অভিবাসী শ্রমিকদের বিশাল অংশের গন্তব্য মূলত মধ্যপ্রাচ্যের সউদী আরব, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, ওমান, বাহরাইন, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, কোরিয়াসহ কয়েকটি দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সবচেয়ে বেশি সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশী শ্রমিক কাজ করে সউদী আরবে। দেশটিতে বর্তমানে প্রায় ২৫ লাখ বাংলাদেশী শ্রমিক কাজ করছে। কিন্তু সউদী আরবের পরিবর্তিত অভিবাসন আইন ও করোনাত্তোর বৈশ্বিক মন্দাসহ নানান কারণে হাজার হাজার প্রবাসী চাকরি হারিয়েছে এবং প্রতিনিয়ত হারাচ্ছে।
অর্থনৈতিক মন্দা ও কর্মস্থলে ‘সউদীকরণ’ এবং অভিবাসীদের জন্য নতুন নিয়মের কারণে বর্তমানে সউদীতে প্রবাসী শ্রমিকরা নানা সমস্যায় দিনাতিপাত করছে। ভিসায় উল্লেখিত পেশা ব্যতীত অন্য পেশায় কাজ করার সুযোগ বর্তমানে নেই বললেই চলে। কাজের ক্ষেত্রে প্রবাসীদের জন্য দেশটি আগের মতো আর উন্মুক্ত নয়। কর্মেেক্ষত্রে এখন শ্রেণী নির্ধারণ করে দেয়ায় বিপাকে পড়েছে প্রবাসীরা। এই দেশের নাগরিকরা এখন যথেষ্ট শিক্ষিত এবং বিভিন্ন পেশায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, তাই বিভিন্ন পেশায় তারা কাজ করছে এবং যোগ্যতা ও দক্ষতার স্বাক্ষর রাখছে। বিশেষ করে নারীরা অনেক এগিয়ে গেছে। প্রায় সব পেশায় তারা দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে। তাই স্বভাবিকভাবেই প্রবাসী শ্রমিকদের প্রয়োজনীয়তা কমে আসছে দিন দিন এবং এই অবস্থা ধারাবাহিক চলতে থাকবে। সউদী সরকারের সুচিন্তিত ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনায় দেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে যোগ্যতানুযায়ী কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া এবং নারীর ক্ষমতায়ন দারুণভাবে সফল হয়েছে বলা যায়। ফলে প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য এ দেশের শ্রমবাজার দিন দিন সংকুচিত হতে চলেছে, শত শত প্রবাসী শ্রমিক প্রতিনিয়ত বেকার হচ্ছে। অপরদিকে বাংলাদেশ থেকে নিয়মিত শ্রমিক আসছে নতুন ভিসায়। শুধুমাত্র ২০২১ সালের ডিসেম্বরেই প্রায় ৮৭ হাজার বাংলাদেশী শ্রমিক দেশটিতে এসেছে। আসার আগে তারা চিন্তা করছে না এখানে এসে কী করবে? চুক্তিপত্রে যে কাজের কথা বা পারিশ্রমিকের কথা উল্লেখ রয়েছে তা কতটুকু বাস্তবসম্মত এবং সত্যিকার অর্থেই তা ঠিক আছে কিনা তা বিবেচনা না করেই চলে আসছে। বিষয়টি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, কোন প্রকারে সউদী আরবে প্রবেশ করতে পারলেই সোনার হরিণের দেখা মিলবে। অথচ প্রবাসের মাটিতে আসলেই শুরু হয় জীবনের নতুন এক অধ্যায়। নতুন পরিবেশে নতুন করে বাঁচতে গিয়ে হাজারো প্রবাসীর স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চুক্তিপত্রের চুক্তি মানা হয় না। কারণ, ভিসা ব্যবসায়ীরা প্রকৃত নিয়োগদাতার সাথে অলিখিত চুক্তি করে ভিসা কিনে দেশে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে তা বিক্রি করে নানা লোভনীয় সুযোগ সুবিদার কথা বলে। যেসব বাংলাদেশী প্রকৃত অর্থে সউদী আরবের কোন কোম্পানিতে বা প্রতিষ্ঠানে বা কারো বাসা-বাড়িতে কাজ করতে আসছে তাদের ক্ষেত্রে হয়তো ভিসার চুক্তিরপত্র অনুসরণ করা হয় বা মানা হয়। কিন্তু যারা নির্দিষ্ট কোন কাজের চুক্তি না করে আসছে বা ফ্রি ভিসার নাম দিয়ে আসছে তাদের অবস্থা বর্তমানে খুবই করুণ। সউদীর নতুন আইননুযায়ী, নতুন অভিবাসীদের ৩ মাস অথবা ৬ মাসের রেসিডেন্ট পারমিট (ইকামা) দেয়া হয়। এই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যদি কোন প্রবাসী কাজের সন্ধান করে অন্য কোন কোম্পানী বা প্রতিষ্ঠানের নামে নিজের ভিসা ট্রান্সফার করতে না পারে তাহলে পরবর্তী রেসিডেন্ট পারমিট নবায়ন করার জন্য গুণতে হয় বড় অংকের ফি, যা দেশ থেকে আসা নতুন শ্রমিকদের পক্ষে দেয়া মোটেও সম্ভব নয়। ফলে অবৈধ হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোন গত্যন্তর থাকে না। দেশ থেকে বৈধ পাসপোর্ট নিয়ে এসে তিন বা ছয় মাসের মধ্যে হয়ে যায় অবৈধ অভিবাসী। শুরু হয় প্রবাসের মাটিতে দুঃসহ জীবন। একদিকে পরিবারের চিন্তা অন্যদিকে অবৈধ অভিবাসী হয়ে বাস করা, যেকোনো মুহুর্তে প্রশাসনের হাতে ধরা পড়ে জেল-জরিমানার পরোয়ানা মাথায় নিয়ে নির্ঘুম রাত কাটাতে হয়। ভিন দেশে, ভিন্ন পরিবেশে অজানা ভাষা-সংস্কৃতির মধ্যে অভিবাসী হয়ে আসা মানুষটির টিকে থাকার সংগ্রাম কত কঠোর আর প্রতিকূলতায় ভরা তা কল্পনাও করা যায় না। এখানে আসার আগে কিছু হিসেব সবাইকে মাথায় রাখা আবশ্যক। যেমন, নির্দিষ্ট কাজ নিয়ে আসছে কিনা, কাজের চুক্তিপত্র, শ্রমঘন্টা, পারিশ্রমিক, ওয়ার্ক পারমিট খরচ, স্বাস্থ্যবীমা, বাসস্থান, চুক্তি শেষ দেশে যাওয়ার খরচ ইত্যাদিও বিষয়গুলো সম্পর্কে জেনে নেয়া খুবই জরুরি। এই বিষয়গুলো সম্পর্কে পরিপূর্ণ নিশ্চিত হওয়ার পর ধারনা নিতে হবে সউদীতে একজন প্রবাসী বাংলাদেশীর মাসিক নূন্যতম কত টাকা খরচ হয়। বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা ভিসা ব্যবসায়ীরা মাসিক আয়ের কথা বললেও ব্যয়ের কথা কখনো বলে না। আর দেশে থাকা সাধারণ মানুষও বিষয়টি নিয়ে ভাবে না, তারা যখন শুনে বা চুক্তিপত্রে দেখে তাদের মাসিক বেতন বাংলাদশী টাকায় ৩০/৪০ হাজার টাকা তখন মনে করে আকাশের চাঁদ হাতছানি দিচ্ছে। এটা ভাবে না, মাসিক এই বেতনের বিপরীতে কত টাকা খরচ হতে পারে। সামান্য একটু আলোকপাত করলে বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। ধরা যাক, একজন সাধারণ শ্রমিক যার বেতন ১২০০ সউদী রিয়াল বা প্রায় ২৮ হাজার টাকা এবং বাসস্থান নিয়োগকর্তার বা কোম্পানীর। তার খরচের হিসাব দেখা যাক। দৈনিক দু’বেলা খাবার খরচ মাসিক নূন্যতম ৪শ’ রিয়াল, সকালের নাস্তা বাবদ মাসিক খরচ নূন্যতম একশ; রিয়াল, মোবাইল খরচ নূন্যতম একশ’ রিয়াল মোট ছয়শ’ রিয়াল (এটি একেবারেই সর্বনিম্ন খরচ, তাও যদি উপরে উল্লেখিত অন্যান্য সব খরচ নিয়োগকর্তা, প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানী বহন করে) বাকি থাকে ছয়শ’ রিয়াল যা বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ১৪ হাজার টাকার মতো। আর যদি কারো চা-সিগারেটের অভ্যেস বা ঔষধ খেতে হয় অথবা মাঝে মধ্যে কোথাও বেড়াতে যায়, পোশাক কিনতে হয়, তাহলে খরচের হিসাব কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। এ হিসাবটি হচ্ছে, যারা কোন কোম্পানী বা প্রতিষ্ঠানে এনগেইজড হয়ে কাজ করছে তাদের। আর যারা তথাকথিত ফ্রি ভিসায় কাজ করছে বা করার কথা ভেবে সউদী আরবে আসছে বা আসার কথা ভাবছে তাদের কথা বলা বাহুল্য। তাদের ক্ষেত্রে মাসিক এই নূন্যতম খরচের সাথে যুক্ত হয় প্রতিমাসে ওয়ার্ক পারমিট ফি, ওয়ার্ক পারমিট (ইকামা) নবায়ন ফি, স্বাস্থ্যবীমা ফি ইত্যাদি। যা বর্তমানে বছরে নূন্যতম ১২ হাজার থেকে শুরু করে ১৬ হাজার রিয়াল বা ক্ষেত্র ভেদে আরো বেশি। এরপর আছে দেশে যাওয়া-আসার টিকেট খরচ। এ হিসেবে একজন কত কামাবে আর কত জমা করবে বা পরিবার-পরিজনের জন্য কী পাঠাবে! এক্ষেত্রে যারা হাউজ ড্রাইভার বা গৃহ পরিচারিকা রয়েছে তাদের হিস্ব ভিন্ন। এখন সউদী আরব যারা আসছেন বা আসতে চাচ্ছে তাদের গভীরভাবে ভেবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এখানে এখন কাজ আছে নির্মাণ শ্রমিক, পরিছন্ন কর্মী, হোটেল-রেস্টুরেন্ট শ্রমিক, সেলুন, হাউজ ড্রাইভার, গৃহ পরিচারক/পরিচারিকা অথবা এই জাতীয় পেশার কাজ। যারা এসব পেশায় কাজ করতে পারবেন না বা করতে আগ্রহী না তাদের এখন সউদী আরবে না আসাই উত্তম। বিগত দু-এক বছরে যত বাংলাদেশী সউদী আরবে এসেছে দেখা যাচ্ছে, তাদের অধিকাংশই বয়সে একেবারে তরুণ এবং শারীরিকভাবে ভারী কাজ করার তেমন উপযুক্ত নয় বা সেই মানসিকতা নেই। তাই তাদেরকে যখন কোন ভারী কাজ দেয়া হয় তখন তারা সেখান থেকে পালিয়ে যায়। আবার বেশিরভাগ নতুন প্রবাসী আসছে ভিসা ব্যবসায়ীদের হাত ধরে অথবা কোন আত্মীয়-স্বজন বা পরিচিত জনের মাধ্যমে এই আশা নিয়ে আসে যে, চুক্তিতে কাজের কথা যাই উল্লেখ থাকুক, তারা সউদীতে এসে সুবিধা মতো কাজ খুঁজে নিয়ে ভিসা বা স্পন্সরশিপ পরিবর্তন করে নেবে। তবে বর্তমানে বিষয়টি খুবই জটিল। কারণ, অভিবাসীদের জন্য নতুন নিয়ম এবং চাকুরি সংকট। এতে যথাসময়ে কাজ জোগাড় করতে না পারা, নির্দিষ্ট সময়ে ওয়ার্ক পারমিট (ইকামা) নবায়ন করতে না পারার কারণে শত শত বাংলাদেশী শ্রমিক অবৈধ হচ্ছে এবং প্রশাসনের হাতে ধরা পড়ে দেশে ফিরে যেতে হচ্ছে। সউদী আরব সরকার বাংলাদেশের প্রতি অতিশয় সহানুভূতিশীল বিদায় প্রতিবছর প্রচুর বাংলাদেশী শ্রমিক এই দেশে আসছে। তাই বলে আমরা যদি এই দেশের বিধি-বিধানের প্রতি তোয়াক্কা না করে ধার-কর্জ করে এসে বেকার বা অবৈধ হয়ে বসে থাকি তাহলে তো হবে না।
সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, সউদী আরবস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস, জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো, জনশক্তি রপ্তানির সাথে জড়িত অন্যান্য প্রতিষ্ঠানসহ সকলের উচিত বিষয়গুলির প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখা এবং যারা নতুন অভিবাসী হয়ে আসতে ইচ্ছুক তাদেরও উচিত হবে সবকিছু জেনে শুনে পা বাড়ানো। আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। ‘যেনতেন ভাবে সউদী আরব যেতে পারলেই হবে’ এই চিন্তাধারা থেকে সরে আসতে হবে। দক্ষ শ্রমিক হয়ে উপযুক্ত কাজ নিয়ে যদি সউদী আরব আসা যায় তাহলে ব্যক্তি, পরিবার ও দেশ উপকৃত হবে এবং অবৈধ প্রবাসীর তকমা নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন শেষে রিক্ত হস্তে দেশে ফিরতে হবে না।
লেখক: কলামিস্ট, সউদী আরব।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন