, যা অবলোকন করলে তাঁদের কামালিয়াত ও মহৎগুণাবলি স্মরণ হয়। মানুষ ইচ্ছা করলে সেই সমস্ত কামালিয়াত ও গুণাবলি নিজের মধ্যেও অনেকটা আয়ত্ব করতে পারে। যে মৃত্যুকে স্মরণ করলে মানুষের জাগতিক আশা-আকাক্সক্ষা হ্রাস পায়, তা অর্জন করার প্রধান উপায় হলো হজের এই সফর। মানুষ যখন এই সফরে রওয়ানা হয়, তখন যেন মৃত্যুরই নমুনাস্বরূপ সংসারের মায়া ত্যাগ করে এবং পরিপূর্ণ আত্মশুদ্ধি অর্জন করার এক চেষ্টায় মনোনিবেশ করে।
হজের গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পকে কিছু হাদিস রয়েছে সেগুলো হলো: নবী আলাইহিস সালাম এরশাদ করেন, (যার উপর হজ ফরজ হয়েছে তার হজের নিয়ত করা আবশ্যক) এবং যে হজ করার ইচ্ছা করেছে, তার দ্রুত হজ করা প্রয়োজন। তিনি আরও বলেছেন, যার প্রকাশ্য শরয়ী কোনো ওজর বা অভাব নেই, জালেম বাদশাহ যাকে বন্দি করে রাখেনি কিম্বা অসুস্থতার কারণে শয্যাশায়ী হয়নি সে যদি হজ না করে মৃত্যুবরণ করে, তবে (তার মৃত্যু মুসলমানের মৃত্যু হবে না) সে ইহুদী হয়ে বা নাসারা হয়ে মৃত্যুবরণ করুক। (দারেমী)। আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন। কী ভয়ঙ্কর সর্তকবাণী! হযরত রসুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের কাছে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, বান্দার কোন আমলটি সর্বশ্রেষ্ঠ? হযরত বলেছেন, সর্বশ্রেষ্ঠ আমল ও সর্বশ্রেষ্ঠ এবাদত আল্লাহকে বিশ্বাস করা এবং আল্লাহর রসুলকে বিশ্বাস করা। অর্থাৎ ‘ঈমান’। প্রশ্নকারী জিজ্ঞাসা করেন, তারপর কোন আমল সর্বশ্রেষ্ঠ? হযরত এরশাদ করেন, আল্লাহর পথে যুদ্ধ। তারপর কোন আমল সর্বশ্রেষ্ঠ? এর উত্তরে হযরত বলেছেন, হজে মকবুল অর্থাৎ যে হজ আল্লাহর দরবারে কবুল হয়। (বুখারী ও মুসলিম); নবী আলায়হিচ্ছালাম বলেন, অর্থ এক ওমরা হতে অন্য ওমরা পর্যন্ত যা (ছগিরা) গোনাহ হয়েছে, ওমরা তার জন্য কাফফারা এবং হজে মকবুলের পুরস্কার বেহেশত ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। হযরত (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি খাঁটি দিলে আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ করবে এবং হজের মধ্যে কোনো প্রকার গোনাহর কাজ না করবে এবং কোন ফাহেশা কথা, ঝগড়া, গালা-গালি অথবা কোন নফসানী খাহেশের (নাফরমানীর) কাজ না করবে। সে যখন হজ করে ফিরে আসবে, তখন সে সমস্ত গোনাহ হতে এমন পবিত্র হয়ে যাবে, যেমন নবজাত শিশু হয়ে থাকে। হজ আল্লাহর দরবারে কবুল হলে সমস্ত গোনাহ মাফ হয়ে যায়, এই কথাই এ হাদীসের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়। ছগিরা গোনাহ তো মাফ হয়ই, অনেক আলেমের মতে, হজে মাবরুরের দ্বারা কবীরা গোনাহও মাফ হয়ে যায়। কারণ হজের মধ্যে বহু তাওবা-এস্তেগফার করা হয়। কান্নাকাটি ও কাকুতি-মিনতি করে মাফ চাওয়া হয়, যার কারণে গোনাহে কবীরাও মাফ হয়ে যায়। কিন্তু হক্কুল এবাদ অর্থাৎ পরের দেনা মাফ হয় না। আল্লাহপাকের কত বড়ো রহমত যে, বান্দা ফরজ আদায় করলে সে তার কর্তব্য পালন করে।
হজ থেকে ফিরে আসার পর প্রত্যেক হাজী সাহেবকে অত্যন্ত সতর্কতা ও পরহেজগারীর সাথে জীবনযাপন করবেন। হজের নাম দিয়ে হাজী সাহেব পদবি লাগিয়ে কোন ধরনের সুবিধা ভোগ করবেন না। অপ্রয়োজনে হজের গল্প, মোয়াল্লেমদের দোষক্রটি বা ব্যবস্থাপনার সমালোচনা করা যাবে না। হজে যা টাকা পয়সা খরচ হয়েছে তার জন্য আফছোছ থেকে বিরত থাকতে হবে। এইসব কাজে হজের সওয়াব নষ্ট হয়ে যায়। অনেকে আবার হজ করে এসে, হালাল কাজ কর্মও করতে চায় না, এটাও ভুল। হালাল জীবিকা নির্বাহে কোন দোষ নেই। কিন্তু খবরদার, হালাল করতে গিয়ে হারামের মধ্যে, লোভের মধ্যে ও পাপের মধ্যে অভ্যস্ত হওয়া যাবে না। আল্লাহ, আমাদের সমস্ত অপরাধ ক্ষমা করুন।
লেখক: খতীব, বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন