শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

শিনজো আবের হত্যাকাণ্ড

মো. আরাফাত রহমান | প্রকাশের সময় : ১৪ জুলাই, ২০২২, ১২:০৩ এএম

শান্তির দেশ হিসেবে পরিচিত জাপানের সাবেক এবং ইতিহাসে দীর্ঘ মেয়াদী প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে ৮ জুলাই ২০২২ তারিখে নারা প্রশাসনিক অঞ্চলে ইয়ামাতো-সাইদাইজি স্টেশনের কাছে একটি প্রচারাভিযানের বক্তৃতা দেয়ার সময় এক বিরল ও অপ্রত্যাশিত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। তাকে মেডিকেল হেলিকপ্টারে করে নারা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে বিকেলে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। ঘটনাস্থল থেকে তেৎসুইয়া ইয়ামাগামি নামে এক সন্দেহভাজনকে আটক করা হয়। শটগানের মতো একটি ই¤েপ্রাভাইজড আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে বলে জানা গেলেও নারা প্রিফেকচারাল পুলিশ ডিপার্টমেন্ট জানায় অপরাধে ব্যবহৃত অস্ত্রটি একটি পিস্তল।

১৯৩৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারির বিদ্রোহের সময় সাবেক দুই প্রধানমন্ত্রী সাইতো মাকোতো এবং তাকাহাশি কোরেকিও নিহত হওয়ার পর আবেই হলেন প্রথম জাপানি সাবেক প্রধানমন্ত্রী, যাকে হত্যা করা হয়েছে। ৮ জুলাই আবে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী কাউন্সিলর কেই সাতোর পক্ষে একটি বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। কেই সাতো ১০ জুলাই নির্ধারিত উচ্চকক্ষের নির্বাচনের পূর্বে উপনির্বাচনের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। আবেকে একটি ডাবল-ব্যারেল আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে পিছন থেকে দুবার গুলি করা হয়, যেটি ছিল একটি হাতে তৈরি পিস্তল এবং এতে করে আবে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। গুলির ক্ষত এত গভীর ছিল যে সেটি তার হৃদযন্ত্রে পৌঁছে যায়।

গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর আবে প্রাথমিকভাবে সজ্ঞানে এবং যোগাযোগ করার মতো অবস্থায় ছিলেন। তার ডান পাশে একটি ক্ষত এবং তার বুকের বাম দিকে নিচে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ অবস্থায় তাঁকে জরুরি হেলিকপ্টার দ্বারা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। হাসপাতালে পৌঁছানোর সময় তার কোনো উল্লেখযোগ্য লক্ষণ ছিল না বলে রিপোর্ট করা হয়। দুপুরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা বলেন, ‘আবে একটি সংকটাপন্ন অবস্থার মধ্যে ছিলেন এবং চিকিৎসকরা তাদের সাধ্য মতো সবকিছুই করছেন।’ বিকেল ৫:০৩ মিনিটে আবে হাসপাতালে মারা যান।

তেৎসুইয়া ইয়ামাগামি নামের ৪১ বছর বয়সী নারা শহরের একজন বাসিন্দাকে হত্যা চেষ্টার সন্দেহে ঘটনাস্থলে নারা প্রিফেকচারাল পুলিশ গ্রেপ্তার করে এবং পরবর্তীতে তাকে নারা পশ্চিম থানায় স্থানান্তর করা হয়। তবে বিস্ময়কর ব্যাপার হল, হত্যাকাণ্ডের পর তিনি স্থির ছিলেন ও পালানোর জন্য কোনোরূপ চেষ্টাও করেন নি। ইয়ামাগামি ২০০২ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত নৌবাহিনীর সদস্য ছিলেন যেখানে তাকে কুরে নৌ ঘাঁটিতে পাঠানো হয়। ২০২২-এর মে মাসে চাকরি ছাড়ার আগে ইয়ামাগামি ২০২০ সাল থেকে কানসাইয়ের একটি উৎপাদন সংস্থায় কর্মী ছিলেন। তাঁকে গ্রেফতারের পর তার বাড়িতে তল্লাশির সময় পুলিশ বেশ কয়েকটি সম্ভাব্য বিস্ফোরক পদার্থ আবিষ্কার করে। ইয়ামাগামি তদন্তকারীদের বলেছেন, তিনি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অসন্তুষ্ট ছিলেন এবং তাঁকে হত্যা করতে চেয়েছিলেন।

আবে ২০০৬ থেকে ২০০৭ এবং আবার ২০১২ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত জাপানের প্রধানমন্ত্রী এবং লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি জাপানের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ মেয়াদী প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। আবে জুনিচিরো কোইজুমির অধীনে ২০০৫ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত প্রধান মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন এবং ২০১২ সালে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য বিরোধী দলের নেতা ছিলেন। শিনজো আবে ২১ সেপ্টেম্বর ১৯৫৪ সালে টোকিওতে একটি বিশিষ্ট রাজনৈতিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন যাদের প্রাক-যুদ্ধ, যুদ্ধকালীন এবং যুদ্ধ-পরবর্তী জাপানে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক প্রভাব ছিল। তার মাতামহ নোবুসুকে কিশি অধিকৃত চীন এবং মানচুকুওর প্রকৃতপক্ষে একজন ‘অর্থনৈতিক রাজা’ ছিলেন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রধানমন্ত্রী হিদেকি তোজোর মন্ত্রিসভায় সমরাস্ত্র বিষয়ক উপমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার পিতামহ কান আবে ইয়ামাগুচির একজন জমিদার ছিলেন যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রতিনিধি পরিষদে কাজ করেছিলেন। আবে সেইকি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং সেইকি জুনিয়র এবং সিনিয়র হাই স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। তিনি জনপ্রশাসন অধ্যয়ন করেন এবং ১৯৭৭ সালে সেইকি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান এবং ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার স্কুল অফ পলিসি, প্ল্যানিং এবং ডেভেলপমেন্টে তিন সেমিস্টারে পাবলিক পলিসি অধ্যয়ন করেন। এপ্রিল ১৯৭৯ সালে আবে কোবে স্টিল কোম্পানিতে কাজ শুরু করেন। তিনি ১৯৮২ সালে কোবে স্টিল কোম্পানি ত্যাগ করেন এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রীর নির্বাহী সহকারী, এলডিপি জেনারেল কাউন্সিলের চেয়ারপারসনের একান্ত সচিবসহ বেশ কয়েকটি সরকারি পদে অধিষ্ঠিত হন। ১৯৯১ সালে বাবার মৃত্যুর পর ১৯৯৩ সালে আবে ইয়ামাগুচি প্রিফেকচারের প্রথম জেলায় নির্বাচিত হন এবং এসএনটিভির বহু-সদস্য বিশিষ্ট জেলায় নির্বাচিত চারজন প্রতিনিধির মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। ১৯৯৯ সালে তিনি সামাজিক বিষয়ক বিভাগের পরিচালক হন। তিনি ২০০০ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত ইয়োশিরো মোরি এবং জুনিচিরো কোইজুমি ক্যাবিনেটে ডেপুটি চিফ ক্যাবিনেট সেক্রেটারি ছিলেন।

তারপর তিনি লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির সেক্রেটারি জেনারেল নিযুক্ত হন। উত্তর কোরিয়ায় নিয়ে যাওয়া জাপানি অপহৃতদের পরিবারের পক্ষে জাপান সরকারের প্রধান আলোচক ছিলেন আবে। প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে তিনি ২০০২ সালে কিম জং-ইলের সাথে দেখা করার জন্য কোইজুমির সাথে যান। তিনি যখন জাপানে আসা জাপানি অপহরণকারীদের উত্তর কোরিয়ার বিরোধিতা সত্ত্বেও জাপানে থাকার দাবি করেন, তখন তিনি জাতীয় জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তিনি এলডিপির মধ্যে একটি প্রকল্প দলের নেতা ছিলেন যেটি ্রঅতিরিক্ত যৌন শিক্ষা এবং লিঙ্গ-মুক্ত শিক্ষাগ্ধ বিষয়ে একটি সমীক্ষা পরিচালনা করেছিল। এই দলটি যে বিষয়গুলোতে আপত্তি তুলেছিল তার মধ্যে ছিল এনাটোমি পুতুল এবং অন্যান্য পাঠ্যক্রমিক উপকরণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাচ্চাদের বয়স বিবেচনায় না নেওয়া, স্কুলের নীতিসমূহ যা ছেলেদের এবং মেয়েদের ঐতিহ্যগত উৎসব নিষিদ্ধ করে এবং মিশ্র-লিঙ্গের শারীরিক শিক্ষা। দলটি জাপানের ডেমোক্রেটিক পার্টির সাথে একটি বৈপরীত্য প্রদানের চেষ্টা করে, যা এই ধরনের নীতিকে সমর্থন করে বলে অভিযোগ ছিল।

২৩ এপ্রিল ২০০৬-এ আবে ক্ষমতাসীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। পদের জন্য তার পপ্রান প্রতিযোগীরা ছিলেন সাদাকাজু তানিগাকি এবং তারো আসো। ইয়সুও ফুকুদাও প্রথম দিকের একজন প্রধান প্রতিযোগী ছিলেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইয়োশিরো মোরি, যার উপদলে আবে এবং ফুকুদা উভয়েই ছিলেন, বলেছিলেন যে দলটি জোরালোভাবে আবের দিকে ঝুঁকেছে। ২৬ সেপ্টেম্বর ২০০৬ সালে আবে জাপানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অভিষিক্ত হন। ৫২ বছর বয়সে নির্বাচিত আবে ছিলেন ১৯৪১ সালে ফুমিমারো কোনয়ের পর সর্বকনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী।

মাত্র এক বছর ক্ষমতায় থাকার পর আলসারেটিভ কোলাইটিসের চিকিৎসা সংক্রান্ত জটিলতার কারণে আবে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন। সেই বছরের হাউস অফ কাউন্সিলর নির্বাচনে তার দল হেরে যায়। তার স্থলাভিষিক্ত হন ইয়াসুও ফুকুদা, যিনি ক্রমান্বয়ে পাঁচজন প্রধানমন্ত্রীর একজন ছিলেন যারা প্রত্যেকে ষোল মাসের বেশি সময় ক্ষমতা ধরে রাখতে ব্যর্থ হন। অসুস্থতা থেকে সেরে ওঠার পর, আবে একটি অপ্রত্যাশিত রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তন করেন। প্রাক্তন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী শিগেরু ইশিবাকে পরাজিত করে সেপ্টেম্বর ২০১২ সালে দ্বিতীয়বারের মতো এলডিপি প্রেসিডেন্ট হন আবে। ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে এলডিপির নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর আবে ১৯৪৮ সালে শিগেরু ইয়োশিদার পর ক্ষমতায় ফিরে আসা প্রথম প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী হন। তিনি ২০১৪ এবং ২০১৭ নির্বাচনে এলডিপিকে আরও দুটি নিরঙ্কুশ বিজয়ে নেতৃত্ব দেন, যা জাপানের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ মেয়াদী হয়ে ওঠে। ২০২০ সালের আগস্টে প্রধানমন্ত্রী আবে তার আলসারেটিভ কোলাইটিসের পুনরুত্থানের উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তার দ্বিতীয় পদত্যাগের ঘোষণা দেন। তিনি ১৬ সেপ্টেম্বর, প্রধান মন্ত্রিপরিষদ সচিব ইয়োশিহিদে সুগাকে তার উত্তরাধিকারী হিসাবে নির্বাচিত করার পরে তার পদত্যাগপত্র জমা দেন। আবে একজন রক্ষণশীল ছিলেন যাকে রাজনৈতিক ভাষ্যকাররা ব্যাপকভাবে ডানপন্থী জাপানি জাতীয়তাবাদী হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কমফোর্ট উইমেন নিয়োগে সরকারী জবরদস্তির ভূমিকা অস্বীকার সহ জাপানের ইতিহাসের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন, যা প্রতিবেশী দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে উত্তেজনা সৃষ্টি করে। তিনি জাপানের প্রতিরক্ষা নীতির ক্ষেত্রে কঠোর হিসেবে বিবেচিত হন এবং জাপানকে সামরিক বাহিনী বজায় রাখার অনুমতি দেওয়ার জন্য শান্তিবাদী জাপানি সংবিধানের ৯ অনুচ্ছেদ সংশোধন করার পক্ষে ছিলেন।

২০১৩ সালে আবে জাপানের সংসদে এক ঘোষণাতে বলেন, জাপানের অর্থনীতিকে পুনরুজ্জিবীত করা ও ইয়েনের মানের অবনতি ঠেকানো জাপানের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি বিষয়। তার দেয়া অর্থনৈতিক কৌশল ইংরেজিতে অ্যাবেনমিকস নামে পরিচিতি পায়। এটি তিনটি ‘তীর’ নিয়ে তৈরি একটি নীতি। প্রথম তীর হল ২% মুদ্রাস্ফীতি অর্জন, দ্বিতীয়টি হল সংক্ষিপ্ত মেয়াদের জন্য অর্থনীতিকে চাঙা করার জন্য এবং পরবর্তীতে বাজেটে উদ্বৃত্ত অর্জনের জন্য একটি পরিবর্তনীয় আর্থিক নীতি এবং তৃতীয়টি হল দীর্ঘমেয়াদী প্রবৃদ্ধির জন্য বেসরকারী খাতে বিনিয়োগ ও কাঠামোগত সংস্কার।

লেখকঃ সহকারি কর্মকর্তা, ক্যারিয়ার অ্যান্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস বিভাগ, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন